শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আদালতে আসামি খুন

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এজলাসে এক আসামির উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে আরেক আসামি নিহত হয়েছেন। ছয় বছর আগের একটি হত্যা মামলায় জামিনে থাকা আসামিরা হাজিরা দিতে এসে আদালতের এজলাসে বিচারকের সামনেই ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় আদালত পাড়ায় হুলুস্থুল ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ফারুক এবং হত্যাকারী হাসান পারিবারিক আত্মীয়তার সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো ভাই বলে জানা গেছে। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার কান্দি গ্রামের হাজী আব্দুল করিম হত্যাকান্ডের শিকার হন। এমনিতেই দেশে জননিরাপত্তার সংকট একটি বড় ধরনের সামাজিক সংকট হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সে সংকট এখন আদালত প্রাঙ্গণকেও স্পর্শ করেছে, এমনটা হয়তো কারো ধারণায় ছিল না। আদালত বিচারের স্থান। দাগী আসামি, বিচারপ্রার্থী, মামলার সাক্ষি, আইনজীবী, বিচারক এবং অভ্যাগত সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব হলেও আদালতে প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে দেশের আদালতগুলোতে বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিচার প্রার্থী ও আসামিদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার এক বড় নজির এটি।

আদালতের অভ্যন্তরে এবং আদালত পাড়ার নিরাপত্তার ঘাটতি কোনো নতুন ইস্যু নয়। ইতিপূর্বে ২০১৭ সালে প্রধানবিচারপতির পক্ষ থেকেও দেশের সকল আদালত প্রাঙ্গণ, বিচারকদের এজলাস, বাসভবন এবং আইনজীবীসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ ও উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। তবে অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত বছর মানহানি ও রাজনৈতিক মামলায় আটক দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট্য নাগরিক আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হয়েছিলেন। কুষ্টিয়ার আদালতে একটি মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও পেশাজীবী নেতা মাহমুদুর রহমান মামলার বাদি ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে রক্তাক্ত হামলার শিকার হন। লেখিকা মাসুদা ভাট্টির মানহানির মামলায় আটক হয়ে তত্ত¦¦ধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ডেইলি নিউ নেশন পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন রংপুর আদালতে সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। বলাবাহুল্য, রজনৈতিক কারণে এসব হামলাকারিদের কোনো বিচার বা জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। দেশের বিশিষ্ট্য নাগরিকদের বিরদ্ধে দায়ের করা এসব মামলার সাথে আইনের শাসনের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় পুলিশের অতি উৎসাহের পাশাপাশি সরকারী দলের নেতাকর্মীদের আদালত পাড়ায় সন্ত্রাসী ভ’মিকায় অবর্তীণ হওয়ার ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার নিরাপত্তাকেও বড় ধরণের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

কুমিল্লায় আদালত প্রাঙ্গনে এক আসামির ছুরিকাঘাতে আরেক আসামি খুনের ঘটনা জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত: আদালতের এজলাসে আসামির হাতে ধারালো অস্ত্র এলো কিভাবে? একাধিক মামলার বিচারকার্য চলার সময় এজলাস ও আদালতকক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা। প্রথমে এজলাসে ছুরিকাঘাত প্রাপ্ত আসামি প্রাণ বাঁচাতে বিচারকের খাস কামরায় আশ্রয় নেয়ার পর সেখানে গিয়েও তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আদালতকক্ষে কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কিনা। ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যেই পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তে দোষি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব। আলোচিত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা ৬ বছর আগের একটি ফৌজদারি হত্যা মামলার আসামি। আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে আসাযাওয়া ও মামলার হাজিরা দিলেও হঠাৎ করে একজন আরেকজনের উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার পেছনে মামলা নিস্পত্তিতে দীর্ঘসুত্রিতা এবং পুলিশি তদন্তের দুর্বলতার দায় এড়ানো যাবে না। দেশের আদালত পাড়া জননিরাপত্তা ও সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরের কিছু নয়। সামগ্রিক অর্থে দেশে আইনের শাসন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেই কেবল এ ধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। মানুষ তার ঘরে, কর্মস্থলে, রাস্তায় যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিরাপত্তা হেফাজত’ বা আদালত প্রাঙ্গনেও নিরাপদ নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি এক সময় আস্থাহীন হয়ে উঠতে পারে। এ ধরণের পরিস্থিতি কারোই কাম্য নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন