শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কবিতায় বর্ষা

আ লী এ র শা দ | প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

যুগ যুগ ধরে কবি সাহিত্যিকগণ যে গল্প, কবিতা, গান নাটক লিখে আসছে তার বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রেম, প্রকৃতি ও সমাজের বিভিন্ন ঘটনা। কবি আজীবন প্রকৃতির কাছে শেখে, প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হন বারবার, প্রকৃতির প্রেমে আত্মহারা হয়ে সৃষ্টি করেন কালজয়ী সব পঙক্তি।অভিন্ন জিনিস হলেও বিভিন্ন লেখক তাঁদের কল্পনাশক্তি, যাপিত জীবন ও নিজস্ব বিশ্বাসের মিশ্রণে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা ফুঁটিয়ে তুলেন।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায় এই ছয়টি ঋতুর বর্ণনা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, তবে সবচেয়ে বেশি, যে ঋতু দুটির কথা আবেগঘনভাবে উচ্চারিত হয়েছে তা হলো বর্ষা এবং বসন্ত ঋতু।

প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ পেরিয়ে বর্তমান উত্তরাধিনুক এই সময়ের কবিদের কবিতায়, গানে বর্ষার বর্ণনা মূর্ত হয়ে উঠেছে চিরকালীন বিষয় হিসেবে।

বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বতন্ত্র। বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়, বেদনাময়। বর্ষা নবজীবন এবং বিরহ দুইয়েরই প্রতীক। বর্ষার রূপ, রস, গন্ধ অন্য যেকোনো ঋতুর থেকে পৃথক। বর্ষা মানুষের মনোজগতকে নাড়া দিয়ে যায়। প্রাচীনযুগের মহাকবি কালিদাসের কবিতার অনুবাদের অংশবিশেষ পড়লে আমরা তার বর্ষা নিয়ে মননের অভিব্যক্তি বুঝতে পারব।

কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/যক্ষ অতএব কুড়চিফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।

কালীদাস তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহকাতর ‘যক্ষ মেঘ’কে দূত করে কৈলাসে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সেই বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহকাতর চিত্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে।
মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনার উলে­খ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কবি জয়দেবের কবিতায় বর্ষা
র সন্ধান মেলে। তাছাড়া কবি চণ্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণকীর্তনে রয়েছে বর্ষার উপস্থিতি। কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রায়শেখর, মনোহরদাস, বাসুদেব ঘোষ এদের প্রত্যেকের বৈষ্ণব পদাবলিতেও বর্ষার বর্ণনা রয়েছে। এছাড়াও মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয় কুমার বড়াল, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় বর্ষার সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় বর্ষার বিচিত্ররূপ বা সৌন্দর্য উঠে এসেছে।
মধ্যযুগের কবিপ্রতিভা কবিকঙ্কন উপাধিখ্যাত মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর স্ত্রী ফুল­রার বারোমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন,

আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুরে
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি
বর্ষা কবিমনকে করে সিক্ত, ঝরঝর বর্ষনে উদাসী কবি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। মনের অজান্তে সাজিয়ে তুলেন পদাবলীর একেকটি ছন্দময় পঙক্তি।

পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে এসে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‹বর্ষাকাল› কবিতায় বর্ষার রূপকে ভাবনার তুলিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে—
গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর
রমণী রমণ লয়ে সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্তরে।

আধুনিককালে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। কবিগুরুর হাত ধরেই কবিতা এবং গানের মাধ্যমে বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে।
আকাশ থেকে বৃষ্টির অবিরাম ধারা নেমে এলে কবি যেন ফিরে যান তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলিতে। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন