শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু এবং মানুষের অসহায়ত্ব

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ডেঙ্গু নিয়ে বাংলাদেশে এখন তুমুল হৈ চৈ। ডেঙ্গু আতংকে সারা দেশের মানুষ এখন আতংকিত। কে কখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হবে, তা নিয়ে দেশবাসীর উৎকন্ঠার শেষ নেই। চিকিৎসক থেকে রাজনীতিবিদ, সবাই এখন ডেঙ্গু মোকাবেলার কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত। কিন্তু কারো কোন কৌশল তেমন একটা কাজে আসছে না। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কেবল বাড়ছে। মানবজাতিকে বাচাঁনোর জন্য বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ঔষধ ডেঙ্গু দমনে তেমন একটা কাজে আসছে না। ডেঙ্গু মোকাবেলায় একসাথে কাজ করছে সবাই কিন্তু ডেঙ্গু কিছুতেই থামছে না। সে কাউকেই পরোয়া করছে না। ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান অথবা সাবমেরিন- কোনটাই কাজে আসছে না আর এর কোনটাতেই এডিস মশা ভীত নয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিংসাধীন হাজারো মানুষ। ডেঙ্গুতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসকও রয়েছে, রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। একজন চিকিৎসকও যখন ডেঙ্গুর কাছে পরাজিত, তখন আমাদের মত সাধারণ মানুষের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা সহজেই অনুমেয়। ডেঙ্গুর আক্রমণে নিহত ব্যক্তিরা আমাদেরই কারো না কারো স্বজন। স্বজন হারানোর বেদনায় পরিজনরা কান্না এবং শোকে পাথর হয়ে গেছে। আমরা শোকাহত মানুষগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের দুঃখে আমরা দুঃখিত, তাদের শোকে আমরা শোকাহত। তারা যেন এই শোক, দুঃখ এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সেই প্রার্থনাও করছি।

জ্ঞান বিজ্ঞানের এত আবিষ্কারের যুগে এডিস নামক একটি মশার আক্রমণে মানুষ মারা যাবে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু তাই এখন সত্য। অথচ মানুষের অহমিকার শেষ নেই, দাম্ভিকতার অন্ত নেই। একটু ক্ষমতা পেলেই তা নিয়ে বাহাদুরি করতে কারো কোন কমতি নেই। হয়ে ওঠে বেপরোয়া এবং যখন যা খুশি করে বেড়ায়। অন্যদিকে এডিস নামক একটি মশার কাছে মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি এখন বাস্তব জ্ঞান বিজ্ঞানে মানুষের অভূতপূর্ব উন্নতির যুগেও তারা একটি মশার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে না। সুতরাং মানুষের উচিত তার অসহায়ত্বের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা এবং গবেষণা করা। তার উচিত অহমিকা, অহংকার এবং দম্ভ পরিহার করা। তার উচিত অন্যায় কাজকে পরিহার করা এবং সত্য-ন্যায়ের পথে চলা। তার উচিত স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা এবং অতীত ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা নাহলে মানুষের জন্য দুঃখ এবং কষ্টই একমাত্র অর্জন। প্রযুক্তির কল্যাণে ডেঙ্গুর কথা মুহূর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে।

এডিস নামক একটি ক্ষুদ্র মশার কাছে যখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে এবং একে দমন করতে ব্যর্থ হয় তখন অন্য একটি বিষয় চিন্তার উদ্রেক করে। আর তা হল মানুষের ক্ষমতার সীমা, পরিসীমা এবং অসহায়ত্ব। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণি মানুষের আসলে এমনকি ক্ষমতা আছে যার কারণে যে দম্ভ করতে পারে? বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। মানুষের জন্মের ক্ষেত্রে তার হাত নেই। তার মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তার কিছু করার থাকে না। কে কখন মারা যাবে তা জানার কোন ব্যবস্থা নেই। মানুষ ইচ্ছা করলে নিজের উচ্চতা বাড়াতে পারে না। তার গায়ের রঙটাও পরিবর্তন করতে পারে না। ইচ্ছা করলেই মানুষ হাজার বছর বাচঁতে পারে না। তবু মানুষের এই সব বিষয়ে কোন ভাবনা নেই। অর্থ বিত্ত আভিজাত্যের নেশায় মশগুল। ক্ষমতার মোহে অন্ধ। জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। ঘুষের টাকা আর দুর্নীতি করে কীভাবে সম্পদ বাড়াবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একটি বাড়ি হলে চাই আরো একটি বাড়ি, একটি গাড়ি হলে দরকার আরো একটি গাড়ি। বিলাসিতার শেষ নেই, চাহিদার সীমা নেই। অথচ এই সব অর্থ, সম্পদ, আভিজাত্য এবং ক্ষমতার বাহাদুরী- সবই ছেড়ে মানুষকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। যেই সম্পদ সে অর্জন করে, সেই সম্পদই সে ভোগ করতে পারে না। এটাই অনিবার্য বাস্তবতা। মানুষ এই পৃথিবীতে অনেক কিছু বানিয়েছে, অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে এবং পৃথিবীকে অনেক উন্নত করেছে। এসবই কি মানুষের একক অবদান? নিঃসন্দেহে তা নয়। কারণ মানুষ যাই বানিয়েছে তার সবকিছুর উপাদান প্রকৃতিতেই বিদ্যমান। মানুষ কেবল চিন্তা, গবেষণা এবং পরিশ্রম করে সেটাকে ব্যবহারের উপযোগী করেছে। আমরা লোহা দিয়ে বাড়ি, বিমান, জাহাজ তৈরী করেছি। কিন্তু সেই লোহা তো মানুষ তৈরি করেনি। সেটা তো প্রকৃতিতেই ছিল। আমরা জ্বালানি তেল দিয়ে গাড়ি, বিমান, জাহাজ, কলকারখানা সবই চালাচ্ছি। সেই জ্বালানি তেল মানুষ বানায়নি। সেটা প্রকৃতিতেই ছিল। মানুষ সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির চমকপ্রদ উপাদান কম্পিউটারের চিপস এর মূল উপাদান সিলিকন তো প্রকৃতিরই অবদান। মানুষ গবেষণার মাধ্যমে সেটাকে কেবল ব্যবহার উপযোগী করেছে। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে প্রতিটি জিনিসই প্রকৃতির অবদান। যে সূর্য পৃথিবীকে আলো দেয় তা নিশ্চয়ই মানুষ সৃষ্টি করেনি। আবার সাগর, নদী, পর্বত ও মানুষের সৃষ্ট নয়। যে অক্সিজেন আর পানি নিয়ে আমরা বেঁচে আছি সেটাও প্রকৃতির দান। যে খাবার আমরা খাই তাও সব প্রকৃতির অসীম দান। অথচ এই প্রকৃতিটা কার দান তা নিয়ে আমরা একটু চিন্তা করি না।

একদল বিজ্ঞানী আমাদেরকে আবার পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলে বসবাস করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। পৃথিবীটা নাকি ক্রমেই মানুষের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাই কিছু মানুষকে মঙ্গলে পাঠানো হবে এবং মঙ্গলে মানুষের বসতি গড়ে তোলা হবে। এমন পরিকল্পনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছে এবং ব্যয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বাস্তবতা হচ্ছে মঙ্গলে মানুষের বসবাস কোন দিন সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানের চরম উন্নতি সত্তে¡ও তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞান একজন মানুষের রোগ নিরাময়ে সক্ষম। তাই বলে মানুষকে অমরত্ব দানে সক্ষম নয়। নারী গর্ভে থাকা সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে তা প্রসবের আগে জানা সম্ভব। তাই বলে ইচ্ছামত ছেলে অথবা মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। মানুষ তার ইচ্ছামত দিনরাত্রিকে যেমন বড় ছোট করতে পারে না, ঠিক তেমনি রোদ বৃষ্টি আর শীতকে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একইভাবে ভূমিকম্প, অতি বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ¡াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বন্ধ করার উপায় ও মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ মানুষের জ্ঞান এবং ক্ষমতার একটি সীমারেখা আছে, যা অতিক্রম করা কোন মানুষের পক্ষে কোনদিনও সম্ভব নয়। যারা মঙ্গলে বসতি গড়ার কথা বলছেন তাদের বলব, আপনারা আগে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুতে বসতি গড়–ন। লক্ষ কোটি মাইল দূরের মঙ্গল গ্রহ যেখানে অক্সিজেন ও কোন ধরনের খাদ্য নেই, সেখানে এত কষ্ট করে যাওয়ার দরকার কি এবং সেখানে বসবাস করার দরকার কি? এই পৃথিবীর অনেক ভূখন্ডেই তো এখনো মানুষের বসতি গড়ে ওঠেনি। হিমালয়, আল্পস এবং কিলিমান্জারু পর্বতের চূড়ায় আর আমাজান অথবা আফ্রিকা মহাদেশের গভীর অরন্যে আগে মানুষের বসবাস গড়ে তুলুন। সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল আর মরুভূমির বালুর রাজ্যে মানুষের বসবাস গড়ে তুলুন। একইভাবে এই পৃথিবীর তিনভাগ অঞ্চল জুড়ে বিস্তীর্ণ অথৈই জলরাশিকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করুন। লক্ষ কোটি মাইল দূরের মঙ্গলে যাওয়া এবং সেখানে বসতি গড়ার চেয়ে এই পৃথিবীর বরফ আচ্ছাদিত ভূখন্ড, পাহাড়ী জনপদ এবং মরুভূমির প্রান্তরকে মানুষের বসবাসের উপযোগী গড়ে তোলা বিজ্ঞানীদের জন্য অনেক বেশি সহজ বিষয়। এছাড়া পৃথিবীর যে সব শহরে গ্রামে মানুষ এখন বসবাস করছে সেগুলোকে আরো উন্নত করে কীভাবে সুন্দরভাবে বসবাস উপযোগী করা যায় সেই প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করাটাই বিজ্ঞানীদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে মঙ্গলে মানুষের বসতি গড়ার স্বপ্ন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং অসম্ভব একটি বিষয়। মানুষ লক্ষ কোটি মাইল দূরের মঙ্গল গ্রহে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, অথচ টাইটানিক ডুবে যাবার একশত বছর পেরিয়ে গেলেও, তারা এখনো সমুদ্রের মাত্র কয়েক শত ফুট নিচ থেকে জাহাজটিকেই তুলতে পারেনি। আর মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমানটিও খুঁজে বের করতে পারেনি এবং বিমানটির যাত্রীদেরকেও বাঁচাতে পারেনি। এমনকি বিমানটির ধ্বংসাবশেষ এবং যাত্রীদের লাশও উদ্ধার করতে পারেনি। আর এখনো ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়াকেও নির্মূল করতে পারেনি। চন্দ্র বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। কিন্তু এই সময়ে চাঁদে মানুষের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। অথচ এই পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। তাই মানুষের উচিত বাস্তবতায় ফিরে আসা, বাস্তববাদী হওয়া এবং এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করা। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই নিজেদেরকে জানি, স্রষ্টাকে জানি এবং তাকে মানি। কীভাবে এই পথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হল, এই পৃথিবীতে আমাদের কাজ কী এবং মরনের পরে কী হবে সে সব বিষয় জানা এবং সেই অনুযায়ী পথ চলা আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব। তাহলেই কেবল মানুষের জীবন শান্তির এবং সুখের হবে। তা না হলে মানুষের জন্য দুঃখ আর কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নেই, যা কারো কাম্য নয়। এদিকে উন্নত দেশসমূহ অস্ত্র তৈরির পিছনে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে এবং এই খরচ বছরের পর বছর ধরে চলছে। আর অনুন্নত দেশগুলো প্রতি বছর অস্ত্র কেনার পিছনে খরচ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। অথচ পৃথিবীর ছয় কোটি মানুষ এখন উদ্বাস্তু আর একশত কোটি মানুষ দরিদ্র। মঙ্গল নিয়ে গবেষণা এবং অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশ যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, তার সিকি ভাগও যদি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করত, তাহলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি বহু আগেই দূর হত আর বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন অনেক উন্নত হত এবং একইসাথে মানবজাতি সুখী হত। আর এটাই হত সত্যিকারের মানবতার কল্যাণ।

লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল: omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন