শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

নামাজের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক উপকারিতা

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১৮। আনুগত্য ও এতায়াত : জমাআতের সুষ্ঠু পরিচালনা একজন ইমামের অনুগত না হওয়া পর্যন্ত মোটেই সম্ভব নয়। যার ইশারায় জমাআতের প্রতিটি লোক উঠা-বসা করবে। মুসলমানদের জমাআতে নামাজ আদায়ের ভিতর এই গূঢ় রহস্যটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ইসলামের এবাদত নির্বাহ করার ক্ষেত্রে যেমন একজন ইমামের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যার ইশারায় প্রত্যেক মোক্তাদি উঠা-বসা করে ঠিক তেমনি সম্পূর্ণ মুসলিম জমাআতের একজন ইমাম বা নেতা হওয়াও আবশ্যক। যার মুখ নি:সৃত আল্লাহ আকবার ধ্বনি কাওমের প্রতিটি সদস্যের অন্তরে ঘণ্টার আওয়াজ ও প্রাণবন্ত উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে সক্ষম। ইমামের আনুগত্যের জন্য একদিকে গোত্র বা কাওমের লোকদের মাঝে একান্ত নিষ্ঠা ও আনুগত্য প্রকাশের যোগ্যতা থাকা চাই, যার শিক্ষা মোক্তাদিগণকে নামাজের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। অপরদিকে ইমামকে নির্মল চরিত্রের এমন একটি উদাহরণ পেশ করা দরকার যা সব সময় মানুষকে সুপথে পরিচালিত করতে সহায়তা করবে এবং মানুষ যাকে হেদায়েতের মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ ও বরণ করে নিবে। নামাজের মাঝে এই উভয়বিধ গুণাবলীর সুন্দর সমাহার লক্ষ্য করা যায়। তা এমন একটি সার্বক্ষণিক কার্যক্রম বা কাওম ও শ্রেণীর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অংশের মাঝে সার্বক্ষণিক আনুগত্যের প্রস্তুতি সুসম্পন্ন করে। এ কারণে পাঞ্জেগানা নামাজ এবং জুমআ ও উভয় ঈদের নামাজের ইমামত নির্দিষ্টভাবে এমন এক ইমামের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া দরকার যার জন্য শ্রেণী বিশেষের প্রতিটি মানুষ তার উত্তম আদর্শ ও চরিত্রের কারণে আকর্ষণ অনুভব করতে পারে।। নামাজের মাধ্যমে এই সুযোগটি কাজে এবং চিন্তা-চেতনার মাঝে বিকশিত হয়ে উঠে। আর নামাজের সময়সমূহ এমন সুবিন্যস্তভাবে নির্ধারিত করা হয়েছে যার মাধ্যমে একজন আরামপ্রিয় ও সুখ প্রত্যাশী মানুষের সঠিক চিত্র ফুটে উঠে। একজন মানুষ যে রাতভর আমোদ-প্রমোদ ও সুখ-সন্তোগের মাঝে অতিবাহিত করে সে কখনও যথার্থ সময়ে নামাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাছাড়াও একজন আরামপ্রিয় লোক যোহরের সময়ে সূর্যের প্রখর উত্তাপ উপেক্ষা করে জমাআতে অংশগ্রহণ করার প্রতি মোটেই অনুপ্রাণিত হয় না। যেমনটি আমরা দেখতে পাই খেলাফতে রাশেদার পর যখন বনু উমাইয়ার শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। তখন সাহাবীগণ এই অবস্থাটিকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন এবং তাদের মাঝে নির্ভিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন সত্তাগণ এ অবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন হাদীসেও এই সংকটময় কালের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, এমন একটা সময় আগমন করবে, যখন নামাজের জন্য নিয়োজিত ইমামগণ নামাজ আদায়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করবেন।

১৯। মর্যাদার মানদÐ : মর্যাদা ও সম্মান সর্বোতভাবে জ্ঞান ও মনীষা, তাকওয়া ও পরহেজগারীর উপর নির্ভরশীল। নামাজের ইমামতের দায়িত্ব তিনিই পালন করতে পারেন যার মাঝে রয়েছে জ্ঞান ও মনীষার আলোকচ্ছটা এবং তাকওয়া ও পরহেজগারীর প্রাণবন্ত রূপ। এ সকল গুণাবলীর অধিকারী প্রত্যেক মুসলমান যে কোনও সময় ইমামের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, “জমাআতের লোকদের মাঝে যে সবচেয়ে জ্ঞানী (উত্তম কেরাআত পাঠকারী) সেই ইমামতের দায়িত্ব পালন করার অধিক হকদার।” একবার কোনও এক স্থানের কতিপয় লোক ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আগমন করল। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল যে, তাদের মাঝে যে সবচেয়ে কম বয়সী সে কুরআনুল কারীমের অধিকতর অংশের হাফেজ। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা:) এই কম বয়সী সাহাবীকেই তাদের ইমাম নিয়োগ করলেন। এর দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, জ্ঞান ও মনীষার অধিকারী ব্যক্তির নিকট হতে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার বিষয়াদি অর্জন করতে পারবে এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি ক্রমাগত আর্কষণ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি লাভ করবে।

২০। প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ অনুষ্ঠান : রাসূলুল্লাহ (সা:) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এই নিয়ম চালু ছিল যে, যখন কোনও জটিল ঘটনা ও সমস্যাবহুল অবস্থা দেখা দিত কিংবা কোনও রাজনৈতিক ও গোত্রীয় সমস্যার উদ্ভব হত অথবা ধর্মীয় কোনও ফরমান জারী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত, তখন মুসলমানদের মাঝে এই ঘোষণা জারী করা হত যে, আস্সালাতু জামেয়াতুন (নামাজ সমবেতকারী) এই ঘোষণার সাথে সাথে নির্দিষ্ট সময়ে সকল মানুষ জমায়েত হত এবং পরামর্শলব্ধ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত হত। আবার কখনও কখনও উদ্ভুত সমস্যা সম্পর্কে নিজেদের রায় ও পরামর্শ উপস্থাপন করত। প্রাত্যহিক জীবনের এই সাধারণ অধিবেশন মুসলমানদের ধর্মীয় একতা ও রাজনৈতিক সমস্যাবলীর একান্ত দিক নির্দেশনার উপলক্ষ বলে বিবেচিত হত। যার জন্য নামাজের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি মুসলমান নিজেদের দুর্বলতা ও অবহেলার ভার চিরতরে দূরীভূত করে সুষ্ঠু মত ও পথের সন্ধানে ছুটে বেড়াত।

উপরোক্ত বিষয়াবলীকে সামনে রাখলে একথা সহজেই প্রতিপন্ন হয় যে, নামাজ হচ্ছে ইসলামের প্রাথমিক চিহ্ন ও নমুনা এবং এতেই নিহিত রয়েছে ধর্মীয়, সমষ্টিগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক উদ্দেশ্যসমূহের সুনির্মল দর্পণ। এরই সুদৃঢ় সেতু বন্ধনের দ্বারা মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হয়ে উঠে। আর এই বন্ধনের গিঁট যদি খুলে যায়, তাহলে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার যাবতীয় বন্ধন হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা ও অসামঞ্জস্যতার প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ। তাই মসজিদ হচ্ছে মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকাÐের মূল কেন্দ্রস্থল। নামাজ এই কেন্দ্রীয় নিয়মতান্ত্রিকতা ও সাংবিধানিক প্রতিক্রিয়ার জন্য অত্যাবশক বিধায় আজও প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রারম্ভ এর নিয়ম-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সঠিক দিক নির্দেশনা এ স্থান হতেই খোতবা বা ভাষণের মাধ্যমে সাধারণ্যে প্রকাশ পায়। অনুরূপভাবে মুসলমানগণ যখন পৃথিবীর বুকে জীবন্ত সত্যের প্রতীকরূপে পদচারণা করতেন, তখন তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যাবতীয় কর্মকাÐের সুভ সূচনা রচিত হত মসজিদকে কেন্দ্র করে। তাদের সকল কাজ-কর্ম মসজিদের ছত্রছায়ায় এবং নামাজভিত্তিক নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে পরিসাধিত হত। বস্তুুত : তাদের নামাজের গৃহই ছিল নির্দেশ প্রচারের উত্তম মঞ্চ। সেখানেই পরামর্শ সভার আয়োজন করা হত এবং সেখানেই বায়তুল মালের মত রাজকোষের প্রতিষ্ঠা করা হত এবং সেখানে হতেই যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়াদির ফায়সালা ও নির্দেশ প্রদান করা হত এবং মসজিদই ছিল তাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পবিত্রতম ইবাদতের স্থান।

কোনও একটি বিশেষ শ্রেণী বা জামাআতের যাবতীয় উন্নতির বুনিয়াদ হচ্ছে, ব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সংযোগের উপর। এতে করে জমাআতের উপকারিতার জন্য ব্যক্তি মানুষের প্রতিটি আরাম-আয়েশ এবং উপকারিতাকে কোরবানী করতে হয় এবং পারস্পরিক বিভেদ-বিসংবাদ পরিহার করে একই কেন্দ্রে সমবেত হয়ে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে হয়। যার ফলে জমাআত বা সমষ্টিগত জীবনের রূপরেখা প্রতিফলিত হয়ে উঠে। এই নিয়মশৃঙ্খলাকে কায়েম রাখার জন্য কোনও একজন ইমাম, নেতা এবং সেনাপতির নির্দেশ মেনে নিয়ে এবং তার নির্দেশ পালনের শপথ গ্রহণ করা খুবই দরকার। ইসলামের নামাজ রূপ ইবাদতের মাঝে এ সকল আভ্যন্তরীণ রহস্য ও গোপন শক্তির আধার প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা মুসলমানদের নিয়ম-শৃঙ্খলা, জমাআতের পাবন্দি, আনুগত্য প্রকাশ এবং ফরমাবরদারি ও একই কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে পরিচালিত হওয়ার শপথ দৈনিক পাঁচবার প্রদান করে। তাই নামাজের প্রাণবন্ত রূপের প্রতিফলন ছাড়া কোনও মুসলমান প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। এমন কি তাদের মাঝে সমবেত একক নীতিমালার প্রকাশও ঘটে না। শুধু তাই নয়, একই ইমামের আনুগত্যহীন জীবনের মাঝে প্রকৃত জীবনের মাধুর্য প্রকাশ পায় না। আর এই ছন্নছাড়া জীবন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন হতে বাধ্য। এ কারণে ইসলামের আহŸানকারী আমাদের প্রিয় নবী রাসূলে পাক (সা:) ইরশাদ করেছেন, “আমাদের মাঝে এবং তাদের মাঝে যে অঙ্গীকার রয়েছে তাহল নামাজ। সুতরাং যে নামাজ পরিত্যাগ করল সে মূলত: কুফুরীর কাজকেই প্রতিষ্ঠিত করল।”(আহমদ, তিরমিজী, নাসায়ী এবং ইবনে মাজাহ) এই নির্দেশের নিরিখে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নামাজকে ছেড়ে দিলে মুসলমানদের অবস্থা দাঁড়ায় প্রাণহীণ দেহ, মাদকতাবিহীন পানীয় এবং রং ও গন্ধহীন ফুলের মত এবং এরই ফলশ্রæতিতে ইসলামী জমাআতের এক একটি নিদর্শন ও চিহ্ন অবলুপ্ত হতে থাকে এবং বৈশিষ্ট্যমÐিত গুণাবলী বিদায় নিতে থাকে যা কোনও মুমিনের কাম্য হতে পারে না। এজন্য নামাজ হচ্ছে ইসলামের প্রাথমিক ও প্রধান চিহ্ন এবং এর প্রাণবন্ত রূপরেখার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামী জিন্দেগীর আসল রূপরেখা। (চলবে)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন