বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দুগ্ধ খামারিদের রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০০ এএম

ধান উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কৃতিত্ব মূলত দেশের কৃষক এবং কৃষি গবেষকদের। সেই সাথে মৎস্য, হাস-মুরগি, গরুর খামার ও দুগ্ধ উৎপাদনেও দেশের কৃষক ও খামারিরা রীতিমত বিপ্লব সাধন করেছে। ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হওয়ার পরও কোরবানির ঈদে গরুর যোগান এবং সারা বছর গোশতের চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম হয়েছে দেশের খামারিরা। সেই সাথে দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রি উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল। বোরো-আমনের ভরা মওসুমে ভারত থেকে চাল আমদানির মধ্য দিয়ে যেমন ধান-চালের মূল্যে ধস নামিয়ে কৃষকদের লোকসানের মুখে ফেলে দেশে ধান উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, একই ভাবে বিদেশ থেকে গুঁড়াদুধ আমদানির সুযোগ অবারিত রেখে বিকাশমান দেশীয় ডেয়ারি শিল্পকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। খামারিদের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বছরও বাজেটের আগে গুঁড়াদুধ আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে দেশিয় দুগ্ধ শিল্প রক্ষার দাবীতে মানব বন্ধন করেছিল উত্তরাঞ্চলের দুগ্ধ খামারিরা। এখন আরো অনাহূত প্রকট সংকটের মুখে পড়েছে দেশের দুগ্ধশিল্প। ভেজাল খাদ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেশের প্রায় সবগুলো ব্র্রান্ডের তরল দুধে ক্ষতিকর রাসায়নিক, ব্যাকটেরিয়া ও এন্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পেয়েছেন অনুসন্ধানকারি বিশেষজ্ঞরা। এ প্রেক্ষাপটে মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ংসহ দেশের ১৪টি কোম্পানির দুগ্ধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই নির্দেশনার পর কোম্পানিগুলোর দুধ ক্রয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে কৃষক ও খামারিরা।

খাদ্যে ভেজাল এবং রাসায়নিক দূষণের ঝুঁকি কোনো নতুন বিষয় নয়। এ থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। তবে এ সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা হয়তো সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরেই কোম্পানীগুলো দুধ উৎপাদন ও বিপণন করে আসছে। এ মুহূর্তে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ডেয়ারি ফার্মের সাথে যুক্ত বলে জানা গেছে। ডেয়ারি ফার্মে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এবং দুগ্ধজাত পণ্যের যোগান হঠাৎ করে চরম হুমকির মুখে পড়ে এমন যে কোন সিদ্ধান্ত প্রকাশ ও বাস্তবায়নের আগে এসব বিষয় অবশ্যই ভাবতে হবে। খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক দূষণ অবশ্যই ঠেকাতে হবে। তবে খাদ্যের উৎপাদন ও যোগান বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার মধ্যে কোনো সমাধান নেই। দুধে যে সব রাসায়নিক, ব্যাকটেরিয়া ও এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে উৎপাদিত পশুখাদ্য আমদানিকৃত ও ভেটেরিনারি চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দুধে এসব উপাদান ঢুকে যাচ্ছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। পশুখাদ্য উৎপাদন ও ভেটেরিনারি চিকিৎসার কারণে সৃষ্ট বিরূপ প্রভাবের দায় সাধারণ খামারি বা কৃষকদের উপর বর্তায় না। তবে এ কারণে দুগ্ধ খামারি ও শিল্পের সাথে যুক্ত লাখ লাখ বিনিয়োগকারি, কৃষক ও শ্রমিকের রুটি-রুজির উপর আঘাত কোনোভাবেই কাঙ্খিত নয়।

কয়েক বছর আগে চীন থেকে আমদানিকৃত গুড়ো দুধে ক্ষতিকর মেলামাইনের উপস্থিতি ধরা পড়েছিল। তবে সাধারণভাবে দুধসহ আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের যথাযথ পরীক্ষণ ও মাননিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আমদানিকৃত দুধে কি ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকতে পারে তা আমাদের জানা নেই। দেশীয় দুগ্ধ শিল্পের বিকাশের ফলে দুধ আমদানি কমে আসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মহল নিজেদের ব্যবসায় চাঙ্গা করতে পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের পেছনে কারসাজির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। খোদ প্রধানমন্ত্রীও এই আশঙ্কা ব্যাক্ত করেছেন। ঢাকা ওয়াসার অধিকাংশ জোনেই পানিতে নানা ধরনের ভারী ধাতব ও রাসায়নিকসহ পানির মান অত্যন্ত খারাপ। মহামান্য হাইকোর্ট এ কারণে সংশ্লিষ্টদের কারণ দর্শানোসহ নানা উদ্যোগের নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে ওয়াসার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেননি। এটা সমীচীনও নয়। একইভাবে প্রকৃত কারণ ও মাত্রা নিরুপণ ছাড়া আকস্মিক নির্দেশে বেশিরভাগ ব্রান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের নেতিবাচক দিকগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্তে শুধু দুগ্ধশিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানেও ধস নামতে পারে। যে সব কারণে গরুর দুধে ক্ষতিকর রাসায়নিক, এন্টিবায়োটিকের মত উপাদান ঢুকে যাচ্ছে, আগে তা নির্ণয় করতে হবে। অত:পর দুষণ ও ভেজাল মুক্তির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ইতমধ্যে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করে তিনটি কোম্পানীর দুগ্ধ উৎপাদনের বাধা দূর হয়েছে। আশা করা যায়, বাকি কোম্পানীগুলোও অনুরূপ সুযোগ পাবে। তবে পাস্তুরিত দুধের কথিত দূষণ মুক্তির প্রয়াস সম্মিলিতভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। দেশীয় দুগ্ধশিল্পের বিকাশ নিশ্চিত ও অবারিত রাখতে প্রয়োজনে প্রণোদনা ও ভতুর্কি দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন