দেশে কী হচ্ছে এসব! সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক জমায়েত বা পাবলিক প্লেসে প্রায়শ এমন আক্ষেপ শোনা যায়। একের পর এক নৃশংস হত্যাকান্ড, শিশুধর্ষণ, ধর্ষণের পর শিশু ও নারী হত্যা, ইভটিজিং ও মেয়েদের উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুনের শিকার হওয়ার মত ঘটনা বেড়েই চলেছে। একেকটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ব্যাপক সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও একটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনার জন্ম হচ্ছে। গতমাসে দেশের দক্ষিণের বরগুনা শহরে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীচক্র নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী গং প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার দৃশ্যটি গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হওয়ার পর অনেক মানুষের দাবী ছিল এমন অপরাধিদের ক্রসফায়ারে হত্যা করা হোক। মাফিয়া গ্যাং কালচার ও সংঘবদ্ধ অপরাধিচক্রের তৎপরতা পশ্চিমা সভ্য দুনিয়ায়ও আছে। মাদক-অস্ত্র ব্যবসা ও আন্ডার গ্রাউন্ডের অন্ধকার দুনিয়ায় হত্যা-অপহরণের মত ঘটনা কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে ইভ টিজিং ও পরকিয়া প্রেমের কারণে প্রকাশ্য নৃসংশ হত্যাকান্ড, পাশবিক লালসার শিকার হয়ে ফুলের মত সুন্দর নিষ্পাপ শিশুদের এমন নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা সভ্য দুনিয়ায় আর কোথাও এতটা প্রকট আকার ধারণ করেনি। মেয়ে শিশু ও ভ্রুণ হত্যা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে অন্যতম একটি নৈতিক-মানবিক ইস্যু হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিভিন্ন শহরে, গণপরিবহনে নারী ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ভারত ভ্রমনের ক্ষেত্রে তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করতে দেখা গেছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু বিদেশী নাগরিকও ভারত ভ্রমণ করতে এসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিশাল ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এমন সব ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা বিশ্বের আর কোথাও কল্পনাও করা যায় না। গত সোমবার প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, আসামের এক মন্দিরে জনৈক তান্ত্রিক নরবলির আয়োজন করছিল। মন্দিরে নিয়ে আসা এক মেয়ে শিশুকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়ার আগে মন্ত্রপাঠ ও নৃত্যগীতে যজ্ঞানুষ্ঠান চলাবস্থায় স্থানীয় কৌতুহলি মানুষ বিষয়টি জানার চেষ্টা করলে মন্দিরের লোকদের সাথে সংঘাত বেঁেধ গেলে খবর পেয়ে পুলিশ এসে খড়গ-অস্ত্রসহ বলির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা শিশুটিকেও উদ্ধার করেছে। অত:পর জানা গেছে, যে শিশুটিকে বলির জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল তার পিতা-মাতাও উক্ত অনুষ্ঠানের হাজির ছিল। তাদের সম্মতি ও অংশগ্রহণেই যজ্ঞানুষ্ঠানে আয়োজন চলছিল বলে জানা যায়। তারা পুলিশের উপরও আক্রমন চালায় এবং পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হলে কয়েকজন আহত হয়। দু সপ্তাহ আগেও আসামের একটি মন্দিরের কাছে এক নারীর মস্তকহীন মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। তখনো মরদেহটি মন্দিরে নরবলির শিকার বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল কেউ কেউ। এরপর একই এলাকার মন্দির থেকে বলির জন্য নিয়ে আসা শিশু উদ্ধারের পর ছিন্ন মস্তক নারীর বলি হওয়ার আশঙ্কাই সঠিক বলে মনে করা হচ্ছে। এটা হচ্ছে ভারতের পিছিয়ে পড়া সমাজের বাস্তবতা। ধর্মীয়-সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় কোনো কোনো সমাজে নরবলির মত ঘটনা সভ্য দুনিয়ায় এখনো ঘটছে। কিন্তু আমাদের মত শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে, মসজিদ-মাদরাসার শহরে কেন শিশুরা ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার শিকার হচ্ছে, তা নিয়ে শুধু ভাবলেই চলবে না, এ ধরনের অবস্থার সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনে দৃঢ় ও কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
যত বড় অপরাধি হোক, মানুষ বিচার বর্হিভ’ত হত্যাকান্ড সমর্থন করেনা। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে বছরের পর বছর ধরে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্তি করেও যারা পার পেয়ে যায় তারা বিনা বিচারে ক্রসফায়ারের শিকার হলেও মানুষ তা সমর্থন করে এবং স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে। বরগুনার রিফাত শরিফ হত্যার প্রধান আসামী নয়ন বন্ড এর আগেও নানা অপরাধে অভিযুক্ত হলেও আইনের ফাঁক ফোঁকড়ে জামিনে বেরিয়ে এসে আরো উন্মত্ত রূপ ধারণ করেছে। এ কারণে এই চক্রের সদস্যদের প্রকাশ্য হুমকি-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কেউ থানা বা আদালতে মামলা করারও সাহস পেতো না। স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে রিফাত শরিফকে হত্যার ঘটনাটি গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে সারাদেশে আলোচিত হওয়ার পরই কেবল সবাই এই চক্রের নানা অপকর্মের সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছিল। ইতিমধ্যে নয়নবন্ড এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা বা গডফাদারদের নামও উঠে এসেছে। সব অভিযোগ সত্য নাও হতে পারে। তবে এমন সন্ত্রাসীরা একদিনেই গড়ে উঠেনি এবং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া শহর দাপিয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকা এবং প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যার মত ঘটনা ঘটানো সম্ভব ছিল না। সেই নয়ন বন্ড ধরা পড়ার পরও অন্তত দুদিন পুলিশের কোনো স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের ক্রসফায়ারে নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার ঘটনা এ ধরনের অপরাধিদের জন্য একটা ম্যাসেজ বা দৃষ্টান্ত। গত এক দশকে সারাদেশে নয়ন বন্ডের মত এমন অসংখ্য অপরাধি তৈরী হয়েছে। ওরা প্রায় সবাই কোনো একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার বা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী বা নেতাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে। প্রায় দেড় দশক আগে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ধর্ষণে সেঞ্চুরি উৎযাপনের খবর প্রকাশিত হয়েছিল, বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া প্রাপ্ত সে গুনধর ছেলেটিকে কোনো মামলা বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল বলে কোনো তথ্য জানা যায়নি। বিশ্বজিৎ হত্যায় অভিযুক্তরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগ কর্মী, বেশ কয়েক বছর ধরে বিচারকার্য চলার পর আদালতের রায়ে মূল অভিযুক্ত এবং হত্যাকান্ডের সাথে অথেনটিকভাবে জড়িত বেশীরভাগই লঘুদন্ড অধবা খালাস পাওয়ার পর নিহত বিশ্বজিতের পরিবারের ক্ষোভ ও হতাশা আর চাপা থাকেনি। একইভাবে সিলেটে কলেজ ছাত্রী খাদিজাকে প্রকাশ্য কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন তোলার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে নরপশু বদরুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। বগুড়ায় এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল স্থানীয় শ্রমিকলীগ নেতা তুফান সরকার। মেয়ের ধর্ষণের বিচার চাওয়ার অপরাধে মেয়েসহ মাকে ধরে এনে বেঁধে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা নির্যাতন-লাঠিপেটা করে উভয়ের মাথা ন্যাড়া করে শহর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করে। দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেই তুফান সরকারের এখনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় সারাদেশে এ জাতীয় অপরাধিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ কারণেই এ ধরণের অপরাধিরা র্যাব-পুলিশের ক্রস ফায়ারে নিহত হলে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবং নিরব সমর্থন জানায়। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে এমন অপরাধিদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি তাদের পৃষ্ঠপোষক বা কথিত গডফাদারদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো হলে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা অসম্ভব ছিল না।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর। আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার কমন চিত্রটি গোপণ থাকেনি। বিদেশি গণমাধ্যমেও সকালবেলায় ভোট শুরুর আগেই সিলমারা ব্যালটে বোঝাই বাক্স জমা করার ভিডিও প্রচারিত হয়। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও স্বপ্নের গণতন্ত্রের মুখে ছাই দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে চলতি বছরটি শুরু হয়েছিল। তবে নির্বাচনের পরদিন থেকে বেশ কয়েকদিন ধরে দেশের গণমাধ্যম রাতের বেলায় সিলমারাসহ একতরফা নির্বাচনের নানা অনিয়মের চেয়ে ফেনির সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের দ্বারা চার সন্তানের জননী এক নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা বেশি প্রচার লাভ করে। বছরের প্রথম সপ্তাহে নতুন মেয়াদে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ইভটিজার, লম্পট-ধর্ষক ও পেশাদার সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ছত্রছায়া নিয়ে নতুন উদ্যমে খুন-ধর্ষণে মেতে উঠে। এর আগে থেকে সেই বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে ইতিমধ্যে আলোচিত খুন-ধর্ষণসহ চাঞ্চল্যকর অপরাধমুলক ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী অথবা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম উঠে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে সোনাগাজী মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যার মূল নায়ক মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌলা ও অন্যান্য আসামীদের ধরে রিমান্ডসহ বিচারের সম্মুখীন করা, বরগুনার রিফাত হত্যার প্রধান আসামী নয়ন বন্ডের ক্রন ফায়ার ও অন্যান্ন আসামীদের গ্রেফতার রিমান্ড ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় এবং বিচারিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে অবস্থার একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা দেখা যাচ্ছে। তবে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মিতু হত্যাসহ কিছু চাঞ্চল্যকর খুন-ধর্ষণের জড়িতদের বিচার দূরের কথা, কাউকে চিহ্নিতই করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধিরা নানাভাবে পার পেয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আর এখন এই বিচারহীনতা ও অমানবিকতার নির্মম শিকারে পরিনত হচ্ছে দেশের শিশু-কিশোররা। সব দেশেই নারীরা কমবেশি ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু শিশুদের উপর এমন পাশবিক হয়ে উঠার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। গত সোমবার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৬ মাসে বাংলাদেশে প্রায় ৪শ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারী সংস্থা দেশের ৬টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮ টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য উপস্থাপন করেছে। বলাবাহুল্য, এখানে মাত্র ৬টি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়া হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরাম নামের আরেকটি সংস্থা সারাদেশের ১৫টি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে একই সময়ে দেশে প্রায় ৫শ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রথমত গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্রের এগুলো একেকটি খন্ডচিত্র মাত্র। দ্বিতীয়ত: যেখানে সাধারণ অপরাধের সব ঘটনাই নানা কারণে পত্র-পত্রিকা বা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়না, সেখানে শিশু-কিশোরীদের ধর্ষিত হওয়ার মত অত্যন্ত স্পর্শকাতর ঘটনার বেশিরভাগ অপ্রকাশিত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অতএব ৬ মাসে প্রায় ৫শ শিশু ধর্ষষের শিকার হওয়ার যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে তা আংশিক চিত্র মাত্র। এর মধ্যে অর্ধ শতাধিক শিশু গণধর্ষণ বা একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে গত ৬ মাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে অন্তত ২৩ট শিশুকে। রাজধানীর ওয়ারিতে ৭ বছরের ফুটফুটে শিশু সায়মাকে ৯ তলার ছাদে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা গত ক’দিন ধরে গণমাধ্যমে বেশ প্রচার পাচ্ছে। একটি রোম হর্ষক-বর্বর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনা এসে আগের ঘটনাটি ভুলিয়ে দেয়ার ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া যেন সক্রিয় রয়েছে।
এ দেশের জনগণের উপর ক্ষমতার দাপট ও শোষণের স্টিম রোলার ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে তার বিরুদ্ধে একটি জাতীয়তাবাদি আত্মজাগরণের শুচনা করেছিল। সে জাগরণই এ দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি হিসেবে আবিভর্’ত হয়েছিল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের কলম সৈনিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি?’ এই অমর গীতিকাব্যের দ্বিতীয় ছত্রে লিখেছেন;
‘জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা/ শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা, / দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তি লগ্নে তবু তোরা পার পাবি?’
বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র-যুবকদের কেউই শিশু-কিশোর ছিল না। তবে ওরা এ দেশের সন্তান, এ অর্থে দেশমাতৃকার শিশু। সে সময়টাকে দিন বদলের ক্রান্তিলগ্ন বলে দাবী করেছিলেন লেখক। বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আজ আমরা একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পেরিয়ে যাচ্ছি। এখনো আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দিন বদলের প্রতিশ্রুতিকে ভোটের রাজনীতির লোভনীয় শ্লোগান হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। প্রকৃতির নিয়মেই দিন বদল হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও দিন বদল হয়েছে বটে, সেটা ক্রমেই সমাজ ও জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুঁলে থাকে হাতে মেহেদী রাঙা কিশোরী ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাক, নিস্ক্রিয়। আর দেশের ভেতর ঘরে ঘরে চলছে আকাশ সংস্কৃতির উলঙ্গ-অশ্লীলতার উদ্ধত্ত আগ্রাসন। সে উন্মত্ত অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ছে সব শ্রেনী পেশার মানুষের মন-মগজে। শিক্ষার নামে অনৈতিক বাণিজ্য এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনৈতিক প্রতিযোগিতার চারণ ক্ষেত্রে পরিনত করতে শুরু করেছে। একদিকে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে অনৈতিক প্রতিযোগিতা এক সময় পাশবিকতার চর্চায় পরিনত হচ্ছে। গত সপ্তায় নারায়ণগঞ্জের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০ ছাত্রীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। আরেক মাদরাসা শিক্ষককে অন্তত ১২ ছাত্রীকে যৌণ হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীর নামিদামী এক স্কুলের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌণ হয়রানির অভিযোগে বেশ তোলপাড় হয়েছিল কয়েক বছর আগে। এ সপ্তাহে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধর্ষক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানব বন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। দিন বদলের এই ক্রান্তি লগ্নে এসব কিসের আলামত? এ থেকে উত্তরণের পথ কোথায়? ডিজিটাল বাংলাদেশের নিরাপত্তা কার হাতে? শহরে-গ্রামে-গঞ্জে প্রতিদিনই শিশুরা ধর্ষিত-নির্যাতিত ও হত্যার শিকার হচ্ছে। এক শ্রেনীর মানুষ সমাজকে নির্মম পৈশাচিকতায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। চেয়ে বেশি দু:সময় কোনো সমাজের হতে পারে না। আমরা কি মুক্তবাজার অর্থনীতির মত আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, আত্মমর্যাদা ও নৈতিকতার মানদন্ডগুলো বিজাতীয় সংস্কৃতির কাছে বিকিয়ে দিতে থাকবো? নাকি সব অনৈতিক ব্যবস্থা, অশ্লীলতা ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সর্বশক্তিতে রুখে দাঁড়াবো? এই সিদ্ধান্ত এখনি রাষ্ট্র ও সমাজের সবাইকে নিতে হবে।
bari_Zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন