শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

নানুর বাড়ি অনন্তপুর

আ হ মে দ উ ল্লা হ | প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কলিংবেলে চাপ দিয়ে দরজার পাশে দাঁড়াল মুসাফির। অফিস ছেড়ে বাসায় এসে কলিংবেল চাপলেই মুসাফিরের চার বছরের মেয়ে সতী এসে দরজা খুলে। ঘরে ঢোকার আগেই দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ায় মেয়েটি, কী এনেছো বাবা? আগে হাতে দাও, এরপর ঘরে ঢোকবা।
অফিস থেকে ফেরার পথে মেয়েটির জন্য বিভিন্ন কিছু নিয়ে আসে মুসাফির। চকলেক, আইসক্রিম, হালীম, মোগলাই ইত্যাদি; মেয়েটির হাতে দিয়ে কোলে নিয়ে চুমো খেতে খেতে ভেতরে প্রবেশ করে মুসাফির।

কিন্তু আজ একি হলো, কেউ দরজা খুলছে না কেন? এমন ভাবতে ভাবতেই মিনিট পাঁচেক পর দরজা খুলে এসে দাঁড়াল ওর স্ত্রী পাপড়ি। মেয়েকে না দেখে মুসাফির বলে, সতী কই? ওর শরীর কি ভালো নেই?
শরীর ভালো, মন খারাপ। ভেতরে এসে দেখো- মেয়ে কী মুখভার করে বসে আছে।
কেন কী হয়েছে ওর? বলেই ভেতরঘরে ঢোকে মুসাফির।

পাশের ফ্ল্যাটের আঞ্জুর মা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে, এর পর থেকেই নানুর বাড়িতে বেড়াতে যাবার জন্য কান্না শুরু করে সতী। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না; বলো তো কী করি এখন?

দ্রুত মেয়েকে কোলে তুলতে গিয়ে মুসাফির বলে, মা আমার, কী হয়েছে তোমার? লক্ষèী সোনার মুখ এমন ভার হয়ে আছে কেন?
বাবাকে দেখে তার জেদ আরো বেড়ে গেল। বসা থেকে ওঠে জানালার সামনে গিয়ে বসে বাহিরে তাকিয়ে থাকল! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আইসক্রিমটি হাতে দিয়ে মুসাফির বলে, দেখো তোমার জন্য আইসক্রিম এনেছি।
আইসক্রিমটি হাতে নিয়েই ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে সতী, আমি আইসক্রিম খাবো না, নানুর বাড়ি যাব। আমাকে এখনই নানুর বাড়িতে নিয়ে যাও।
মেয়েকে কোলে নিয়ে স্ত্রীকে ডেকে মুসাফির বলে, পাপড়ি, এই পাপড়ি
তুমি কোথায়? আগামীকাল সতীকে নিয়ে অনন্তপুর চলে যাবে, বুঝলে!
কিচেন রুম থেকে জবাব এলো- ঠিক আছে যাব।

রাতের খাবার খেতে বসে পাতে ভাত তুলে দিয়ে পাপড়ি বলে, চলো না দু-এক দিনের সময় করে মেয়েটিকে নিয়ে অনন্তপুর থেকে ঘুরে আসি। ক’বছর হয়ে গেল গ্রামে যাওয়া হয় না! মাকে দেখার জন্য মনটাও আনচান করছে!
মুখে ভাত পুরে দিয়ে মুসাফির বলে, এখন পুরো বর্ষাকাল! গ্রামের চারদিকে পানি; এখন যাওয়া কি ঠিক হবে! সতী তো সাঁতার জানে না।
গ্রামের যাবার কথা বললেই, না যাবার পক্ষে তুমি কারণ দাঁড় করাও; মেয়েটি যখন এমন পাগলামি শুরু করে দিয়েছে, চলো কয়েকটা দিনের জন্য হলেও ঘুরে আসি; তোমার রাগ কি এখনো কাটেনি?

অফিসে কাজের খুব চার, বরং পাপড়িকে নিয়ে কদিনের জন্য তুমিই গিয়ে বেড়িয়ে এসো।
মুসাফির আট বছর যাবৎ শ্বশুরবাড়ি যায় না। পারিবারিক পছন্দেই পাপড়িকে বিয়ে করেছিল ও। বিয়ের বছরখানেক অতিবাহিত হবার পর অজানা কারণে বাক-বচসা হয়েছিল শ্বশুরের সঙ্গে? এরপর থেকেই ওর শ্বশুর পণ করে বসে আছে যে, যতদিন না মুসাফির গিয়ে শ্বশুরের সামনে ‘সরি’ বলবে, ততদিন ওই বাড়ি থেকে কেউ আসবে না; এদিকে মুসাফিরও জেদ ধরে বসে আছে, যতদিন না শ্বশুর এসে ভুল স্বীকার করবে, ততদিন সে-ও ওদের বাড়ি যাবে না। দুদিকের এমন জেদের বয়স আট বছর, অথচ কেউ কারো কাছে হার মানেনি।

কুমিল্লার অনন্তুপুর পাপড়ির বাপের বাড়ি। তিতাসের পশ্চিমপারে ছায়াঢাকা শ্যামল, শান্ত ছবির মতো গ্রামটি; দক্ষিণে ফসলের মাঠ, প্রতি ঋতুতে নতুন রূপে সাজে গ্রামটি; বর্ষায় অনন্য রূপে সাজে অনন্তপুর; মনে হয় যেন জলের ওপর ভাসছে একটি সবুজ গ্রাম...
জলেঢাকা ফসলের মাঠে ফোটে শাপলা, শালুকের পানা ভেসে থাকে পানির ওপর ছাতার মতো ছড়িয়েছিটিয়ে; মাছের আনোগোনা বেড়ে যায়, সাপ-ব্যাঙসহ আরো কত যে জলজ প্রাণি...
নানুর বাড়িতে বেড়াতে এসে সতী মেতে উঠেছে মুক্তানন্দে! নাওয়া-খাওয়া ভুলে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় দশ বছরের মাসতুতো ভাই নিলয়ের সঙ্গী হয়ে।

সতীর নানা ওয়াছেক ভূইয়ার বাড়ির পেছনেই একটি পোড়ো পুকুর।
পুকুরের পাড়গুলো বিবিধ গাছ-গাছালিতে আবৃত; কদম, হিজল, শেওড়া; বেশিরভাগ জায়গাই বাঁশবাগানের দখলে। বর্ষার শুরুতেই কদম গাছগুলো ফুলে ফুলে সাজে। নিলয় গাছে ওঠে কদমফুল পেড়ে দেয় সতীকে। শুভ্র কোমল কদমফুল হাতে পেয়ে কিশোরী সতীর মন আনন্দে আত্মহারা!

পুকুড়ের পশ্চিম কোণে বৃদ্ধ হিজল গাছটির বয়স কেউ জানে না। গোরু-ছাগলের ঘাস কাটায় ব্যবহৃত নৌকোটি লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে হিজল গাছটিতে। গাছটিতে নৌকোটি তালাবদ্ধ করে চাবিটি নিয়ে রেখে দেয় গোয়ালের খুটির তারকাটায় ঝুলিয়ে। বাড়ির অবাধ্য শিশুদের ঘুম পাড়ানো কিংবা দুষ্টুমি থামাতে ওই হিজল গাছটির ভয় দেখায়, বলে-হিজল গাছের ভুতটি এক্ষুণি এসে নিয়ে যাবে।

বর্ষায় এলাকায় নৌকো চুরির হিড়িক পড়ে যায়। গত কবছর আগে মির্জানগরের হোড়ন মাঝির নৌকোটি চুরি হয়েছিল। চুরি করেছিল একজন শিক্ষিত চোর। নৌকোটি তালাবদ্ধই ছিল বটে। তালা ভেঙে নৌকোটি নিয়ে যাবার সময় একটি চিরকূটে চোর লিখে গিয়েছিল- তালায় কি নৌকা রাখে, কাবিনে কি বউ রাখে?।

হোড়ন মাঝির মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে! ওর ঘরের উনুনে আগুন ধরানোর একমাত্র ভরসা ওই নৌকোটি। বাজারে বাজারে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়ায় নৌকোটি। বহু সুলুকসন্ধানের পর নৌকো খুঁজে পেল রামচন্দ্রপুর বাজারে। হাতেনাতে চোরকে ধরে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসেছিল রামচন্দ্রপুর বাজার ঘাটে।
রামচন্দ্রপুর এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার। মঙ্গলবার হাটের দিন। মানুষ জড়ো হয় হোড়নের হল্লাচিল্লায়। খবর পেয়ে বাজার কমিটির লোকজন সালিশ করে নৌকোটি হোড়নের হাতে ফিরিয়ে দেয়। চোরকে সামান্য উত্তমমাধ্যম দিয়ে বিদায় করে দেয়।
বিলের পানিতে শাপলা ফোটেছে শোনে, শাপলা কুড়োতে ব্যগ্র হয়ে উঠে সতী। কাউকে না জানিয়ে গোপনে চাবিটি নিয়ে নৌকোর তালা খুলে নিলয়। সতীকে নৌকার মাঝমধ্যে বসিয়ে পাটাতনে বসে লগি হাতে নেয় নিলয়। নিলয় নৌকা বায়, সতী বসা থেকে ওঠে কখনো পানিতে হাত
দেয়, কখনো ভাসমান শাপলা টেনে তুলে।

ঈশ্বরপুরের পাশ ঘেঁষে যাবার সময় বিলের ঢেউয়ে নৌকাটি দুলুনি খায়। ডুবে যাবার ভয়ে পাটাতনের কাঠে শক্ত করে ধরে কেঁদে ওঠে সতী। ত্বরিত নৌকা তীরে ভিড়ানোর জন্য তাগিদ দেয় নিলয়কে। ঢেউকে নৌকার মাথা দিয়ে মোকাবেলা করে এগোয় বিলের দিকে।
গতবছর উত্তাল ঢেউ গর্জেছিল হাভাতীয়ার বিলজুড়ে। বিলের মাঝমধ্য দিয়ে কেউ নৌকা নিয়ে যাবার সাহস পায়নি। দখিনা বাতাসে ঢেউয়ের গর্জনে মৎসজীবিরাও তটস্থ হয়ে থাকে। একাধিক নৌ-ডুবির ঘটনা ঘটেছিল সে-বছর; মারাও গিয়েছিল একজন।
শক্তহাতে লগি ধরে সাবধানে বিলটি পেরুয় নিলয়। ঢেউকম্পিত এলাকা ছেড়ে কাশীপুরের কাছাকাছি চলে যায় ওরা। কাশীপুরের সামনের ঢেউহীন আমন খেতের ধারে ধারে ফুটে আছে শাপলারা দল বেঁধে। ধানহীন জমিগুলো শাপলা-শালুক দখল করে আছে। এখানকার শাপলার পাপড়িগুলো আশপাশের মানুষকে ডেকে নেয় কাছে। রাশি রাশি শাপলা শালুকের পানা ভেসে থাকতে দেখে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সতী! সে মোটা কচি শাপলা টেনে তুলছে। নিলয় লগি হাতে নৌকা বেয়ে সামনে এগোয়। মাঝেমধ্যে দু একটা কচি শাপলার চামড়া ছাড়িয়ে মুখে পুরে দেয় সতী, আহ্! কী মজা!

দিনান্তের আবছা অন্ধকার নেমে আসার সময় গুনছে; ওদের খেয়াল নেই সেদিকে। শাপলা কুড়োবার নেশায় মজে আছে দুজন। সূর্য ডুবে যাবার পথ ধরেছে দেখে নিলয় গ্রামের দিকে নৌকা বাইতে থাকল। বাড়িতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার পর মায়ের বকুনি হজম করতে হয়েছে ওদের।
এমন বিমুক্ত আনন্দে কয়েকটি দিন যেন সতী কাটিয়েছে কোনো নন্দন কাননে। শহরে ফিরে যাবার দিন মাকে জড়িয়ে সতী বলে, আম্মু, আমি ঢাকায় যাব না, ঢাকায় আমার ভাল্লাগে না।
মেয়েকে বুকে রেখেই মুচকি হেসে পাপড়ি বলে, ঢাকায় না গেলে, তোমার পড়াশোনা হবে কি করে।
আমি নানুর বাড়িতে থাকব; নিলয় ভাইয়ার সাথে এখানে পড়ালেখা করব, মাদ্রাসায় ভর্তি হব।
নিলয় অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসায় পড়ে, তৃতীয় শ্রেণিতে। পড়ালেখায়

বরাবরই গয়ংগচ্ছ ভাব। তবে, দুষ্টুমিতে একদম পুরো হাফেজ। এখনো শুদ্ধভাবে বর্ণমালা উচ্চারণ করতে না পারলেও, কীভাবে শেওড়া গাছের কোটরে কনুই অবধি হাত ঢুকিয়ে দোয়েলের বাচ্চাটিকে বের করে আনতে হয় মা পাখিটিকে কাঁদিয়ে, তা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে ও। মনে চাইলে মাদ্রাসায় যায়, ইচ্ছে না হলে যায় না। নিলয়ের পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মা কারোই তেমন তাগিদ নেই।
সতীর কথা শোনে হকচড়িয়ে ওঠে পাপড়ি। মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে, এ কথা বললে হবে না মা, যাও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও; অনেক দুষ্টুমি করেছো এ কদিন।

আজকের দিনটা থেকে যাও, কাল আমরা চলে যাব।
রেগে ওঠে পাপড়ি, এক সপ্তাহ হয়ে গেল, আর কত! কিছুদিন পর তোমার পরীক্ষা। এখানে এভাবে থাকলে, পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না তুমি।
মায়ের কোল থেকে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে নিয়ে সে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল গোয়ারের কোণে। বাড়ির সকলে মিলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। দিনভর গ্রামময় খুঁজেও পাওয়া যায়নি। সকলের মনে শঙ্কা! কোথায় গেল সতী? চারদিকে বর্ষার পানি, সতী সাঁতার জানে না। গেল কউ ও?

সাঁতার না-জানায় বর্ষায় গ্রামের বহু শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। দু বছর আগে অনন্তপুর পূর্বপাড়ার জয়নাল মিয়ার তিন বছরের ছেলেটি পানিতে ডুবে মরে। খেলতে খেলতে বাড়ির সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কখন যে বাড়ির পেছনদিকের পানিতে পড়ে যায়, কেউ টের পায়নি। পানিতে ডোবার পরও কেউ জানতে পারেনি; দুদিন পর যখন শরীর ফোলে ভেসে ওঠে, তখন সকলে গিয়ে পানি থেকে তোলে আনে।
কান্নায় মুষড়ে পড়ে জয়নার ও তার স্ত্রী। ওই ছেলেটি হারানো দুঃখ আজ অবধি ভুলতে পারেনি ওরা। ছেলেটি দেখাশোনায় ছিল যেমন সুন্দর, তেমনি নাদুসনুদুস।

সকলের শঙ্কার মধ্যে সন্ধ্যার পর আচমকা চুপিচুপি ঘরে ঢোকে সতী। মেয়েকে দেখেই রেগে ফুঁসে ওঠে পাপড়ি, মারতে উদ্যত হয়। কিন্তু নানা-নানীর মায়ার দেয়াল টপকে ওকে মারতে পারেনি। ধমকিয়ে পাপড়ি বলে, আগামীকাল ভোরেই রওয়ানা হবো, আর কোনো অজুহাত চলবে না; দরকার হলে রাতেই রশি দিয়ে এই দুষ্টমেয়েকে বেঁধে রাখব যেন পালাবার সুযোগ না পায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন