শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভারতের পাহাড়ি ঢলে বন্যা

নিজেদের স্বার্থে গেট-বাঁধ-ব্যারাজ খুলে দিয়েছে : ৭৫ পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি

শফিউল আলম/ পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

ভারতে অতি বৃষ্টিতে বন্যার মুখে পড়েছে দেশটির ব্যাপক অঞ্চল। উজানভাগ থেকে ঢল-বানের পানি হু হু করে নেমে আসছে বাংলাদেশের ভাটিতে। বন্যা পরিস্থিতি ঠেকাতে অতীতের মতোই খুলে দিয়েছে গেইট-বাঁধ-ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্পগুলোর কপাট। এ অবস্থায় ধেয়ে আসছে বন্যা। হঠাৎ ফুলে-ফুঁসে উঠেছে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ দেশের প্রধান সবকটি নদ-নদী। দেশের নদ-নদীসমূহের ৯৪টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল (বুধবার) বিকেল পর্যন্ত গত ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৫ পয়েন্টে। গত সোমবার ৪৬, মঙ্গলবার ৬৬টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। বিপদসীমায় আছে ৫ নদী।

আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যমুনা নদসহ আরও বিভিন্ন নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ মুহূর্তে পানি হ্রাসের দিকে ১৬টি স্থানে। তিস্তার পানি প্রায় বছরব্যাপী আটকে রাখে ভারত। আর এখন গজলডোবা বাঁধের গেইটগুলো খুলে দিয়ে দেশের উত্তর জনপদকে বন্যার মুখে ঠেলে দিয়েছে। দেশে এবার দীর্ঘস্থায়ী খরার দহনে অসহনীয় তাপপ্রবাহের রেশ কাটতে না কাটতেই ভারতের উজানের ঢলে বন্যার মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অনেক অঞ্চলে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করছে লাখো মানুষের। এমনিতেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রায় সর্বত্র ভাঙাচোরা ও নাজুক।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় সকল প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির দিকেই রয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। তাছাড়া ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও সংলগ্ন বিহার এবং নেপালেও ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, মনু, খোয়াই, ফেনী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও হালদাসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অববাহিকায় নদ-নদীর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। এদিকে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে নদ-নদীর খননে নাব্য থাকলে পানি অনায়াসে ভাটি হয়ে বঙ্গোপসাগরে গড়ায়। তবে বিশেষত ভারতের উজানভাগে বর্তমানে অতি বর্ষণ হচ্ছে। আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

এতে করে উজানের ঢলের পানি নেমে আসছে। এ কারণে প্রধান নদ-নদীসমূহে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি জানান, পানি যে গতিতে বাড়ছে তাতে আগামী ১৩ জুলাই শনিবার নাগাদ যমুনা নদ বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। জুলাইয়ের এ সময়ের বন্যা স্বাভাবিক বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ভারতের উজান থেকে নেমে আসা অব্যাহত ঢল-বানের কারণে দেশের উত্তর জনপদের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরমধ্যে তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ২৩ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে ৩০ সে.মি. নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে ভারত গজলডোবা বাঁধের গেইটসমূহ খুলে দেয়ার কারণে ভাটিতে বাংলাদেশের উত্তর জনপদে তিস্তায় তিন দিন ধরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে বন্যার শঙ্কা রয়েছে। ধরলা নদীর পানি আরো বেড়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৭৪ সে.মি. নিচে রয়েছে।

উজানভাগে ভারত থেকে তীব্র ঢলের তোড়ে অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে গিয়ে চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার নিচে এসে গেছে। যমুনা নদের পানিও বাড়ছে সবকটি পয়েন্টে। সর্বশেষ রেকর্ডে যমুনা ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৭ এবং বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৮০ সে.মি. নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুরমা, কুশিয়ারাসহ সিলেট অঞ্চলের সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে মেঘালয়, আসামে অতিবৃষ্টির কারণে ঢলের চাপে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জে সুরমা বিপদসীমার ৫৮ সে.মি. উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমেশ্বরী নদী দূর্গাপুরে বিপদসীমার ৭৪ সে.মি. ঊধের্ব রয়েছে। খোয়াই নদী বাল্লা পয়েন্টে ৩৭ সে.মি. উপরে, মাতামুহুরী নদী চিরিঙ্গায় ১৩ সে.মি. উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। জাদুকাটা নদী রয়েছে বিপদসীমায়। গত তিন দিনে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুহুরী, হালদা, সাঙ্গু নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে। বন্যা নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বন্যার তথ্য দিতে রাজি হননি।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মো, ওয়াহিদুজজামান ইনকিলাবকে বলেন, টানা বর্ষণ ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০টি স্থান ভেঙ্গে গেছে। ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমরা সকল উপজেলা দুই হাজার ব্যাগ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাইকিং করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বলা যাবে না।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জহির উদ্দিন জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১০টি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ আরও ৩ থেকে ৫ দিন হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, ত্রিপুরায় মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। এসব অঞ্চলে অতিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় ভারী বর্ষণের রেকর্ড আসামের চেরাপুঞ্জিতে ২৫৯ মি.মি., শিলংয়ে ১৯২ মি.মি., দার্জিলিংয়ে ৭১ মি.মি., জলপাইগুঁড়িতে ৬২ মি.মি., দিব্রুগড়ে ৬১ মি.মি., গোহাটিতে ৫০ মি.মি.।

অন্যদিকে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের নদ-নদী এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী, কখনও অতিভারী বর্ষণ হয়েছে। এরমধ্যে- লরেরগড়ে ২৮০ মি.মি., দুর্গাপুরে ১৫৯ মি.মি., ডালিয়ায় ১৪৮ মি.মি., লামায় ১৪৮ মি.মি., রামগড়ে ১৪৫ মি.মি., জারিয়াজঞ্জাইলে ১৪৫ মি.মি., সুনামগঞ্জে ১৪৩ মি.মি., বান্দরবানে ১৩৮ মি.মি., কক্সবাজারে ১২৫ মি.মি., রংপুরে ১৩৫ মি.মি., নারায়ণহাটে ১০৮ মি.মি., দেওয়ানগঞ্জে ৭৫ মি.মি., কুড়িগ্রামে ৭২ মি.মি., ছাতকে ৬৮ মি.মি., দিনাজপুরে ৬৪ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছে।

পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি (৫ দিন) এবং সম্ভাব্য তথ্যভিত্তিক মধ্যমেয়াদি (১০ দিন) পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে ৮ জুলাই থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানির সমতল বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে যমুনা নদ জামালপুর-বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তীতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি এবং সিরাজগঞ্জে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। যার প্রভাবে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। পানিবৃদ্ধি সপ্তাহব্যাপী অব্যাহত থেকে পুনরায় ২০ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে হ্রাস পেতে পারে।

মেঘনা বেসিনের পূর্বাভাসে বলা হয়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভারতের মেঘালয় অঞ্চলে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা অঞ্চলে সুরমা-কুশিয়ারা ও কংস নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ত্রিপুরা প্রদেশে বৃষ্টিপাতের কারণে মনু, খোয়াই, গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জ ও মৌলভিবাজার জেলায় স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

গঙ্গা বেসিনের পূর্বাভাস মতে, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের বিহার ও নেপালে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এ কারণে গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু পানি বিপদসীমার নিচে অবস্থানের ফলে বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কা নেই। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধির ফলে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বেসিনের পূর্বাভাস মতে, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চল এবং সংলগ্ন ভারতীয় অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। অতিবর্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান নদ-নদীর (কর্ণফুলী, হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গু) পানির সমতল দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার কোথাও কোথাও স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mohammed Kowaj Ali khan ১১ জুলাই, ২০১৯, ৭:০৫ এএম says : 0
ভারত করতিক সকল বাঁধ মারাত্মক অবৈধ অন্যায়। নদীতে বাঁধ দিতে পারে না ভারত। আমাদের দেশের সকল ভারতীয় দালালদেরকে আইনের আওতায় এনে প্রথমে সাজা দেওয়া হোক। এবং সাথে, সাথে ভারতকে বলা হোক সকল বাঁধ ভেংগে দেওয়ার জন্য। .................................
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন