বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাতে ভুতুড়ে ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো

দীর্ঘদিন অকেজো সড়কবাতি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

রাজধানীর প্রতিটা ফ্লাইওভারের অধিকাংশ সড়কবাতিই নষ্ট। কোন কোন স্থানে দুয়েকটি সড়কবাতি মিটমিট করে জ্বলতে দেখা গেলেও তাতে নেই পর্যাপ্ত অলো। আলো না থাকার কারণে রাতে ভুতুড়ে রূপ ধারণ করছে রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোতে। এ অবস্থায় রাত দশটার পর ফ্লাইওভারগুলোতে উঠলে গা ছমছম করে। অজানা আতঙ্ক ভর করে মনে। এলজিইডি, রাজউক, ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোর নির্মাণ কাজ করলেও বর্তমানে এগুলোর রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব কার এ নিয়েও চলছে ইঁদুর বেড়াল খেলা। ফ্লাইওভারগুলোর সড়কবাতিসহ যে কোন সংস্কারের দায়িত্ব কার এ নিয়ে এলজিইডি, রাজউক ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে নেই কোন সমঝোতা।

রাজধানীর প্রতিটা ফ্লাইওভারে ব্যবহৃত বাতিগুলো অনেক দিন ধরে অকেজো। ফলে রাতের বেলা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ফ্লাইওভারগুলো। রাতের অন্ধকার দূর করতে অকেজো হয়ে পড়া বাতিগুলো ঠিক করে সচল রাখতে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন ছিনতাইয়ের প্রবণতা বাড়ছে তেমনি ফ্লাইওভারের সৌন্দর্যও নষ্ট হচ্ছে। এলজিইডি, রাজউক, ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটা ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধনের সময় সবগুলো বাতি সচল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রায় সবগুলোই অকেজো হয়ে গেছে। নিয়মিত চলাচলকারীরা জানান, ফ্লাইওভারগুলো চালুর সময় বাতিগুলো সচল ছিল। কিন্তু পরে সঠিক নজরদারির অভাবে ক্রমান্বয়ে সবগুলো বাতিই অকেজো হয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক মাস পর বাতির স্ট্যান্ডগুলোও ফ্লাইওভারে পাওয়া যাবে না। এজন্য সঠিক নজরদারির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। গত দু-দিন সরজমিন রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোতে দেখা যায়, সবগুলো বাতিই অচল। প্রত্যেকটি ফ্লাইওভারে স্থাপিত শত শত বাতির মধ্যে কোথাও কোথাও দুয়েকটি বাতি মিটমিট তরে জ্বলতে দেখা যায়। বাকিগুলো স্ট্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও বাতিগুলো জ্বলতে দেখা যায়নি। ফলে রাতের বেলা ফ্লাইওভারগুলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। এতে ফ্লাইওভারগুলোতে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এমনকি গভীর রাতে ফ্লাইওভারগুলোতে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে কুড়িল ফ্লাইওভারেগিয়ে দেখা যায় এর অধিকাংশ সড়কবাতি নষ্ট। এই ফ্লাইওভারটি দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে গাড়ির হেডলাইটের আলোই চালকদের ভরসা। ফলে এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ফ্লাইওভারটির আশপাশের এলাকা অন্ধকার থাকার কারণেও নানা ধরনের অপরাধের ঘটনাও ঘটছে।

এই পথের নিয়মিত যাত্রী রহমান আনছারি বলেন, গত সোমবার আনুমানিক রাত আটটার দিকে গাজীপুর থেকে ছেড়ে আসা অনাবিল পরিবহনের একটি বাস কুড়িল ফ্লাইওভার পার হয়ে নামার সময় একটি ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ব্যক্তিগত গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আলোর ব্যবস্থা থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটত না।

ফ্লাইওভারের নিচে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভারের আশপাশের জায়গায় অন্ধকার পরিবেশ বিরাজ করে। মাঝেমধ্যে চালকেরা ঠিকমত দেখতে পারে না। এতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেও সমস্যা হয়।

ফ্লাইওভারের আশপাশের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্লাইওভারের নিচে রেললাইনের পাশে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে। জায়গাটি একটু নিরিবিলি ও অন্ধকার, তাই সন্ধ্যা নামতেই এখানে মাদকসেবীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অন্ধকার থাকায় এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনাও বেড়েছে বলে তাঁরা জানান।
গত কিছু দিন আগেও ছিনতাইকারীদের গাড়ির চাপায় একজন রিকশাচালক নিহত হন। তিনি গাইবান্ধার একটি বাস থেকে কুড়িলে নামার পর ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

কুড়িল ফ্লাইওভার এলাকা ঘুরে আরও দেখা গেছে, পূর্বাচলগামী ৩০০ ফিট সড়ক দিয়ে এয়ারপোর্টগামী লুপ বেয়ে ফ্লাইওভারে উঠলেই চোখে পড়বে একপাশের কয়েকটি লাইটপোস্ট, যা দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো ল্যাম্পপোস্ট না অন্য কিছু। কিছু দূর গেলে চোখে পড়ে ফ্লাইওভারের ডান পাশে এমন সারি সারি লাইটপোস্ট। বাতি না থাকায় ফ্লাইওভারের এ পাশটা অন্ধকার। রাতের গাড়িগুলো তাই সতর্কভাবে হেডলাইটের অলোয় পথ চলছে ঝুঁকি নিয়ে। এ লুপের বিমানবন্দর সড়কেরও একই অবস্থা। আবার ৩০০ ফিট সড়ক দিয়ে এমইএস লুপ, নিকুঞ্জ-কুড়িল লুপ বা খিলক্ষেত-কুড়িল লুপেরও একই অবস্থা। ফ্লাইওভারের নিচের অবস্থা আরও ভয়াবহ। উপরে কিছু সড়কবাতি জ্বললেও নিচে প্রায় পুরোটাই অন্ধকার। এখানটায় তাই আখড়া বানিয়ে বসে থাকেন ছিন্নমূল, ভবঘুরে ও নেশাখোররা।

পূর্বাচলগামী ৩০০ ফিট সড়ক দিয়ে এয়ারপোর্টগামী লুপ বেয়ে ফ্লাইওভার প্রথম বাঁকে দু’টি লাইটপোস্টেই লাইট নেই। এমন চিত্র দ্বিতীয় বাঁকেরও। ফ্লাইওভারের পশ্চিম অংশ এমইএস ও শ্যাওড়ামুখী অংশের কোথাও কোথাও পুরোপুরি অন্ধকার। এ এলাকায় গাড়ির হেডলাইটই ভরসা। আঁকাবাঁকা ফ্লাইওভারের দু’পাশে লাইটপোস্ট থাকলেও অনেকগুলোতে বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। ফ্লাইওভারের ওই অংশের নিচের রাস্তায়ও নেই আলোর ব্যবস্থা।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীনে নির্মিত হওয়া এসব ফ্লাইওভার ঘিরে সক্রিয় রয়েছে এক ধরনের ছিনতাইকারী। এ ছাড়া এসব ফ্লাইওভারে নিচের জায়গাও দখল হয়ে গেছে। এতে মাদকাসক্তদের আড্ডাসহ অপরাধ কর্মকান্ড বেড়েছে। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে চায়ের দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে দখল করা হয়েছে ফাঁকা জায়গা। আর রাত হলেই ফ্লাইওভারের নিচে বসছে মাদকের আড্ডা। গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ঘোড়ার আস্তাবল, জুতার মার্কেট আর মুদি দোকান বসেছে। কুড়িল বিশ্বরোড ফ্লাইওভারেও হয়ে উঠেছে অপরাধীদের আস্তানা।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিয়ম না থাকার পরও ফ্লাইওভারের যেখানে-সেখানে চালকরা বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে নেয়। আর সন্ধ্যায় এ সুযোগটি নেয় ছিনতাইকারীচক্র। বাসের জন্য কোনো যাত্রী অপেক্ষমাণ থাকলে সেখানে ছিনতাইকারী এসে হানা দেয়। সরেজমিনে দেখা যায়, ফ্লাইওভারের রাস্তার দুই পাশের একটি বাতিও জ্বলছে না। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা থাকলেও এগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেই। লাইট নষ্ট থাকায় সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভারের ওপরে ও নিচে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে ফ্লাইওভারের বেশির ভাগ ল্যাম্পপোস্টের বাতির তার খুলে নিয়ে গেছে চোরচক্র। মালিবাগ আবুল হোটেলের পর থেকে শান্তিনগর বাজার ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন পর্যন্ত একই অবস্থা। গুলিস্তানে সিএনজি অটোরিকশা চালক মেহাম্মদ আলী বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের পরিবেশ অনেক খারাপ। নিচ দিয়ে হাঁটা যায় না। ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়, ময়লার ঝুড়ি পড়ে থাকে। এ ছাড়া অন্ধকারে ছিনতাই হয়। রাতের বেলা এ পথ দিয়ে সিএনজি চালাতে ভয় লাগে। মগবাজার ফ্লাইওভারের বিষয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ফ্লাইওভারে কমিউনিটি পুলিশের যে বসার জায়গা, সেখানে তারা না থাকলে ভ্রাম্যমাণ মাদকসেবীরা সেখানে ভিড় জমায়। তারা আড্ডা দিয়ে মাদকসেবন করে। স্থানীয় বাসিন্দা জাফর আহমেদ বলেন, ফ্লাইওভারের বাতিগুলো অকেজো। এ ছাড়া চোরেরা তার ও বাতির হোল্ডার খুলে নিয়ে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব ফ্লাইওভারের কোনো অভিভাবক নেই।
এদিকে এলজিডি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে এলজিডি মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত থাকলেও এগুলো চালু হওয়ার পর তা দেখাশোনা করার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। ফ্লাইওভারের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৗশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মালিবাগ অংশের ফ্লাইওভার আমাদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে। এ বিষয়ে এখনো অনেক প্রক্রিয়া বাকি। তাই এই ফ্লাইওভারটি এখনো এলজিইডির হাতেই রয়েছে। আর বনানী ও কুড়িল ফ্লাইওভারও এখনো আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। যদি ফ্লাইওভারের কোনো বাতি না জ্বলে তাহলে সে দায় আমাদের না।

অন্য দিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, মগবাজার ফ্লাইওভার চালু হয়েছে অনেক আগেই। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে বলেছি, তারা যেন এ ফ্লাইওভারটি দায়িত্ব বুঝে নেয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে এর দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে না। কিভাবে ফ্লাইওভারের বাকি দিকগুলো তদারকি করা হবে সেগুলো তো তাদের নির্ধারণ করার কথা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক জানান, ফ্লাইওভারের বাতি জ্বলে না এটি তো পুরনো সমস্যা। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমানোর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানানো হয়েছে। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ফ্লাইওভারগুলোতে কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দিনের পর দিন কোনো ফ্লাইওভারে বাতি জ্বলবে না এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। #

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন