সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সরকারের নমনীয়তার আভাস : জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন

প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৪ পিএম, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬

মোবায়েদুর রহমান : গত সোমবার ২৫ জানুয়ারি বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাটের সুদীর্ঘ বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তুমুল জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। আনুমানিক ২ ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক চলে। এর মধ্যে বেশ কিছু সময় তাদের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক হয়। বোধগম্য কারণেই এই বৈঠক নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান রঙ্গের জল্পনা কল্পনার ফানুস উড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো মিডিয়া এই মর্মে রিপোর্ট করেছে যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন। কেউ কেউ এতদূর বলছে যে, বিএনপির আগামী কাউন্সিল নির্বাচনে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, হাইকমান্ডের দুই নম্বর ব্যক্তি এবং বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের ভূমিকা কী হতে যাচ্ছে সেটি বিশেষভাবে জানতে চেয়েছেন মার্কিন দূত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এসব রিপোর্টকে উড়িয়ে না দিলেও বলছেন যে, তারেক রহমান বা এই ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয় তাদের আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি বরং বেগম জিয়া এবং বিএনপির অন্যান্য নেতা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেভাবে রাষ্ট্রদূতের কাছে তুলে ধরেছেন এবং এ ব্যাপারে সংকট সমাধানে বিএনপির অবস্থান যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেটি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গ
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বেগম জিয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে মার্কিন সরকার এবং পশ্চিমা বিশে^র কাছে এই বার্তা দিয়েছেন যে, পশ্চিমারা এসে তার দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিক, এমন অনুরোধ তিনি তাদের করছেন না এবং এমন প্রত্যাশাও তার নাই। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, দেশের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ এখন আর সরকারের সমর্থক নয়। তারা এই সরকারের পরিবর্তন চায়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ পথ প্রতিনিয়ত রুদ্ধ করা হচ্ছে। দেশের জনগণ চায় দেশে এমন একটি পরিবেশ সরকার সৃষ্টি করুক যেখানে জনগণ বিনা বাধায় শান্তিপূর্ণভাবে এবং কোনোরূপ সহিংসতা বা জোর জবরদস্তির বাইরে তারা ভোট দিতে পারেন। বেগম জিয়া নাকি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন যে, দেশের সিংহভাগ মানুষ বিএনপি তথা বিরোধী দলের সাথে আছে। কিন্তু জনগণ যে তাদের সাথে আছে সেটা প্রকাশ করার মতো রাজনৈতিক পরিবেশ দেশে নাই। গত ৫ জানুয়ারি মাত্র ১২ ঘণ্টার নোটিশে বিএনপির জন সভায় যে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল সেটি প্রমাণ করে যে, জনগণ কোন দিকে আছে।
কিন্তু প্রকাশের স্বাধীনতা নাই
জনগণ নির্ভয়ে এবং অবাধে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে না। দীর্ঘ ১ বছর পর বিএনপিকে সভা করতে দেওয়া হয়েছে, তাও মাত্র ১৮ ঘণ্টার সময় দিয়ে। বিএনপি কোনো মিটিং মিছিল তো দূরের কথা, কোনো সেমিনার এবং মানববন্ধনও করতে পারে না। এখনো বিএনপির হাজার হাজার নেতা ও কর্মী কারাগারে এবং হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর পলাতক জীবনযাপন করছেন। গত বুধবারও বিএনপির প্রাক্তন এমপি ছাত্র দলের সাবেক সভাপতি শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অশতিপর বৃদ্ধ নেতা (৮৬) এম.কে. আনোয়ারকে জামিন দিয়েও ছাড়া হয়নি। এখনো তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে কারাগারে রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা আরো করুন। যুদ্ধাপরাধের বিচারে ইতিমধ্যেই ৩ জন শীর্ষ নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ফাঁসির অপেক্ষায় রয়েছেন জামায়াতের প্রধান মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মীর কাসেম আলী। কারাগারেই মৃত্যু হয়েছে অধ্যাপক গোলাম আযমের। এছাড়াও আরো ১০ জন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলমান। জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ দল নয়। তারপরেও জামায়াতের নেতাকর্মীদের কোথাও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। মিছিল মিটিং মানববন্ধন তো দূরের কথা, জাময়াত বা শিবিরের কোনো নেতার অবস্থানের কোনো খবর পেলে সাথে সাথে পুলিশ সেখানে হানা দিচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আইনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।
বিএনপি চায় রাজনীতির
সুস্থ পরিবেশ
দেশের বর্তমান শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে সবিস্তরে বর্ণনা করেছেন বেগম জিয়া। দেশের এক শ্রেণীর মিডিয়া এমনভাবে বিএনপিকে চি‎িহ্নত করছে যেন বিএনপিকে বিদেশি শক্তি বিশেষ করে পশ্চিমারা হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। বিশ^স্ত সূত্র জানিয়েছে যে, বিএনপি চায় দেশে রাজনীতি করার সুস্থ পরিবেশ। সঙ্গত কারণ ছাড়া বিএনপি এবং তার অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হবে না, বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সভা, সমিতি ও মিছিল মিটিং করার পারমিশন দিতে হবে। এসব কিছুই করবে বিএনপি গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রীতি-নীতি মেনেই। একটি সূত্র জানাচ্ছে যে, মার্কিন সরকার বার্নিকাটের মাধ্যমে জানতে চেয়েছে যে, দেশে যদি কোনো সাধারণ নির্বাচন হয় এবং সেই নির্বাচন যদি বর্তমান সরকারের অধীনেও হয় তাহলে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না। ঐ সূত্র জানিয়েছে যে, বিএনপি নাকি তার আগের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। বিএনপির অভিমত এই যে, যদি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দেওয়া হয়, যদি সেই নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবাধে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়, যদি জনগণ নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টরা বিনা বাধায় কাজ করতে পারে এবং যে হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আছে তাদের যদি মুক্তি দেয়া হয় তাহলে বিএনপি এই সরকারের অধীনেও পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনা করতে পারে।
এইচআরডব্লিউয়’র রিপোর্ট সরকারের
ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে
এদিকে আমেরিকাভিত্তিক ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটি সরকারের জন্য ড্যামেজিং হয়েছে বলে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মকভাবে আক্রমণের মুখে পড়েছে।
‘ইধহমষধফবংয: এড়াবৎহসবহঃ ঝযঁঃং উড়হি ঈৎরঃরপং’ শিরোনামের এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সরকার বাংলাদেশে বিরোধী মতের লোকজনের কণ্ঠস্বর দমাতে সক্রিয় রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ করছে, আদালত অবমাননার মামলা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট মামলা দায়ের করার মাধ্যমে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মন্তব্য করেছে।
সংস্থাটি বলছে নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ গতবছর কঠিন সময় পার করেছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়।
এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একজন সাংবাদিকের মতামত প্রকাশের অধিকার এবং ন্যায্য সমালোচনার পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ৪৯ জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।’ সংস্থাটি বলছে, সরকারের সমালোচনাকারী গণমাধ্যমগুলো হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে নতুবা সাংবাদিক এবং সম্পাদকরা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেছেন, মনে হচ্ছে সংসদের বাইরেও শেখ হাসিনার সরকার কোনো বিরোধী কণ্ঠকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না।
জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির অনেক সদস্য গ্রেফতার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের আতংকে রয়েছে বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়।
সরকারের নমনীয়তার আভাস
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, দেশী এবং বিদেশী বিরূপ সমালোচনার মুখে সরকার নাকি বেশ কিছুটা নমনীয় হয়েছে। জানা গেছে যে, বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপির ব্যাপারে সরকার নাকি তার চরম হার্ড লাইন আংশিক শিথিল করে দলটিকে কতগুলো শর্তের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার সুযোগ দেবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন