এককালে মদীনা ছিল মরুভ‚মি। সেই সময় ইয়ামানের বাদশাহ ‘তুব্বা হিমইয়ারী’ বিপুল সংখ্যক লোক-লস্কর নিয়ে এই পথ অতিক্রম করতে ছিলেন। তখন তার সঙ্গে ৪ শত আলেমও ছিল। এই আলেমদের নেতৃত্বে ছিলেন ‘শামুল’।
এখানে ছোট্ট একটি মরুদ্যান এবং এর পাশেই প্রবাহিত একটি নহর দেখে বুঝে গেলেন যে, এই স্থানটিতে আখেরি নবী হিজরত করে অবস্থান গ্রহণ করবেন। শামুল তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে বসতি স্থাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। বাদশাহ তুব্বাও অবস্থানের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু রাজ্যের গুরুদায়িত্বের কারণে থাকা সম্ভব হলো না। যাবার সময় একটি ঈমাননামা লিখে শামুলের হাতে দিয়ে বলে গেলেন যে, ‘আপনার বংশের যেই নবীজীর সাক্ষাৎ পাবে, তিনি সেই নবীজীর নিকট আমার সালাম পৌঁছে দিয়ে ওই ঈমাননামাটি তাঁর হাতে যেন পৌঁছে দেয়।’ এই পত্রটি বংশপরম্পরায় ২৬ পুরুষের পর হযরত আবু আইয়ূব (রা.)-এর হাতে পড়েছিল। নবীজী যে ঘরটিতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন এই ঘরটিও সেই বাদশাহই নির্মাণ করে গিয়েছিলেন নবীজীর থাকার জন্য।
যে স্থানে উটনী বসে ছিল সেটি ছিল খেজুর শুকানোর একটি মাঠ। নবীজী এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করে জানতে চাইলেন, ‘এই স্থানটির প্রকৃত মালিক কে?’ এই স্থানটির মালিক ছিল দুই ইয়াতিমের। তাদের নাম ‘সুহেল’ ও ‘সুহায়েল’। রাসূলে পাক (সা.) যাচাইপূর্বক ১০ দেরহাম মূল্য নির্ধারণ করেন। এই মূল্য হযরত আবু বকর (রা.) পরিশোধ করে দেন।
মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়ে গেল। নবীজী নিজেও এতে অংশগ্রহণ করলেন। নবীজীকে স্বহস্তে মসজিদ নির্মাণ করতে দেখে সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা শত গুণ বেড়ে গেল। এক সাহাবী বলে উঠলেন, ‘যেখানে নবীজী কাজ করছেন সেখানে আমাদের বসে থাকলে ভুল হবে। আমরা আখিরাতের আরাম ছাড়া অন্য কোনো আরাম চাই না। হে আল্লাহ, আনসার এবং মোহাজেরদের ওপর রহমত বর্ষণ করো।’
মসজিদের আয়তন ৪২ শত বর্গহাত। উচ্চতা ছিল ৫ হাত। সপ্তম হিজরীতে ‘খায়বার’-এর যুদ্ধের পর মসজিদটি আরো প্রশস্ত করা হয়। তখন এর আয়তন দাঁড়ায় ১০ হাজার বর্গহাত। এই মসজিদে তিনটি দরজা রাখা হয়। একটি দরজা ছিল বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে। কেবলা পরিবর্তন হওয়ার পর সেই দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। মসজিদের দেয়াল কাঁচা ইট এবং পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। খুঁটিগুলো ছিল খেজুর গাছের। ছাদ তৈরি করা হয়েছিল খেজুরের পাতা দিয়ে।
মেহরাব : রাসূলে পাক (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের জামানা পর্যন্ত এই মসজিদে কোনো মেহরাব ছিল না। ৯১ হিজরীতে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের সময় মদীনার গভর্নর ওমর বিন আব্দুল আজীজ প্রথম মেহরাব তৈরি করেছেন।
মিম্বর : প্রথমে এই মসজিদে কোনো মিম্বর ছিল না। রাসূলে পাক (সা.) খেজুর গাছের একটি খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে খুৎবা দিতেন। পরে এক ব্যক্তি তিন-চার সিঁড়ির একটি মিম্বর বানিয়ে দেন। রাসূলে পাক (সা.) তৃতীয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। এর বেশ কিছুদিন পর আমীর মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রা.) একটি ছয় সিঁড়ির মিম্বর তৈরি করে দেন। ৬৫৪ হিজরীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উক্ত মিম্বরটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইয়ামানের বাদশাহ মুজাফ্ফর একটি নতুন মিম্বর বানিয়ে দেন। এই মিম্বরটি আবার ৭৯৪ হিজরীতে বাদশাহ জাহের বরকুক পরিবর্তন করেন। ৮৮৬ হিজরীতে মদীনাবাসী আবার এটির পরিবর্তন করেন। ৮৮৮ হিজরীতে আশ্রাফ কাফতেবায়ী মর্মর পাথর দিয়ে মিম্বর তৈরি করে দেন। ৯৭৮ হিজরীতে সুলতান মুরাদ উসমানী অত্যন্ত মূল্যবান কাঠ দিয়ে মিম্বর তৈরি করে উক্ত মিম্বরের স্থলাভিষিক্ত করেন।
মসজিদ সম্প্রসারণ : হযরত ওমর (রা.)-এর সময় একবার এবং হযরত উসমান (রা.)-এর সময় দ্বিতীয়বার মসজিদটি সম্প্রসারিত হয়।
৮৮ হিজরীতে খলিফা ওয়ালিদ বিন আ: মালেক পুরোপুরি নতুনভাবে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন, যা পাঁচ বছরে শেষ হয়। তিনি মসজিদে ৪টি মিনার সংযোজন করেন। সুলতান আ: মজিদ সানী আরো একটি মিনার সংযোজন করেন।
১৬১ হিজরীতে খলিফা আব্বাসী উত্তর দিক থেকে কিছু সম্প্রসারণ করেন। তখন এর আয়তন দাঁড়ায় দৈর্ঘ্যে ৩০০ হাত আর প্রস্থে ১৮০ হাত।
৬৫৪ হিজরীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মসজিদটি মারত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা মুতাছিম বিল্লাহ তা মেরামতের নির্দেশ দেন। এই মেরামত কার্যে আরো যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন মিসরের বাদশাহ নুরুদ্দিন ছালেহ, নাছের মাহমুদুন, ফালদুন আল সেহালী, আশ্রাফ বরছাবায়ী, জাহের জকমক, সুলতান কায়তে বায়ী, ইয়ামানের বাদশাহ মোজাফ্ফর শামসুদ্দিন ইউসুফ, রুকুনুদ্দিন কেবরছ প্রমুখ।
১২৬৫ হিজরীতে সুলতান আ: মজিদ সম্পূর্ণ নতুন নকশা করে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন, যা সুদীর্ঘ তের বছরে সমাপ্ত হয়। এরপর কিছু সম্প্রসারণের কাজ করেন আ: আজীজ আল সউদ এবং বর্তমানেও সউদী বাদশাহগণ সম্প্রসারণ এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রচুর কাজ করে চলেছেন। মিনার আছে ১০টি, মিনারের উচ্চতা ৪টির ৭২ মিটার আর ৬টির ৯২ মিটার, দরজার সংখ্যা ২৪টি। মাটির নিচে অজু, গোসলের এবং শৌচাগারের যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তা তুলনাহীন, প্রতিটি শৌচাগারে ওঠানামার জন্য এক্সেলেটর আছে। লাখো মানুষ একসাথে হাজত পুরা করতে পারে।
জিয়ারত : জিয়ারতে মদীনা যাদের নছিব হবে তারাই হলো পরম সৌভাগ্যবান। রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করবে, সে কিয়ামতের দিন আমার আশপাশে থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ইন্তেকালের পর আমার কবর জিয়ারত করল, সে যেন জীবদ্দশায়ই আমার জিয়ারত করল।’ তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, আমার ওপর তার জন্য শাফায়াত করা ওয়াজিব হয়ে গেল।’
উপরোক্ত হাদিসগুলো দ্বারাই বোঝা যায় একজন মুমিনের জন্য জিয়ারতে মদীনা কত বড় মহৎ ও সওয়াবের কাজ।
মদীনা শরীফে প্রবেশ করার সময় একাগ্রচিত্তে ভক্তি ও ভালোবাসার সাথে দরুদ শরীফ পাঠ করতে থাকবেন।
মদীনা শরীফে পৌঁছে থাকার জায়গায় গিয়ে ভালোভাবে অজু-গোসল করে, খুশবু ব্যবহার করে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে মসজিদের দিকে রওনা দিন। সম্ভব হলে ‘বাবে জিব্রীল’ দিয়ে প্রবেশ করুন। এ সময় এই দোয়াটি পড়বেন, ‘বিসমিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ আল্লাহুম্মাফতাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা।’
এরপর সম্ভব হলে সোজা রিয়াজুল জান্নাতে চলে আসুন, আর সম্ভব না হলে যেখানে জায়গা পাওয়া যায় সেখানে দুই রাকাত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ নামাজ পড়––ন এবং জিয়ারত কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করুন।
(আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-এর রচনাবলি হতে সংগৃহীত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন