‘গুজব’ এবং ‘গজব’ দু’টি শব্দের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে প্রায় একই রকম হলেও শাব্দিক অর্থে অনেক তারতম্য। তবে দু’টি শব্দই জনস্বার্থের পরিপন্থী। গুজব মানুষ সৃষ্টি করে, গজব আসে প্রকৃতি থেকে। বিভিন্ন ভাবে গুজবের আর্ভিবাব ঘটে। যার পিছনে শুধু গোষ্টিগত স্বার্থ আর স্বার্থ কাজ করে। অনেক সময় জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেও গুজব রটানো হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ যুগে যুগে বিভিন্ন পারিপার্শিক ঘটনা/রটনা এর স্বাক্ষ্য প্রদান করে। গুজব থেকে সাবধান বা গুজব ছড়াবেন না বা গুজব ছড়ালে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এমন বাক্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে পূর্বেও বলা হতো এবং এখনো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে গুজব একটি মরনাস্ত্রের চেয়ে মারাত্মক ঝুটিপূর্ণ অস্ত্র যার দ্বারা কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের উপকারে হয়তো এসেছে, কিন্তু বিপর্যস্থ হয়েছে গণমানুষ। গুজব ছড়ানো বা ছড়ানোর কাজে সহযোগীতা করাও জনস্বার্থ বিরোধী। ‘গজব’ শব্দটিও বহুপ্রচারিত ও প্রচলিত। মসজীদে বা কোন দোয়ার মাহফিলে প্রতিনিয়ত গজব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৃষ্টি কর্তার নিকট প্রার্থনা করা হয়। ধর্ম গ্রন্থে সৃষ্টি কর্তা নিজেও স্বীকার করে বলেন যে, তার (সৃষ্টিকর্তা) দেয়া গজবে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে।
‘গজব’ প্রকৃতিগত। ধর্মগ্রন্থের মর্মবাণী মোতাবেক মানুষ যখন সীমালঙ্গন করে তখনই প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় এবং এ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রকৃতির ইচ্ছাটাই যথেষ্ট। মানুষকে সর্তক করার জন্য ‘সীমালঙ্ঘন’ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে, তারপরও সীমালঙ্ঘন হচ্ছে অব্যাহতভাবে। রাজ্য শাসনে শাসক দলের জবাব দিহিতা অনেক। জবাবদিহিতার পরিবর্তে যদি জনগণকে জিম্মি করে শাসকের সকল ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয় সেখানেই জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্থ হয়। শাসক দল আত্ম প্রশংসায় মগ্ন থাকার কারণে সীমালঙ্গনের বিষয়টি তাদের থার্মোমিটারে ধরা পড়ে না, আর যখন ধরা পড়ে তখন সময় গড়িয়ে যায়। “সীমালঙ্ঘন” সামাজিক ও ধর্মীয় স্বীকৃত মতে অগ্রহণযোগ্য এবং এ কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিপর্জয় ঘটেছে। সীমালঙ্ঘন বলতে কি বুঝায়? তত্ব আলোচনায় না গেলেও মোটা দাগে বলতে হয় যে, শপথ ভঙ্গ করা বা ওয়াদা বর খেলাপ একটি স্পষ্ট সীমালঙ্গন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিথ্যাচারও শপথ ভঙ্গের পর্যায়ভুক্ত। মিথ্যাকে সত্যের পরিনত করার প্রচার গুজবেরই একটি নামান্তর, তারপরও বিষয়টি চলছে বিনা দ্বিধায় বা বিনা বাধায়। জনগণ যখন ছাপোষা একটি প্রাণী হিসাবে ব্যবহ্নত হয় তখন মিথ্যার প্রতিবাদ করার জন্য মেরুদন্ড আর সোজা রাখতে পারে না। মেরুদন্ড সোজা রাখার জন্য সে সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন তার অভাবটাও এখানে একটি অন্যতম কারণ। সৎ সাহস এবং শক্ত বিবেক সম্পন্ন একটি মানুষ নিজে অন্যায় করবে না এবং কোন অন্যায় কাজ কারো উপর চাপিয়ে দিবে না, অন্যদিকে যে কোন অন্যায় শক্র মিত্র যারই উপরই হউক না কেন জুলুম/নির্যাতনের প্রতিবাদে পাথড় ও পাহাড়ের মত দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ/প্রতিরোধ করে যাবে এমন ব্যক্তিকেই গণমানুষ নেতা হিসাবে খোজ করে। কিন্তু নেতার মঞ্চের বক্তব্য ও ব্যক্তি চরিত্রের সাথে যখন গড়মিল দেখা দেয় তখনই গণমানুষ আর আস্থা রাখাতে পারেনা। তখন থেকেই শুরু হয় নেতৃত্বের বিপর্যয়।
একটি রাষ্ট্রের জনমানুষ যদি গুম, খুন, ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, সিঁধেল চুরি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুরির ভিকটিম হয় তখন ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রকৃতিকে এগিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা থাকে না বলেই “প্রকৃত”কে এগিয়ে আসতে হয়। পিতার হাতে পুত্র খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন, মায়ের হাতে শিশু সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা খুন, শিক্ষক কর্তৃক সিরিজ আকারে ছাত্রী ধর্ষণ, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ করে হত্যা এর পরও যদি “প্রকৃতি” নিরব নিস্তব্দ হয়ে যায় তবে তা নিরীহ নিপীড়িত মানুষের আস্থা রাখার কোন জায়গা থাকে না। তাই ভ‚পেন হাজারিকেও আক্ষেপ করে গাইতে হয়েছে (এতো অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করে) “ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?” তবে “প্রকৃতির” ক্ষেত্র বিশেষে কাউকে ক্ষমা করতে জানে না, যদিও তার দয়াতেই পৃথিবী ও সভ্যতার সৃষ্টি।
মশা একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রাণী। একটি লেংরা অর্থাৎ বিকলাঙ্গ মশা দিয়ে তৎকালিন সময়ের সর্ব শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারকে ধ্বংস করার ইতিহাস জানার পরও ডেঙ্গু নামক মশাকে ছোট করে দেখার কোন কারণ নাই। ডেঙ্গু সমাধানে সিটি কর্পোরেশন তথা সরকার ব্যর্থ, কিন্তু এ ব্যর্থতার দায় প্রতিপক্ষের নিকট চাপানোই এর সমাধান নহে, বরং জনগণের নিকট হাস্যকর হতে হয়। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে রোগী ভর্তি হওয়ার জায়গা নাই, বলা হচ্ছে তিনটি জেলা বাদে দেশের সকল জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, ডেঙ্গু মশা যেন আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে না দাড়ায় এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি সকল প্রকার পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার ওয়াদা করে পরম করুনা ময় সৃষ্টি কর্তার নিকট তওবা করার এখনই সময়। বিশেষ করে যারা শপথ করে সাংবিধানিক দায়িত্বে আসন গ্রহণ করে জনগণের অধিকার সংরক্ষন না করে বরং মিথ্যাচার দিয়ে মিথ্যাকে সত্যে পরিনত করেছেন তাদেরও তওবা করা অত্যন্ত জরুরী। ভবিষ্যতে শপথ পূর্বক জনগণের অধিকার সংরক্ষনে সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত হবেন এ তওবা যেন তাদের যাত্রা পথের পাথেয় হয়ে থাকে।
বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকা বলেছে যে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি হচ্ছে। চক্ষু বন্ধ করে রাখলে তো আর প্রলয় বন্ধ হবে না। সমাধান খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র বা সরকারের নিকট মেয়র বড় বিষয়। কিন্তু মেয়রদের হাম্ভরা ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে, তাদের হাক ডাকেই ডেঙ্গু মশা ঢাকা থেকে পালাবে। কিন্তু কার্যত: এটাই প্রমাণিত হলো যে, মশার ঔষধ আমদানী করা হয়েছে তার মানসম্মত নয় বা এর কোন কার্যকারিতা নাই। এখন সব কিছুতেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে কোন সংকট মোকাবেলার জন্য সর্বদলীয় সভা ডাকা হয় এবং সকলের পরামর্শ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতিগত শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু এ ধরনের কোন পরামর্শ সভা করতে সরকার নারাজ, যেমনটি করা হয় নাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কল্পে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতিগতভাবে আরো প্রকট ভাবে দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা নিজেরাও সীমাহীন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তারা নিজের দেশে যেতে পারছে না, অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকেও অন্য কোন রাষ্ট্রে যাওয়ার সকল পথও তাদের জন্য বন্ধ রয়েছে। ফলে সমুদ্রে ডুবে যাওয়াটাই যেন তাদের সামনে একটি খোলা পথ। ফলে কাজের সন্ধানে রোহিঙ্গাদের কাঠের নৌকায় সমুদ্র অতিক্রম করতে যেয়ে জেনে শুনে শলীল সমাধির জন্য বিশ্ব সভ্যতার বুক কাপে না। এটাও একটি গজবের নামান্তর।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন