সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্দেশে বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ‘নাই’ (ডিসএপ্যায়ার্ড) হয়ে গেছে।’
সম্প্রতি ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ডেলিগেটরা অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে চীন, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ ১৬টি দেশের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার হওয়া মানুষদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হোয়াইট হাউসে। গত ১৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এবিসিফোর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বুধবার অভাল অফিসে বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ জন ব্যক্তির সাথে একান্তে কথা বলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প যখন একে একে সবার বক্তব্য শুনছিলেন তখন প্রিয়া সাহা নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বলেন, স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানকার ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ‘নাই’ (ডিসএপ্যায়ার্ড) হয়ে গেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে ও দেশে থাকতে পারছে না। দয়া করে বাংলাদেশি জনগণকে সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।
প্রিয়া সাহা আরো অভিযোগ করেন, তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি আইনি সুরক্ষা পাননি। নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ট্রাম্পের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি। ট্রাম্প তখন বলেন, ‘বাংলাদেশ?’ জবাবে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে বাংলাদেশি এই নারী আরও বলেন, ‘এখনও সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ থাকে। আমার অনুরোধ, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। সেখানে থাকতে আমাদের সহযোগিতা করুন। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার জমি ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনও বিচার হয়নি।’ ট্রাম্প তখন প্রশ্ন করেন কারা তোমার বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে? তখন প্রিয়া সাহা বলেন, মুসলিম মৌলবাদিরা। তারা সবাই রাজনৈতিক আশ্রয় পায় সব সময়।
জানা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রিয়া ছাড়াও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের আরো দুইজন নেতা যুক্তরাষ্ট্রে নির্যাতনের শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্মেলনে যোগদান করার সুযোগ পান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নাম চাওয়া হলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রিয়া সাহা, নির্মল রোজারিও, অশোক বড়–য়ার নাম দেয়।
এদিকে খোঁজ নিয়ে প্রিয়া সাহার সম্পর্কে আরো জানা যায়, তিনি মহিলা ঐক্য পরিষদ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার স্বামী দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক মলয় সাহা। প্রিয়া সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, রোকেয়া হলে থাকতেন। এখন একটি এনজিও আছে। বিভ্রান্তিমূলক কর্মকান্ডের জন্য গতবছর তাকে মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার নাটক করে প্রচুর বিদেশি ফান্ড কালেক্ট করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গার চরবানিরীতে।
এদিকে প্রিয়া সাহার ‘ডাহা মিথ্যা’ এমন নালিশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বইছে নিন্দার ঝড়। মুসলমানদের প্রতিবাদসহ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরাও এর প্রতিবাদ করছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি গভীল ষড়যন্ত্র। হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। তবে সামান্য একজন ব্যক্তির অভিযোগ বা নালিশের কারণে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কখনো নষ্ট হবে না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট করার জন্য একটি অংশ সব সময় ষড়যন্ত্র করে আসছে। এ নিয়ে অনেক রাজনীতিও হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সরকার খুবই সতর্ক।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে অনেকেই কমেন্ট করে নিন্দা জানায়। জাহিদুর রহমান নামে একজন লিখেন, ‘এই মহিলা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। সরকারের উচিত এই মহিলাসহ তার সাথের সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনা।’
মোবারক হোসেন মন্তব্য করেন, ‘এত বড় মিথ্যাচার! যারা আজ বাংলাদেশে চাকুরী থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই একটা অঘোষিত কোঠা পেয়ে গেছে, যারা আজকে এমপি, মন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করেছে অথচ তারাই বলছে তারা নাকি বিচার পায় না, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত! এটা দেশের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র।’
নাঈম হায়দার ভিডিওটি তার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেন, ‘ভাই শুধু এই মহিলার দোষ দিয়া লাভ নাই। কারন এইটা একটা নাটকের অংশ মাত্র। তারা সবাই এর সাথে জড়িত। তারা বাংলাদেশে কিছু একটা করার পরিকল্পনা করতাছে। আমেরিকা ভালো করেই জানে এই দেশের খবর।’
সুমন মুনশী লিখেছেন, ‘এটি একটি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। দেশের আইনে তার বিচার করা হোক।’ সাইয়্যেদ জহিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বেশি সুখে আছে তো তাই খুশির ঠেলায় পাগলের অভিযোগ। হিন্দু সমাজ বাংলাদেশে এত সুখে থেকে এত সুবিধা ভোগ করে আরও বদনাম করে, যা এই সরকারের জন্য হুমকি।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাশেদুল আলম লিখেন, ‘এরা সব ইন্ডিয়ান রক্তের বংশধর, ওদের দেহটা এদেশে থাকলেও মনটা ইন্ডিয়ায় থাকে। ওর আব্বুরা ইন্ডিয়ায় মুসলিমদের উপর নির্যাতন করতেছে, আর... মহিলা তার উল্টোটা প্রচার করতেছে।’
রোহিঙ্গা, কোথায় সেটা : ট্রাম্প
এদিকে একই অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক রোহিঙ্গাকে প্রশ্ন করেন, রোহিঙ্গা! কোথায় সেটা?’
ওই ব্যক্তি ট্রাম্পকে জানান, দু’বছর আগে মিয়ানমার সেনাদের অত্যাচারে নিজের দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে রয়েছেন বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু তারা দেশে ফিরতে চান। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিয়েছে? এরপর ট্রাম্প বলে ফেলেন, ‘এটা আসলে কোথায়?’ এরপরই তাকে জানানো হয়, বাংলাদেশ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ।’ তারপরই হয়ত বুঝতে পারেন ট্রাম্প।
প্রিয়া সাহার তথ্য সঠিক নয় : মার্কিন রাষ্ট্রদূত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে এক বাংলাদেশি সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে যে তথ্য দিয়েছেন তা সঠিক বলে মনে করেন না ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় বৌদ্ধ মন্দিরে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মিলার একথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স¤প্রদায় একে অপরকে শ্রদ্ধা করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আমার প্রথম ৮ মাসের দায়িত্ব পালনকালে আমি বাংলাদেশের আটটি বিভাগেই ঘুরেছি। মসজিদ, মন্দির ও চার্চে গিয়ে ইমাম, পুরোহিতদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আমি এসেছি একটি বৌদ্ধ মন্দিরে, আমার কাছে যেমনটা মনে হয়েছে, এখানকার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের লোকজন একে অপরকে শ্রদ্ধা করেন। তাই আমি মনে করি, তার অভিযোগ সঠিক নয়, বরং ধর্মীয় স¤প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য নাম। যদিও কোন দেশই সংখ্যালঘুদের অধিকার দিতে সফলতা পায়নি। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের প্রধান ইস্যুগুলো কী তা যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই জানে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন