শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আল-কুরআনে কিসাস (প্রতিশোধ) প্রসঙ্গ

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বর্তমান বিশ্বে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা এবং এ সংক্রান্ত অন্যায় অপরাধের প্রবণতা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জীবতরাও উৎকন্ঠিত কখন কী হয়! কেউ এখন আর এ থেকে নিরাপরাধ ভাবতে পারছে না। সচেতন মহল তাই এর প্রতিরোধের নানা রকম উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। এতদসংক্রান্ত অপরাধের প্রতিকার নিয়ে আল-কুরআনের একটি পন্থা হলো ‘কিসাস’। মূলতঃ মৃত্যুর বিনিময়ে মৃত্যু, কিংবা কোন ধরণের জখমের বিনিময়ে অনুরুপ জখমের পরিভাষা হলো ‘কিসাস’ বা ‘অনুরুপ প্রতিশোধ’। ইসলামী অপরাধ আইনের গরুত্বপূর্ণ এই পরিভাষাটি সরাসরি কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ইসলামী অপরাধ আইনে তিন ধরণের অপরাধের কথা বলা হয়েছে। যথা: (১) কিসাস (অনুরুপ প্রতিশোধ), (২) হুদুদ (আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) এবং (৩) তা’যির (ভীতি প্রদর্শন মূলক শাস্তি)। এসকল শাস্তির মূল উদ্দেশ্য হলো: (১) অপরাধীকে শোধরানো, (২) ক্ষতিগ্রস্থদের সান্তনা এবং (৩) অন্যান্যদেরকে অনুৎসাহিত করা।

কিসাস মূলতঃ কয়েকটি অপরাধকে অন্তর্ভুক্ত করে: (১) হত্যা (ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত উভয়ই), (২) উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মানবতা বিরোধী অপরাধ যা মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর কারণ হতে পারে, (৩) ভুলকৃত হত্যা, এবং (৪) ভ‚লক্রমে মানবতা বিরোধী এমন অপরাধ যা মৃত্যু কিংবা মৃত্যুও কারণ হতে পারে।

পবিত্র কুরআনে কিসাসের বিধানের পাশাপাশি তার উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। কিসাসের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে দুইটি সূরাতে তিনটি আয়াতে বর্ণনা এসেছে। দুইটি আয়াতে বিধান এবং অন্যটিতে উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানগারগণ, তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাস দাসের বদলায় এবং নারী নারীর বদলায়। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয়ে, তাবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে তার জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। হে বুদ্ধিমানগণ, কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে জীবন রয়েছে যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২: ১৭৮-১৭৯)

অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, “আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখম সমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।” (সূরা মায়েদাহ, ৫: ৪৫)

উপরোক্ত আয়াত তিনটি থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। যেমন: (১) ন্যায় বিচার সবার জন্যে, (২) ক্ষতিগ্রস্থদের অধিকার আছে বৈধ উপায়ে প্রতিশোধ নেবার, (৩) সমবস্থার প্রতিশোধের বাইরেও শর্তসাপেক্ষে টাকা ও সম্পদের ক্ষতিপুরুণও চাইতে পারবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি কিংবা তার উত্তরাধিকারীরা, (৪) ন্যায় বিচার অবশ্যই আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক হতে হবে, (৫) আল্লাহর দেয়া বিধান উপেক্ষাকারীদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি, এবং (৬) কিসাসের মধ্যেই অন্যদের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে।

এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, হত্যাকারীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে কিভাবে জীবনকে বাঁচানো যায়? উত্তরে বলা যেতে পারে: (১) যখন কোন অপরাধী ঠিক সমপরিমাণ শাস্তি পাবে তখন সমাজের অন্য কেউ ঐ অপরাধে জড়াতে চাইবে না এটাই মানব প্রকৃতি। সুতরাং একজনের মৃত্যুদন্ডের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের অনেকের জীবনকে নিরাপদ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে (২) ‘হাতের বিনিময়ে হাত’, ‘পায়ের বিনিময়ে পা’, ‘চোখের বিনিময়ে চোখ’, বা অন্য কোন অঙ্গের বিনিময়ে যদি অনুরুপ শাস্তি অপরাধীকে দেয়া যায় তাহলে ঐ অপরাধী সমাজের জন্যে ন্যায় বিচারের একটি জীবন্ত শিক্ষা হিসেবে কাজ করবে। তখন অন্যান্যরা সেই ভয়াবহতা সরাসরি অনুভব করবে এবং এই ধরণের কোন অন্যায়ের সাথে কখনও সম্পৃক্ত করতে চাইবে না।

কিন্তু একটা কথা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে তা হলোঃ (১) কিসাসের শাস্তি কিন্তু কোন ব্যক্তি দিতে পারবে না। এটির মূল দায়িত্ব সরকার বা বিচার ব্যবস্থার উপরে, (২) প্রত্যেক অপরাধেরই শাস্তি হতে হবে। এটি এমন না যে, আপনজনেরা শাস্তি পাবে না কিন্তু অন্যরা পাবে। অর্থাৎ কোন বৈষম্য করা যাবে না, (৩) অনুরুপভাবে প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির অধিকার আছে প্রতিশোধ নেবার, (৪) দিয়্যতের (টাকা বা সম্পদের বিনিময়ে প্রতিশোধ) ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি আগে থেকেই থাকতে হবে, (৫) অপরাধী যদি ক্ষতিপুরুণ দিতে অসমার্থ হয় তাহলে তার পরিবার এবং পরিবার অসমর্থ হলে সমাজের উপর, এমনকি পর্যায়ক্রমে সরকারের উপরেও বর্তাবে, (৬) যে কোন ক্ষতিপুরুণ অবশ্যই নির্ধারিত নিয়ম-নীতির মাধ্যমে এবং বৈধ উপায়ে আদায় করতে হবে। এটি ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়ে বরং বিচার ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হবে।

পরিশেষে বলা যায়, সতিক্যার অর্থেই যদি মৃত্যু ও এতদসংক্রান্ত কোন অপরাধের জন্যে সমপরিমাণ প্রতিশোধ অপরাধী থেকে নেয়া যায় তাহলে বিশ্বজিত কিংবা রিফাতের মতো আর কেউ দূর্ঘটনার স্বীকার হবে না। আল্লাহ আমাদেরকে এরকম পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ রাখুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আল আমিন ৬ মে, ২০২০, ৪:২১ পিএম says : 0
রাস্ট্রেে বিচার যদি এরকম হতো!!!
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন