‘ছাওয়াল’ এরশাদের নামাজে জানাজায় গতকাল রংপুর শহর জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। নেমেছিল সাদা পাঞ্জাবী ও সাদা টুপি পরিহিত মানুষের ঢল। রংপুর শহর ছিল নীরব নিঃস্তব্ধ। বন্ধ ছিল অফিস, মার্কেট-দোকানপাট। লাখো মানুষের অংশগ্রহণে চতুর্থ জানাজা শেষে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নগরীর দর্শনাস্থ তাঁর বাসভবন ‘পল্লী নিবাস’এর লিচু তলায় কবর দেয়া হয়। জানাজার পর তার লাশ ঢাকায় এনে বনানীস্থ সেনা কবরস্থানে দাফন করার কথা থাকলেও রংপুরের মানুষের আবেগ এবং প্রাণের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে রংপুরেই এরশাদকে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রংপুরের মানুষের কাছে এরশাদ শুধু একটি নামই নয়, প্রতিষ্ঠান একটি ইতিহাস। এই ‘হামার ছাওয়াল এরশাদ’ এর জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিতে রংপুরের হাজার হাজার মানুষ প্রস্তুত থাকেন। ’৯০ এর রাজনৈতি ক পট পরিবর্তনের পর রংপুরের মানুষ এরশাদকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। প্রতি নির্বাচনে এরশাদকে ভোট দিয়ে হৃদয়ের ‘ভালবাসা’র নজীর রেখেছেন। সেই এরশাদের মৃত্যুর পর তাকে অন্য কোথাও সমাহিত করা হোক রংপুরের মানুষ চায়নি। তাই এরশাদকে রংপুরে দাফন করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেন। কালেক্টরেট মাঠে জানাজায় এসে মানুষ রোমন্থন করেন এরশাদের শাসনামলে ১৯৯০ সালে তাঁর মা মজিদা খাতুনের নামাজে জানাজার স্মৃতি। প্রায় ৩০ বছর আগে মায়ের জানাজায় যেমন লাখো মানুষ এসেছিলেন; তেমনি পুত্র এরশাদের জানাজায় লাখো মানুষ হাজির হন। এরশাদের লাশ দেখে অতীতের স্মৃতির মতো আবেগ ধরে রাখতে পারেননি মানুষ। অকেকেই হাউ-মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। একদিনে এরশাদের লাশ রংপুরের দাফনের দাবির গগণ বিদারী আওয়াজ; অন্যদিকে কাঁন্নার হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মানুষের এই আবেগ দেখে জিএম কাদের বলেছেন, আমরা রংপুরের মানুষের আগের কাছে হেরে গিয়েই পল্লীবন্ধু এরশাদকে রংপুরেই কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রওশন্ এরশাদও রাজী হয়েছেন।
মূলত রংপুরের মানুষের ভালবাসা আর প্রাণের দাবির বিজয় হয়েছে। দলের যারা এরশাদের ‘কবর’ ঢাকায় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা যে ভুল এবং রংপুরের মানুষের কাছে এরশাদের অবস্থান বুঝতে বার্থ সেটা বোঝা যায়। এরশাদকে কবরস্থ করা নিয়ে রংপুরের মানুষের কঠোর অবস্থানের সিদ্ধান্ত যথার্থ এবং সঠিক সেটা জাপার সিনিয়র নেতারা পরে বুঝতে সক্ষম হন। ফলে রওশন এরশাদ বাধ্য হয়েই গণমানুষের নেতা এরশাদের কবর রংপুরে দেয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন।
মূলত গতকাল মঙ্গলবার বাদ যোহর রংপুর কালেক্টরেট মাঠে জানাজা শেষে গণমানুষের চাপের মুখে ঢাকায় দাফনের পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সেনাবাহিনী ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে ‘পল্লী নিবাস’-এর লিচু বাগানে এরশাদের রোপনকৃত লিচু গাছের নিচে কবরে এরশাদকে দাফন করা হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের সময় দলীয় নেতাকর্মী এবং এরশাদ ভক্তরা কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পল্লী নিবাস’সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় কাঁন্নার রোল পড়ে যায়। কবরে নেয়ার পূর্বে লাশবাহী গাড়ি থেকে প্রিয় এরশাদের কফিন বের করার সাথে সাথেই দলীয় নেতাকর্মীরা হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলেন। যেন রংপুরের বাতাস হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। হৃদয় বিদারক দৃশ্যের মধ্যেই প্রিয় নেতাকে আরেক নজর দেখার জন্য আবারো হুমড়ি খেয়ে পড়েন শোকাহত হাজারো মানুষ। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের কঠোর তত্ত্বাবধানে যথাযথ মর্যাদায় দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়। এতে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগন অংশ নেন। পরে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে দলীয় নেতাকর্মীসহ হাজার হাজার মানুষ কবরে কেউ মাটি দেন; কেউ মাটি স্পর্শ করেন।
এর আগে প্রিয় নেতা এরশাদকে শেষবারের মত দেখতে এবং শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকেই কালেক্টরেট মাঠে জড়ো হতে থাকেন নারী পুরুষসহ লাখ লাখ জনতা। সকাল থেকেই উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন থেকে লোকজন কালেক্টরেট মাঠে আসতে থাকে। দুপুর ১২টা নাগাদ কানায় কানায় ভরে যায় ঐতিহাসিক কালেক্টরেট মাঠ। জনসমুদ্রে পরিণত হয় কালেক্টরেট মাঠ এবং তার আশপাশের এলাকা। থমকে যায় রংপুর শহরে সব কার্যক্রম। মার্কেট, দোকান বন্ধ করে অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা অফিস রেখেই কালেন্টরেট মাঠে হাজির হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হেলিকপ্টারযোগে এরশাদের লাশ নিয়ে আসা হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেখান থেকে লাশবাহী গাড়িতে করে লাশ নিয়ে আসা হয় কালেক্টরেট মাঠে। আকাশে হেলিকপ্টার দেখেই লোকজন হুমড়ি খেয়ে দৌড়াতে থাকে কালেক্টরেট মাঠের দিকে। দুপুর সোয়া ১২টায় তার লাশ কালেক্টরেট মাঠে নিয়ে আসা হলে শোকাহত জনতা কঠোর নিরাপত্তা এবং পুলিশী বেষ্টনী ভেঙে লাশবাহী গাড়ির দিকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো ছুটতে থাকেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী ও মাথায় সাদা টুপি পরিহিত মানুষের শ্রোথ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সকল বাধা উপেক্ষ করে এরশাদ ভক্তরা ভীড় করতে থাকে লাশের কাছে। উপচে পড়া ভিড়ের মাঝে শুরু হয় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ, ও তাদের অঙ্গ সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। এসময় দলীয় নেতাকর্মীরা এরশাদের লাশ রংপুরে দাফনের জন্য শ্লোগান দিতে থাকেন।
এরশাদের কবর ঢাকায় দেয়া হবে দলীয় এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করতে সোমবার সন্ধ্যার মধ্যেই পল্লীনিবাসে তার কবর প্রস্তুত করে রাখা হয়। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা নিজেই কবর খোঁড়া কাজের তদারকী করেন। দলীয় নেতাকর্মী ও এরশাদ প্রিয় রংপুরবাসীর দাবী তাকে রংপুরেই দাফন করতে হবে।
নামাজে জানাজার আগে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়রম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বক্তব্য দেন। এ সময় জিএম কাদের এরশাদের লাশ ঢাকায় দাফনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই বাঁধার মুখে পড়েন। তিনি বলেন, যেহেতু এরশাদের দাফনে বিদেশী বিশিষ্টজনরাও উপস্থিত থাকবেন সে জন্যই ঢাকায় লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। উত্তেজিত জনতা তার বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে মুর্হুমুহু শ্লোগান দিতে থাকে। পরে মশিউর রহমান রহমান রাঙ্গা বক্তব্য দিতে গেলে তিনিও বাধার মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বক্তব্যের শুরুতে এরশাদের লাশ রংপুরে দাফনের কথা বললে তাকে সমর্থন করে শ্লোগান দিতে থাকেন উপস্থিত লাখো জনতা। তিনি এরশাদের লাশ পল্লী নিবাসে নেয়া হবে বলেও জানান। যোহরের নামাজের পর জানাজার জন্য দাঁড়াতে বলা হলে লক্ষ লক্ষ জনতা সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। কালেক্টরেট মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় লোকজন পার্শ্ববর্তী রাস্তাাগুলোতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে যান। জানাজায় ইমামতি করেনে রংপুর করিমিয়া নুরুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহম্মদ ইদ্রিস আলী। জানাজায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলার জাতীয় পার্টির বিভিন্ন, উপজেলার নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ দলমত নির্বিশেষে লাখো লাখো জনতা অংশ নেন। জানাজা শেষে নিথর-নিস্তব্ধ এরশাদকে নিয়ে লাশবাহী গাড়িটি ঢাকায় ফেরত আনার লক্ষ্যে সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার চেষ্টা করলে জাপা মহানগর সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা গাড়িতে উঠে যান। এ সময় দলীয় কর্মীসহ উপস্থিত জনতা গাড়িটি আটক করে রাখেন। অতপর গাড়িটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে তুমুল হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। প্রায় আধা ঘন্টা পর জনতার চাপের মুখে তার লাশ পল্লী নিবাস-এ দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। জনতার দাবীর প্রেক্ষিতে পল্লী নিবাস-এ দাফনের সিদ্ধান্তের কথা জানালে লাখো জনতা লাশ বহনকারী গাড়িটি নিয়ে শহরের ভিতর প্রধান সড়কটি দিয়ে পল্লী নিবাস-এ নিয়ে যায়। এ সময় নগরীর রাস্তার দু’ধারে শোকাহত জনতা দাঁড়িয়ে এরশাদকে সম্মান জানান। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্য ছাড়াও পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হন।
এর আগে প্রিয় এরশাদকে শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত নগরীর দোকান-পাট বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা।
নিজেদের কাছেই এরশাদকে
প্রিয় নেতা ‘হামার ছাওয়াল’ এরশাদকে নিজেদের জায়গাতেই রাখলেন এরশাদ রংপুরবাসী। প্রবল বাধার মুখেও তারা প্রিয় এরশাদকে রংপুর থেকে ঢাকায় নিতে যেতে দিলেন না। এর মাধ্যমে রংপুরের মানুষ আবারো বুঝিয়ে দিলেন তারা প্রিয় নেতা এরশাদকে কতো ভালবাসেন। ১৯৯০ সালে এরশাদকে ফাসির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন রংপুরের মানুষ। এর পর প্রতিটি নির্বাচনেই বিপুল ভোটে বিজয়ী করেন। জানাজা শেষে প্রিয় নেতাকে নিয়ে গাড়িটি রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিলে লাখ লাখ জনতা তা ঘিরে ধরে আটকে রাখেন।
সিএমএইচ- এ মৃত্যুর পর এরশাদকে ঢাকার বনানীর সেনা কবরস্থানে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সাধরণ নেতাকর্মীরা এরশাদের কবর যাতে সেনা কবরস্থানের বাইরে কোথাও দেয়া হয় সে দাবিতে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভের মুখে দলের মহাসচিব জানান এরশাদের কবর কোথায় হবে তা একনো চূড়ান্ত নয়। আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
রংপুরের মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা এরশাদকে রংপুর শহরে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়। সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে কবরও প্রস্তুত করা হয়। জানাজায় লাখ মানুষ আওয়াজ তোলেন এরশাদের লাশ ঢাকায় নিয়ে যেতে দেয়া হবে না। এ নিয়ে হট্রগোল হয়। জিএম কাদের সহ কেন্দ্রীয় নেতারা অনেক বনানীতে লাশ দাফনের সিন্ধান্তে অটল থাকার চেষ্টা করেও রংপুরের মানুষের আবেগের কাছে পরাজিত হন। লখো জনতার বাধার মুখে পরাজিত হয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টে তাকে রংপুরেই দাফনের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। ঢাকা থেকে রওশন এরশাদ জানান, তিনি এরশাদকে রংপুরে করব দেয়ার দাবি মেনে নিয়েছেন; তবে অনুরোধ করেন স্বামী এরশাদের পাশে তার কবরের যায়গা রাখতে হবে। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন