বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঢাবি সঙ্গীত বিভাগের কান্ড!

নুর হোসেন ইমন | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

নিজেদের ‘পছন্দের প্রার্থীর’ বিপরীতে লেকচারার পদে আবেদন করায় এক কর্মকর্তাকে ‘মানসিক নির্যাতন’ করে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সংগীত বিভাগের সাবেক ও বর্তমান দুই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, টানা তিন বছর খন্ডকালীন শিক্ষক ও পরবর্তীতে কর্মকর্তা পদে চাকরি করেও তাদের ‘অত্যাচারে’ নিজ থেকে বিভাগ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

ভুক্তভোগী কর্মকর্তার নাম জাকির হোসেন। তার অভিযোগ, বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহসীনা আক্তার খানম (লীনা তাপসী) ও বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দার নামাভাবে তাকে হুমকি ধামকি দিয়েছেন ও বিভাগের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছেন। এছাড়া তাকে ফাঁসানোর জন্য ‘অপরিচিত লোকজনের’ মাধ্যমে পকেটে মাদক দ্রব্য রাখা ও ব্যবহৃত মোবাইল ফোন চুরি করার চেষ্টা হয়েছে।

‘মানসিক নির্যাতনের’ শিকার হয়ে সম্প্রতি চাকুরী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে অব্যাহতি পত্র জমা দেন জাকির হোসেন। অব্যাহতির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে দু’চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান বরাবর প্রেরণ করেন।

জানা যায়, প্রায় তিন বছর সংগীত বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাকিরকে সংগীত বিভাগে ডেমেনস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই নিয়োগ বোর্ডে তৎকালীন কলা ভবনের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাবির বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান। জাকির হোসেনের দাবি, ওই পদের বিজ্ঞপ্তির সব শর্ত মেনেই তাকে চাকরি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট তাকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়। তিনি ডেমেনস্ট্রেটর পদে ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন।

পরে ২০১৭ সালে লেকচারার পদের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে জাকির হোসেন পদটিতে আবেদন করার জন্য সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন। রেজিস্ট্রার তাকে পদটিতে আবেদন করার অনুমতি দেয়। পরবর্তীতে একই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রার বরাবর লেকচারার পদে নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করেন। এরপর সংগীত বিভাগে জাকির হোসেনের আবেদন এবং কাগজপত্র যাচাই করে পদের জন্য তাকে যোগ্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করে। একই বছরের ২৩ মার্চ প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অফিসে তার সাক্ষাৎকারের জন্য চিঠিও পাঠায়।

জানা যায়, সংশ্লিষ্ট পদে বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান লীনা তাপসীর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন স্বরূপ হোসেন। স্বরূপ হোসেনের বিপরীতে জাকির হোসেন ওই পদে আবদেন করায় চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ জাকিরের। জাকিরের অভিযোগ, পদটিতে আবেদন করার জের ধরে একই বছরের ২০ এপ্রিল লীনা তাপসী তার ডেমনস্ট্রেটর পদে নিয়োগ যথাযথভাবে হয়নি বলে তাকে জানায়। এরপর একের পর এক নতুন পদ্ধতিতে তার উপর আসতে থাকে নানাধরণের হয়রানি। লীনা তাপসী চাকরি বাঁচাতে তাকে মানববন্ধন করার পরামর্শ দেন। লেকচারার পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ১ মাসের মাথায় স্বরূপ হোসেনও এসব নির্যাতনে যোগ দেন। স্বরূপ জাকিরকে চাকরি শেষ হলেও পেনশন পাবেন না, সব টাকা ফেরত দিতে হবে প্রতিনিয়ত এ ধরণের নানা কথা বলে হয়রানি করেন।

নতুন নতুন পদ্ধতিতে ‘হয়রানি’
জাকিরের ভাষ্যমতে, লীনা তাপসী, স্বরূপ হোসেন ও বিভাগের অন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বরাজ কুমার দেবের মাধ্যমে জাকির হোসেনের ‘মূল সনদপত্র খামে ভরে’ তার কাছে জমা দিতে বলেন। এবং এগুলো জমা না দিলে পরবর্তীতে তার সমস্যা হবে চাকরি করেও পেনশন পাবেন না বলে ভয় দেখান। যদিও শিক্ষক বা কর্মকর্তার মূল সদনপত্র চেয়ারম্যান তার নিজের কাছে জমা রাখার এখতিয়ার নেই বলে জানা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর পাঠানো জাকিরের অভিযোগমতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সমতাপত্র পাওয়ার ১৪ বছর পর পুনর্মূল্যায়নের চিঠি পাঠান। অথচ এ ধরণের চিঠি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়ে ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিধি রয়েছে বলে জানা যায়।

হয়রানিতে যোগ দেন বর্তমান চেয়ারম্যানও
২০১৭ সালে লেকচারার পদে জাকির হোসেনের সাথে পদপ্রার্থী ছিলেন বিভাগটির বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দারের স্বামী পংকজ কান্তি দাস। বিভাগটির ‘শিক্ষক রাজনীতিতে’ লীনা তাপসী ও টুম্পা সামাদ্দার আলাদা গ্রুপের নেতৃত্বে থাকলেও জাকিরের হোসেনের বিষয়ে দুজন একই ধরণের কর্মকান্ডের আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ তার। বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দার গত বছরের ১ জুলাই দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাকির হোসেনকে একই বিষয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছেন। সর্বশেষ এ বছরের জুন মাসে জাকির হোসেনকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়তে বলেন, অন্যথায় বরখাস্ত কার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ করেন জাকির।

বিভাগটিতে জাকিরের একই পদের অন্য এক ডেমোনেস্ট্রেটরকে সপ্তাহে ৫ থেকে ৬টি ক্লাস দেওয়া হলেও জাকিরকে দেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ২৪টি ক্লাস। ২০১৫ সালের জুন থেকে ডেমনস্ট্রেটর পদে চাকরি করলেও তাকে বসার জন্য আলাদা কোন কক্ষ দেয়া হয়নি। জাকির সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী পোস্ট দিয়ে ফাঁসানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার তার মোবাইল ফোন চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে তিনি ক্লাসে আসার সময় মোবাইল আনা বন্ধ করে দেন। তারপর কয়েকবার তার পকেটে মাদকজাতীয় দ্রব্য ডুকিয়ে দিয়ে ও নারী কেলেংকারীতে জড়ানোর চষ্টো করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি সবসময় লক্ষ করছিলাম অপরিচিত লোকজন আমার পিছু পিছু ঘুরছে ও আমার পকেটে কিছু একটা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমার বসার কোন রুম নেই তাই আমি ফাঁকা ক্লাস রুমে গিয়ে বসলে পরেরদিন ওখানে ফ্যান নষ্ট করে দেয়া হয়েছে বা লাইট নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এভাবে নতুন নতুন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরণের হয়রানি করা হয়।

জাকিরের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা:
হয়রানি ও চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম, শিক্ষকদের লেখা চুরি এবং বিভাগের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভিসি বরাবর রেজিস্ট্রারের কাছে এ বছরের ১৫ জুলাই অভিযোগ জমা দেন জাকির হোসেন। প্রশাসনিক বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র মতে, প্রশাসনিক অফিসের এক কর্মকর্তা এসব অভিযোগের বিষয়টি টুম্পা সমাদ্দারকে জানান। পরে টুম্পা সমাদ্দার এবং লীনা তাপসী তাদের বিরুদ্ধে করা এসব অভিযোগ যেন ভিসি পর্যন্ত না পোঁছে সেজন্য প্রশাসনিক বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। যদিও জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট আমাকে নিয়োগ দেয়া স্বত্তে¡ও তারা অনবরত আমাকে হয়রানি করেছে। তারা আমাকে বিভিন্নভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে। এজন্য আমি ক্যাম্পাসে আসতে ভয় পাচ্ছি। আমি যেসব কথা বলেছি সবকিছুর প্রমাণ আমি ভিসি বরাবর জমা দিয়েছি। আমি যদি সুবিচার না পাই প্রয়োজনে মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হব।

বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দার বলেন, তাকে কোনরকম হয়রানি করা হয়নি। আমাদের বিভাগে অনেক শিক্ষকেরই বসার কক্ষ নাই তারও ছিলো না। সে কেন চলে গেছে তা আমি জানি না। তাকে নিয়ে আসার জন্য আমাদের কয়েকজন শিক্ষক তার বাড়ীতে গিয়েছে, তার মোবাইলে বারবার ফোন দেয়া হয়েছে কিন্তু সে ধরেনি। আমরা বিভাগ থেকে ইউজিসিতে কোন পত্র দেইনি। সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমেই নিয়মানুযায়ি হয়েছে। যেহেতু সে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছে বাকিটা তারা দেখবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগীত বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. লীনা তাপসী বলেন, তোমরা খোঁজ নিলে জানবে তার মাস্টার্স নেই সে ভারত থেকে একটা ডিপ্লোমা করেছে। তাকে আমরা বারবার এটা করতে বলেছি সে করেনি। তার সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে কারণ এসব বিষয় বিভাগ দেখে। আর সে এমপিল করতে চেয়েছিল। তাই সার্টিফিকেট চেয়েছিলাম। তার চাকুরী খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে আরো অনেক আগে করতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি আমরা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমি এসব অভিযোগের বিষয় জানিনা। এগুলো খুবই গুরুত্বর অভিযোগ। আমার কাছে পৌছালে আমি দেখব। অভিযোগ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন