বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বন্যার অবনতি দশ জেলায়

তিস্তায় রেড এলার্ট

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় দেশের উত্তরাঞ্চল, হাওরাঞ্চল ও বৃহত্তর চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেশের ৯৩টি নদ-নদীর পানি ৭৭টি পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১২টি পয়েন্টে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করায় তিস্তা ব্যারেজ এলাকা ও চরাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ড রেড এলার্ট জারি করেছে। পানি বাড়ার সাথে সাথে ভাঙন তীব্ররূপ ধারণ করছে। ইতোমধ্যে শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলো এখন আশ্রয় হারিয়ে অন্যের ভিটায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে। স্থানীয়ভাবে কাজকর্ম না থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। সড়ক ডুবে যাওয়ায় বান্দরবান চতুর্থ দিনের মতো সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। ধসে পড়ছে পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরতদের সরিয়ে নিচ্ছে প্রশাসন। অন্যদের সরে যেতে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। লালমনিরহাটে তিস্তার দোয়ানি পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির উচ্চতা ৫২ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। সুনামগঞ্জে সুরমা ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। প্লাবিত হয়েছে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। কুড়িগ্রামে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দি ৪০ হাজার মানুষ। টানা বর্ষণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, পটুয়াখালীর গলাচিপা, ভোলার চরফ্যাশনসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জনপদের মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপদ্রুত এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে উপদ্রুত এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এদিকে, ১০ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ভারতের ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় যমুনা নদীতে পানি বাড়বে এবং বিহারে গঙ্গার পানি বাড়ায় পদ্মার অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। জামালপুরে ভাঙনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে এবং লালমনিহাটে তিস্তা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার এবং নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থির অবনতি হয়েছে। তিনি বলেন, ৬২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে, তারমধ্যে ২৬টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলোতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ৫৫১টি সেন্টারকে ঝুঁকিমুক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছি। এগুলো মোকাবিলায় কাজ শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী আরোও বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে পাঠানো হয়েছে দুই কোটি ৯৩ লাখ টাকা, সাড়ে ১৭ হাজার টন চাল এবং ৫০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার। এসব জেলায় দু’এক দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে ৫০০ তাবু, তৈরি করা হয়েছে মেডিকেল টিম প্রতিমন্ত্রী জানান, আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেই নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দেশের ৯৩টি নদ-নদীর পানি ১২টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সমতল স্টেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৯৩টি নদ-নদীর পানি ৭৭টি পয়েন্টে বৃদ্ধি ও ১৪টি পয়েন্টে হ্রাস পেয়েছে।

গতকাল নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা প‚র্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পানি পরিস্থিতি একটি পয়েন্টে অপরিবর্তিত রয়েছে এবং একটি পয়েন্টের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। দেশের সকল প্রধান নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্ট, চিলমারি ও গাইবান্ধার ফুলছড়ি পয়েন্ট, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্ট এবং তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্ট বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী ও সাঙ্গুসহ প্রধান নদীসম‚হের পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও লালমনিরহাট জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এলাকার সরেজমিন চিত্র বিস্তারিত জানিয়েছেন ব্যুরো অফিস ও সংবাদদাতারা :
লালমনিরহাট : ভারী বর্ষণ আর অব্যাহত উজানের ঢলে তিস্তার পানি দোয়ানি পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করায় তিস্তা ব্যারেজ এলাকা ও চরাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ড রেড এলার্ট জারি করেছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার পানি প্রবাহ দোয়ানি পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির উচ্চতা ৫২.৯৫ সেন্টিমিটার। দেখা দিয়েছে প্রচন্ড নদী ভাঙন। গত দু’দিনে তিস্তার ভাঙনে শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নীলফামারী : পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি শুক্রবারও ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বানপাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দেওয়ায় ওই এলাকার ২ হাজার পরিবার ও ডিমলা উপজেলার চরখরিবাড়ি এলাকার স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি হুমকীর মুখে পড়ায় ওই চরে বসবাসকৃত ৩ হাজার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৗশলী আব্দুলাহ আল মামুন জানান, উজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারনে আমরা সর্তকাবস্থায় রয়েছি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে নদ-নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব এলাকার অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে গ্রামীন রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, শাক সবজিসহ আমন বীজতলা। পানি বাড়ার সাথে সাথে নদ-নদীর ভাঙন তীব্ররুপ ধারণ করছে। তিস্তার ভাঙনে থেতরাই, বিদ্যানন্দ, ধরলার ভাঙনে কালুয়ারচর, ধনিরাম, ভোগডাঙা, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে হাতিয়া, জোড়গাছসহ কয়েকটি এলাকায় গত ৩ দিনে শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানায়, গত ৩০ ঘণ্টায় ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে ৫৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্রের পানি নুন খাওয়া পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জ : টানা বৃষ্টিপাতে ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া সরকারি হিসাবে বন্যায় সুনামগঞ্জের প্রায় ১৩ হাজার ১০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক ভ‚ইয়া বলেন, বর্তমানে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় ১৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে এই বৃষ্টি আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।

সাতকানিয়া : চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত শুক্রবার লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্ধি হয়েছে পৌরসভা সহ উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে অধিকাংশ রাস্তা তলিয়ে গেছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে বাজালিয়া ইউনিয়নের মীর পাড়ায় সাঙ্গু নদীর বাঁধের উপর দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। বান্দরবান সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

উলিপুর (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রামের উলিপুরে ৮ ইউনিয়নের ৪৯টি গ্রামের প্রায় ১১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেইসাথে আমন বীজতলা, পাটক্ষেতসহ শাকসবজি পানির নীচে তলিয়ে গেছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপূত্র নদের অব্যাহত ভাঙ্গনে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে অর্ধশতাধিক বাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে।

পীরগাছা (রংপুর) : রংপুরের পীরগাছায় অস্বাভাবিক হারে পানি বেড়েছে তিস্তা নদীতে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিতসহ দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। বারবার নদী ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলো এখন আশ্রয় হারিয়ে অন্যের ভিটায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে। স্থানীয়ভাবে কাজকর্ম না থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন