নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৮ রবিউল আওয়াল মোতাবেক ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলে পাক (সা:)-এর কদম মোবারক ‘ইয়াসরিব’-এর মাটি স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে এই স্থানের মর্যাদা পৃথিবীর মানচিত্রে এক বিশেষ পবিত্রতম স্থানে রূপান্তরিত হয়। এই গৌরব, এই মর্যাদা, এই পবিত্রতা শুধুমাত্র আকায়ে নামদার তাজেদারে মদিনা, নূরে মুজাচ্ছাম, সরদারে দু’জাহা সাইয়্যেদুল মুরছালিন হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পদধূলির বরকতেই সম্ভব হয়েছে। মদিনা মোনাওয়ারার এই সম্মান ও গৌরবের পেছনে আরো অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরূপ :
১. সমস্ত পৃথিবী যখন রাসূলে পাক (সা:)-এর বিরুদ্ধে; কোথাও এতটুকু আশ্রয় দেয়ার কেউ ছিল না। নবুয়তের সুদীর্ঘ তেরটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে কয়জনকে আল্লাহ পাকের ‘অহদানিয়াত’- এর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করাতে পেরেছিলেন, তাদের ওপরও নেমে এসেছিল অমানুষিক নির্যাতন। অতি আপনজন থেকেও যে নিষ্ঠুর অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা অকল্পনীয়। এই নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে রাসূলে পাকও (সা:) বাঁচতে পারেননি। ‘শিয়াবে আবু তালেব’ এ তিন বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করে, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে সাহাবায়ে কেরামসহ অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, কঙ্কালসার হয়েও কাফেরদের মনে দয়ার উদ্রেক ঘটাতে সক্ষম হননি, ঠিক সেই সময় মদিনাবাসীদের মনে মানবতার মহান দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। তারা মক্কাবাসীদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাসূলে পাক (সা:) ও তাঁর সহচরদের আমন্ত্রণ জানান মদিনায় হিজরত করার। মদিনাবাসীদের সশ্রদ্ধা আন্তরিক আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রাসূলে পাক (সা:) মদিনায় হিজরত করেন।
২. মদিনা মোহাজেরদের আশ্রয়স্থানের গৌরব অর্জন করে।
৩. প্রতিটি যুদ্ধে মোহাজেরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সর্বতোভাবে সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
৪. যেখানে কোরআন পাকে বহু সূরা নাজিল হয়।
৫. এখান থেকেই কোরআন পাককে একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়।
৬. এই মদিনায়ই দু’জাহানের বাদশাহ রাসূলে পাক (সা:) চিরদিনের মতো শায়িত আছেন।
৭. এই মদিনা থেকেই সারা বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া হয়।
৮. এই মদিনা থেকেই রাসূলে পাক (সা:) ইসলামের পরিপূর্ণতা দান করে, এই ‘দ্বারে ফানী’ থেকে ‘দ্বারে আখিরাতে’ তশরিফ নিয়ে যান। যাবার সময় তিনি আমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যান এবং বলে যান যে, ‘এই দু’টি জিনিস আঁকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনও বিপথগামী হবে না। সেই মহান জিনিস দু’টি হলো, আল্লাহ পাকের কালাম-পবিত্র কোরআন এবং রাসূলে খোদা (সা:)-এর অমিয়বাণী-আল হাদিস।’
৯. এখানেই রাসূলে পাক (সা:)-এর নিজ হাতে গড়া মসজিদ, মসজিদে নববী আল্লাহর ঘর কাবার পরই যার মর্যাদা।
পবিত্র মদিনার নামসমূহ : ১. তাইয়্যেবা, ২. বাইতে রাসূলুল্লাহ, ৩. আল মুসালিমাতুল আহবুবিয়া, ৪. দারুল ফাতাহ, ৫. হারামে রাসূলুল্লাহ, ৬. জাতুন নখল, ৭. ছায়েদাতুল বুলদান, ৮. আল বারা, ৯. আল জাবেরা, ১০. আল মুখতারা, ১১. কুব্বাতুল ইসলাম, ১২. কালবুল ঈমান, ১৩. দারুল আবরার, ১৪. আল মুমিনা, ১৫. দারুস সুন্নাত, ১৬. দারুল আখইয়ার, ১৭. দারুল হাসিনা, ১৮. জাতুল হারারাত, ১৯. আল মুবারাকা ইত্যাদি।
মসজিদে নববীর ইতিহাস : মসজিদে নববীর স্থান নির্বাচনের পেছনে একটি সুন্দর ইতিহাস আছে। রাসূলে পাক (সা:) যখন মদিনায় আগমন করছিলেন, তখন পথিমধ্যে প্রতিটি গোত্রের অধিপতিগণ অনুনয় ও বিনয় সহকারে বলতেন, ‘হুজুর (সা:) দয়া করে আমাদের এই দরিদ্রালয়ে পদধূলি দিয়ে কৃতার্থ করুন।’ হুজুরে পাক (সা:) হাসিমুখে সকলকে এই বলে বিদায় দিতেন যে, ‘আপনারা আমার ভাই, সবাই আমার নিকট সমান আদরণীয়। তবে আমার অবস্থান করাটা এখন আল্লাহর হাতে।’ এভাবে মধুর কণ্ঠে বলতেন, ‘সাল্লু ছাবিলাহা ফা ইন্নাহা মামুরাতুন।’ অর্থাৎ- ‘উস্ট্রীটিকে যেতে দিন, সে হুকুম প্রাপ্তা। সে আপন ইচ্ছায় যেখানে গিয়ে থামবে আমি সেখানেই অবস্থান করব।’ এই বলে নবীজী (সা:) অগ্রসর হতে লাগলেন। কিছু দূর যাবার পর নবীজী (সা:)- এর মাতুল ইবনে নাজারের বস্তির পাশে গিয়ে উটনী থেমে গেল। কিন্তু উটনীর হাবভাবে বোঝা গেল যে, সে যেন সন্দেহে পড়েছে। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক তাকিয়ে আবার কিছু দূর এগিয়ে গেল। সন্দেহ তখনও তার কাটছিল না, হঠাৎ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পেছনের দিকে তাকিয়ে আবার পূর্ব স্থানে গিয়েই বসে পড়ল। এবার তার আর কোনো সন্দেহ নেই। সে নিশ্চিত যে, এটিই হলো তার কাক্সিক্ষত স্থান। পাশেই ছিল হযরত আবু আইয়ূব আনছারী (রা:)- এর বাড়ি। ভাগ্য তাঁর আজ সুপ্রসন্ন। তিনি আনন্দে আত্মহারা। দৌড়ে এসে নবীজীর সামান নামাতে লেগে গেলেন। নবীজী তার বাড়িতে উঠে এলেন এবং কিছু দিন এখানেই অবস্থান করলেন। এখানে উটনী কেন থেমেছিল তার উত্তর দেয়া কঠিন হলেও নিন্মে বর্ণিত ইতিহাসটি কিছুটা হলেও সেই রহস্যের জট খুলতে সাহায্য করবে।
(আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:)-এর রচনাবলি হতে সংগৃহীত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন