মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

এতিম-মিসকিনের পেটে এবার লাথি

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চামড়ার বাজারে মহা বিপর্যয়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কোরবানির চামড়ার মূল্য কম হওয়ায় মাদরাসার অসহায় গরিব ছাত্র, এতিম, ফকির, মিসকিনরা বছরের একটি আয় থেকে বঞ্ছিত হলো। আর সেই টাকা ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। গরিব-মিসকিনের হক কোরবানির পশুর চামড়ার টাকা কোটিপতি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের পেটে যাচ্ছে। তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার মূল্য কমিয়েছে; অথচ দায়িত্বশীলদের কারোরই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনযন্ত্র নড়েচড়ে বসেছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানি করা হবে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রীরা বলেছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সিন্ডিকেটের কারণে এবার কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দামে মহা বিপর্যয় ঘটেছে। এই চামড়ার দামে বিপর্যয় ঘটলেও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও চামড়া ব্যবসায়ীদের কোনো লোকসান হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ট্যানারি পর্যন্ত চামড়া পৌঁছাতে চার স্তরের হাতবদলের যে চক্রটি কাজ করে তাদের কেউ এবার লোকসানও দিচ্ছে না। তবে ভয়াবহভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন গরিব-মিসকিন ও মাদরাসার লিল্লাহ বোডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করা এতিমরা। সেই খাবার কোটিপতি ট্যানারি মালিক ও ব্যবসায়ীদের পেটে যাচ্ছে।

কোরবানির চামড়া সাধারণত গরিব-মিসকিন ও এতিমের হক। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গরু, মহিষ, ছাগল বা হালাল পশু কোরবানি করেন, তারা সেই পশুর চামড়া বিক্রির টাকা স্থানীয় মাদরাসার গরিব ছাত্র, এতিম-মিসকিন বা গরিব মানুষের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে থাকেন। হাজার বছর ধরে এই রেওয়াজ চলে আসছে। কিন্তু কয়েক বছর হলো সেই চামড়ার দাম পাচ্ছেন না পশু কোরবানিদাতারা। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা জোর করে কম মূল্যে পশুর চামড়া বিক্রিতে বাধ্য করছেন; অন্যদিকে চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছেন। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এমন কমা কমেছে যে, বিক্রির জন্য ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লাখ টাকার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০-৪০০ টাকায়। চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে মাটিতেই পুঁতে দিচ্ছেন। সরকার পশুর চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও উত্তরাঞ্চলে ছাগলের চামড়া বিনে পয়সায় দিতে হচ্ছে; আর গরুর চামড়ার দাম সর্বনিন্ম। মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে চট্টগ্রাম সিটিতে হাজার হাজার পশুর চামড়া সিটি কর্পোরেশনের গাড়িতে করে বর্জ্যরে ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ঢাকা এবং উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু স্থানে একই ঘটনা ঘটেছে।

ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটে চামড়া নিয়ে ছেলেখেলা দেখে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছেন, ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। দ্রæত কাঁচা চামড়া রফতানি করে এ সঙ্কট দূর করা হবে। চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত দেখে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। কোনোভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, চামড়ার দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যার বিরুদ্ধে যতটুকু অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ রেহাই পাবে না। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে তিনি আরো বলেন, চামড়ার দামের বিষয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি শুনেছি। সিন্ডিকেটদের একটা চক্র আমাদের দেশে রয়েছে। আসলে এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কারসাজি হয়েছে কি না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা দিতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চামড়া ক্রয়-বিক্রয় নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়েছে, দেখা যাচ্ছে নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না। এ বিষয়ে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কাঁচা চামড়ার গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চামড়া সংরক্ষণের জন্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার লক্ষ্যে কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানি করার সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর সিন্ডিকেটের হোতা বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, আমরা ২০ আগস্ট থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করব। সেই সময় চামড়ার বাজার স্থিতিশীল থাকবে। আশা করছি এই সময়ের মধ্যে সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। সংবাদ সম্মেলনে বিটিএ’র সভাপতি শাহীন আহমেদ আরো বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দিতে যাচ্ছে। এর ফলে শতভাগ দেশীয় এই শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। চামড়া শিল্পনগরীতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেয়া কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

ইসলাম ধর্মে কোরবানির পশুর চামড়ার হকদার নির্ধারিত করা আছে। কোরবানির কাঁচা চামড়া বিক্রির টাকা কোরবানিদাতারা গরিব-মিসকিন ও এতিমদের মধ্যে দান করে থাকেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্যের বাজার চড়া থাকলেও এ বছর সরকারিভাবে কাঁচা চামড়ার দাম গত বছরের দরেই নির্ধারিত হয়েছে। গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সারা দেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা। চামড়া ক্রয়ের জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে ট্যানারি মালিকদের ঋণ দেয়া হয়েছে।

এরপরও কাঁচা চামড়া কেনার ট্যানারি মালিক, পাইকার ও ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই ‘টাকা নেই’, ‘বেশি দামে চামড়া কিনলে বেচতে পারবেন না’, ‘সংরক্ষণ করার প্রস্তুতি রাখুন’, ‘চামড়া পচে যেতে পারে’ ইত্যাদি হুজুগ তোলেন। এতে করে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হন এবং চামড়া কিনেছেন প্রায় বিনামূল্যে। ফলে চামড়ার দাম একেবারেই পড়ে যাওয়ায় কোরবানিদাতারা পেয়েছেন সামান্য অর্থ। ফলে চামড়া ব্যবসায়ে জড়িত সবাই লাভবান হলেও বঞ্চিত হয়েছেন কেবল এতিম ও দুস্থরা। তাদের প্রাপ্য অংশ এবার ভয়াবহভাবে কমে গেছে।

দুই-তিন বছর আগেও লক্ষ করা যেত ঈদের দিন সকাল থেকেই কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের তৎপরতা। গ্রাম-গঞ্জে পাড়া-মহল্লায় চামড়া কেনার জন্য তারা অপেক্ষা করতেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরও দেখা যেত পশু কোরবানির পর চামড়া সংগ্রহ করতে। পশুর চামড়া ক্রয় নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে টানাটানিও দেখা যেত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা চামড়া ক্রয় করতেন জোরজবরদস্তি করে। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারই পশুর চামড়া সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এক লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম দিয়েছেন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা। ৭০ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র দেড়শ’ টাকায়। চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতেও পুঁতে ফেলেছেন। চট্টগ্রামে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করতে এনে চামড়া রাস্তায় স্ত‚প করেন। কিন্তু সে চামড়া বিক্রি না হওয়ায় তা সরিয়ে ফেলার জন্য সিটি কর্পোরেশন তাগাদা দেয়। বাধ্য হয়েই মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া ফেলে রেখে পালিয়ে যান। বাধ্য হয়েই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ট্রাকে করে সে চামড়া বর্জ্যরে ভাগাড়ে ফেলে দেন।

জানতে চাইলে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছে। ফলে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরাই এবার লাভ করতে পারবে বলে আশা করা যায়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গরুর মালিকের কাছ থেকে যে চামড়া এবার ২শ’ টাকায় কিনেছে, সেই চামড়া তারা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছে কিছু লাভে। তবে আমাদের হাতে এই মুহূর্তে সব চামড়া কেনার মতো টাকা নেই। সে জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবার সব চামড়া আমরা কিনতে পারছি না। তিনি জানান, ট্যানারি মালিকরা সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রেখেছেন। টাকার অভাবে ২৪৫ জন আড়তদারের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন আড়তদার চামড়া কিনতে পারছেন।

জানতে চাইলে পাবনার মাওলানা নুর ইয়া-হিয়া হেলাল বলেন, চামড়া বিক্রির টাকা মূলত গরিব, এতিম ও দুস্থদের হক। কাজেই চামড়ার দাম কমে যাওয়া মানেই গরিব, এতিমদের অংশ কমে যাওয়া। চার বছর আগে বড় একটি গরুর চামড়ার টাকা দিয়ে একজন এতিম ছয় মাস চলতে পারত। কিন্তু এবার ওই ধরনের বড় গরুর চামড়ার টাকায় তার এক মাসও যাবে না। ঢাকার এক মাসরাসা শিক্ষক বললেন, কোরবানির পশুর চামড়ার হক গরিব, এতিম বিশেষ করে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা অনাথ ছাত্ররা। কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়ার দরপতন ঘটিয়ে গরিবের হক চামড়ার টাকা ধনীদের পেকেটে যাচ্ছে।

ট্যানারি মালিকরা ১৭ আগস্ট চামড়া কিনবে
এদিকে কাচা চামড়া বিদেশে রফতানি করার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেকায়দায় পড়ে যান। অতপর তারা চামড়া ক্রয়ে নমনীয় হন। এদিকে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মফিজুল ইসলাম চামড়া শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে ডেকে পাঠান। অতপর বিটিএ’র সভাপতি শাহীন আহমেদের নেতৃত্বে নেতারা সচিবালয়ে ছুটে আসেন। বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম ও অতিরিক্ত সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি শাহীন আহমেদের রুদ্ধদার বৈঠক হয়। সেখানে কাঁচা চামড়া কেনার বিষয়ে দাম ও সময় নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনার একপর্যায়ে বাণিজ্য সচিব চামড়া নিয়ে সারাদেশে অসন্তোষের চিত্র তুলে ধরে ২০ আগস্টের আগে থেকেই কাঁচা চামড়া কেনার বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানতে চান। তখন মালিকরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে তারা কাচা চামড়া বিদেশে রফতানি ঠেকাতে আগামী ১৭ আগস্ট শনিবার থেকে চামড়া ক্রয়ে রাজী হন। বৈঠক থেকে বের হয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, সচিবের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমরা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি ১৭ আগস্ট থেকে চামড়া কেনার কাজ শুরু করবো। আশা করছি এ নিয়ে আর কোনও জটিলতা হবে না।


চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, দাম না পাওয়ার ক্ষোভে সোয়া লাখ কোরবানি পশুর চামড়া রাস্তায় ফেলে গেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। কোটি কোটি টাকার এসব চামড়া পচে যাওয়ায় বর্জ্য হিসেবে তুলে নিয়ে আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।

চামড়ার বাজারের ইতিহাসে ভয়াবহ ধসের প্রতিবাদে নজিরবিহীন এই ঘটনা ঘটালেন মৌসুমি ও খুচরা চামড়া বিক্রেতারা। চামড়ার সরকার নির্ধারিত দামও পাননি ব্যবসায়ীরা। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। বঞ্চিত হয়েছেন হতদরিদ্র জনগোষ্ঠি বিশেষ করে মাদরাসা, হেফজখানা, এতিম, মিসকিনেরা। দেশ বঞ্চিত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে। এ ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক উল্লেখ করে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন সরকার নির্ধারিত চামড়ার দাম না পাওয়ার পেছনে কোনো কারসাজি আছে কি না খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার কোরবানির চামড়ার বাজারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীরা শুরুতেই সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। পাইকারি চামড়া ক্রেতা এবং আড়ৎদারের প্রতিনিধিরা মিলে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ চামড়া সংগ্রহকারী মৌসুমী ব্যবসায়ীদের। এই সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার দাম পাওয়া যায়নি। ঈদের দিন সকাল থেকে কোরবানিদাতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনে এনে তা বিক্রি করতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। গড়ে চারশ টাকা করে কেনা চামড়ার প্রতিটি ৫০ টাকায়ও বিক্রি করতে না পারায় অনেকে রাগে ক্ষোভে চামড়া রাস্তায় ফেলে যান। বন্দরনগরী ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা, মাদরাসা ও এতিমখানার সংগ্রহকৃত চামড়াও বিক্রির জন্য ট্রাকে নিয়ে আসা হয় নগরীতে। এসব চামড়াও বিক্রি হয়নি। রাস্তায় ফেলে যাওয়া এসব চামড়ায় পছন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।

এ অবস্থায় মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নগরীর বিভিন্ন রাস্তায় ফেলে দেয়া কোটি কোটি টাকার চামড়া হালিশহর আনন্দবাজার ও আরেফিন নগরের আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলে। পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মীরা জানান, ঈদের পরদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ২০০ শ্রমিক ও ৮টি পে লোডারের সাহায্যে ৩২টি ট্রাকে ৯০ ট্রিপে সোয়া এক লাখ পচা চামড়া অপসারণ করে। নগরীর কাঁচা চামড়ার প্রধান বাজার হামজারবাগ ও আতুরার ডিপো ছাড়াও বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, দেওয়ানহাটসহ বিভিন সড়কে ফেলে যাওয়া পচা চামড়াগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়।

চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের প্রধান শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বলেন, এটি একেবারে অপ্রত্যাশিত কাজ। চাকরি জীবনে এমনটি আর দেখিনি। বড় বড় গরুর সুন্দর সুন্দর চামড়া পচে-গলে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথমে বড় গরুর চামড়া ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। এরপর ২০০-১০০ টাকায় নেমে আসে। তারপর ক্রেতার দেখা মেলেনি বাজারে। চামড়া নিয়ে যেসব ট্রাক এসেছিল অনেকে ভাড়াটাও তুলতে পারেনি চামড়া বেচে। পরে একপর্যায়ে চামড়ার স্তুপ, ট্রাকভর্তি চামড়া ফেলেই চলে যান তারা।

এদিকে অস্বাভাবিক দরপতনের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে ফেলেছেন বলে দাবি করেন নগরীর আতুরার ডিপোর আড়তদারেরা। বাকি চামড়া কয়েকদিনের মধ্যে আড়তে আসবে বলে তাদের ধারণা।

কুমিল্লা থেকে সাদিক মামুন জানান,দুপুরের পর থেকে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়িদের কেউ রিকশা ভ্যানে, কেউ সিএনজি অটোরিকশা, কেউবা ইজিবাইক নিয়ে চামড়া নিয়ে আসতে থাকে কুমিল্লা শহরের ঋষিপট্টি ও বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে কাউন্টার খুলে বসা দাদন ব্যবসায়িদের ধারে। শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকার কুরবানিদাতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাঝারি ও বড় সাইজের চামড়া সংগ্রহ করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে এসে হতাশ হয়ে পড়েন মৌসুমি ব্যবসায়িরা। লাভ তো দুরের কথা চামড়ার কেনা দর পেতে আকুতি মিনতি করতে হয়েছে চামড়ার পাইকারি ব্যবসায়িদের কাছে। মৌসুমি ব্যবসায়িদের অভিযোগ, ঢাকার বড় ব্যবসায়িদের সাথে আঁতাত করে স্থানীয় ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করেই চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছে।

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শেষ পর্যন্ত কুরবানির গরুর চামড়া কিনে ধরাশায়ি হয়েছেন কুমিল্লার মৌসুমি ব্যবসায়িরা। গতবারের লোকসানের কষ্ট ভুলে এবারে লাভের আশায় চামড়া ব্যবসায় নামে মৌসুমি ব্যবসায়িরা। কিন্তু এবারেও তাদের কপাল খুলেনি।

আদমদীঘি (বগুড়া) থেকে মো. মনসুর আলী জানান, বগুড়ার আদমদীঘি ও সান্তাহারে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে মারাত্বক ধস নেমেছে। চামড়ার দাম নিয়ে আগে থেকেই চলছিল নানা গুঞ্জন উঠায় এবার লোকসানের ভয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ী কম থাকায় অসাধু ব্যাবসায়ীরা সিন্ডেকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে এলাকার যেসব মেীসুমি চামড়া ব্যাবসায়ীরা চামড়া কিনেছে তাদের মোটা অংকের লোকসান গুণতে হয়েছে। আবার অনেক ক্ষুদে ব্যাবসায়ী পুঁজি হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া বাজারে চামড়ার দাম না থাকায় শত শত চামড়া ফেলে দিয়েছে এবং পুতে রাখা হয় বলে জানা গেছে।

গফরগাঁও উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গফরগাঁও উপজেলা পবিত্র কোরবানির পশুর চামড়া পানির দরে বিক্রি হয়েছে। এতে করে গরীব ও কওমী মাদরাসা এবং এতিমখানা কোরবানির চামড়ার টাকা হতে বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে মৌসুমি ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে।

নাচোল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে অপেক্ষার পালা শেষে পানির দামে বিক্রি হলো কুরবানির চামড়া। এলাকার পাড়া-মহল্লা থেকে কুরবানির চামড়া এসে জড়ো হচ্ছে মড়ল-সর্দারদের উঠোনে। ভিন্ন ভিন্ন স্তুপ করে রাখা হয়েছে গরু ও ছাগলের চামড়া। কিন্তু ক্রেতা-ফড়িয়াদের নেই কোন হুড়োহুড়ি।

নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, নাসিরনগর উপজেলায় সদর ইউনিয়নসহ ১৩টি ইউনিয়নে এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম না থাকায় জবাই করা পশুর চামড়া নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে পড়তে দেখা গেছে। চামড়া পানির দরে বিক্রি হয়েছে অনেকে আবার গর্ত করে দিয়েছে মাটি চাপা।

পাবনা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, পাবনাতে কোরবানির পশুর চামড়া অস্বভাবিক দরপতন ঘটেছে। গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৫শ’ টাকা আর ছাগলের চামড়ার দাম না বলার মতোই। শহরে ৪০ টাকা, গ্রামগঞ্জে ১০ থেকে ২০টাকা দরে ফরিয়া ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ক্রয় করেছেন। এতো কম দামে চামড়া ক্রয় করে এই চামড়া প্রতিবেশী দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গত বছর পবিত্র কোরবানী ঈদে এই রকম দাম কমেনি। হঠাৎ এবার দরপতন !

মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, মঠবাড়িয়ায় কুরবানির পশুর চামড়ার মূল্যে স্মরণ কালের ভয়াবহ ধস নামে। চামড়া ক্রয়ে অসাধু মৌসুমি ব্যবসায়িদের সিন্ডিকেটের কারণে পানির দামে চামড়া বিক্রি হওয়ায় লাখ লাখ টাকায় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে ইয়াতিম মিসকিনরা। গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার মূল্য কমতে কমতে এবছর পানির মূল্যে চামড়া বিক্রি হয়েছে। অনেকে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে চামড়া মাটিতে পুতে অথবা খালে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে।

সিরাজদিখান (মুন্সীগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজদিখান উপজেলায় এবারও কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রিতে লোকসানের কবলে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে টানা চার বছর ধরে এ উপজেলার ব্যবসায়ীরা চামড়ায় লোকসানের কবলে পড়েছেন। পাঁচ বছর আগেও যে চামড়া বিক্রি হতো ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে। চলতি বছর কোরবানীর পশুর চামড়া সেখানে ২০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। তবে কাঁচা চামড়া লবন দিয়ে এক মাস থেকে ২ মাস সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এতে চামড়া প্রতি ৮ থেকে ১০ কেজি লবনের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
Ferdous ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫১ এএম says : 0
মাদ্রাসা, এতিমখানা ধ্বংসের মূল কারিগর কারা, সেটা জাতি না জানলেও মহান আল্লাহ জানেন। দোয়া করি যারা এতিমদের এতো বড় সর্বনাশ করেছে, আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন
Total Reply(0)
Md Anwar ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫১ এএম says : 0
যাদের কারনে গরীবের হক, মাদ্রাসার সারা বছরের খরচের যোগান নষ্ট করছে,আল্লাহ তাদের উচিৎ বিচার করুক,দুনিয়া, আখেরাতে
Total Reply(0)
Mohammad Ashraf Uddin ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫১ এএম says : 0
খুবই দুঃখজনক। চামড়া সিন্ডিকেটের উপর আল্লাহর লানত পড়ুক।
Total Reply(0)
Saleh Ahmed Tapu ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫২ এএম says : 0
আসুন আমরা আগামী ১ বছর চামড়াজাত পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকি। ইনশাআল্লাহ দেখবেন এর একটা নিরব প্রতিক্রিয়া ঘটবে।
Total Reply(0)
Swapan Hasnat ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫৩ এএম says : 0
মহান আল্লাহ এই মাদ্রাসার এতিম দের রিজিক এর ব্যবস্থা ঠিকই করবেন কিন্তু এই সিন্ডিকেট চামড়া ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যৎ কি? এরা যদি আজকে জানতে পারত।।
Total Reply(0)
Chowdhury Tahmid ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫৪ এএম says : 0
এক সময়ে চামড়ার জন্য মারামারি হতো পাড়া মহোল্লায়,সেই চামড়া এখন দালালের থাবায় পড়েছে, ইয়াতিমের হক নষ্টকারিদের আল্লাহ কঠিন ভাবে বিচার করবেন
Total Reply(0)
মাঈশা আফরোজ নুপূর ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৩:৫৫ এএম says : 0
দায়ী ব্যাক্তিদের দৃষ্টান্তমলূক শাস্তি চাই
Total Reply(0)
Md anwar ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৬:০৪ এএম says : 0
যারা এতিমের হক নস্ট করেছে। তাদের বিচার আল্লাহর জমিনে হবেই ইনশাল্লাহ।
Total Reply(0)
Tajul Islam ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৯:৫০ এএম says : 0
এর বিচার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম
Total Reply(0)
Mohamad Rafiqul Islam ১৫ আগস্ট, ২০১৯, ৯:৫২ এএম says : 0
সিন্ডিকেট কোথায় নেই? সাধারণ মানুষকে মারার এই সিন্ডিকেট আমাদের এই ঘুনে ধরা সমাজে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন