বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

হঠাৎ করে গত ৫ আগস্ট ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্লামেন্টে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার ঘোষণা দেন। এই মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়, যাতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরও করেছেন। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ফলে জম্মু এবং কাশ্মীর ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে। উপরন্তু লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। দু’টি জায়গাতেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। তবে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা বহাল থাকবে। লাদাখের ক্ষেত্রে কোনও বিধানসভা থাকবে না। স্মরণীয় যে,৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর অন্য যেকোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো। এই ধারাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর ভিত্তিতেই কাশ্মীর রাজ্য ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়। দ্বিতীয়ত রাজ্যটি নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ বাদে অন্য সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়। উপরন্তু কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতে ও সেখানে ব্যবসা করতে পারেন। যা’হোক, উক্ত ঘোষণা হঠাৎ করে দেওয়া হলেও কাশ্মীরে যে একটা কিছু ঘটতে চলেছে তা বিশ্ববাসী আন্দাজ করতে পেরেছিল কয়েকদিন আগেই। কারণ, আকস্মিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে ১০ হাজার সেনা প্রেরণ, অমরনাথযাত্রা বাতিল ও সব পর্যটককে দ্রæত উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এতেই প্রতীয়মান হয়েছিল-কাশ্মীরে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হতে পারে এমন আশংকাও সৃষ্টি হয়েছিল জনমনে। ফলে সেখানের লোকদের মধ্যেও আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল। তৎপ্রেক্ষিতেই রাজ্যপাল এক বিবৃতিতে গুজবে কান না দেওয়া জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন । যা’হোক, কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসনের বিধান বিলোপ করার ঘোষণার সাথে সাথে সমগ্র কাশ্মীর চরম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে, কারফিউ জারি করেছে। এছাড়া প্রাক্তন দু’মুখ্যমন্ত্রীসহ সব শীর্ষ নেতাদেরকে প্রথমে গৃহবন্দি পরে গ্রেফতার দেখানো হয়। পুরো উপত্যাকায় মোবাইল ইন্টারনেট, মোবাইল পরিসেবা ও ল্যান্ড লাইন স্থগিত করা হয়। মোতায়েনকৃত ৫.৩৮ লাখ সেনা টহল দেওয়া শুরু করে। রাজ্যের সব শিক্ষাঙ্গন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি অন্য সব ক›টি রাজ্যেও চরম সতর্কতা জারি এবং সেনা ও বিমানবাহিনীকে উচ্চসতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। অন্যদিকে, উক্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ভারতের পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সদস্যরা চরম হট্টগোল করেন। এছাড়া, সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। এমনকি এ নিয়ে সারাবিশ্বেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ কঠোর প্রতিক্রিয়া জানান। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মিডিয়ায় বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এক টুইটে বলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে যোগ না দেওয়া ভুল ছিল আর এক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ এক টুইটে বলেন, ’সরকারের এই পদক্ষেপ কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ করেছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে’। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের যে অনন্য চরিত্র, কলমের এক খোঁচায় বিজেপি সেটাই বরবাদ করে দিতে চাইছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সীমান্তবর্তী রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর এমন একটি প্রদেশ, যার সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি সবই বাকি দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এই রাজ্যের লাদাখে বৌদ্ধ ও মুসলিমরা থাকেন, কাশ্মীরে থাকেন মুসলিম, পন্ডিত ও শিখরা। আর জম্মুতে জনসংখ্যার ৬০% হিন্দু, বাকি ৪০% মুসলিম। এমন একটি রাজ্যকে যদি কেউ এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারে, সেটা ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এই ধারায় রাজ্যের সব ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের জন্যই বিশেষ ব্যবস্থা ছিল-যা আজ বিজেপি শেষ করে দিল’। তৃণমূলসহ অন্য কিছু বিরোধী দলের সাংসদরা তার এই বক্তব্যকে সমর্থন জানান। সিপিআই নেতা ডি রাজা বলেন, নরেন্দ্র মোদি ও হিটলারের মধ্যে পার্থক্য কী আছে? কাশ্মীরের শেষ অধিপতি মহারাজা হরি সিংয়ের ছেলে ও লোকসভার কংগ্রেস সাংসদ ডঃ করণ সিংও এই বিলের বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিজেপি কাশ্মীর নিয়ে যে পন্থাই গ্রহণ করুক তাতে বৈপ্লবিক কিছু ঘটবে না। কারণ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান অত সহজ বিষয় নয়। তাই ৩৭০ ধারা বিলোপ করে যদি মোদি মনে করেন, বিরাট কিছু ঘটিয়ে ফেলেছেন বা কাশ্মীর আর আগের মতো থাকবে না তাহলে ভুল ভাবছেন। কারণ, কাশ্মীর সমস্যা বড় জটিল একটি বিষয়। কারোর হাতেই সেই ম্যাজিক বুলেট নেই, যাতে রাতারাতি কাশ্মীর সমস্যা মিটে যাবে’। এর আগে তিনি পার্লামেন্টেও বলেছেন, ’যে শর্তে তার বাবা নিজের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, দিল্লি তার মর্যাদা দিতে পারেনি। যেদিন আমার বাবা সেই চুক্তিতে সই করেন সেদিন থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২৭ অক্টোবর তারিখে সেদিন আমি নিজেও ওই ঘরে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহারাজা কিন্তু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক শুধু ভারতভুক্তি স্বীকার করেছিলেন, নিজের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দেননি’। সিপিআই(এম) নেতা টিকে রঙ্গরাজন বলেন, বিশেষ মর্যাদা বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরে আরেক ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করছে বিজেপি। বাতিলের দিনটিকে কালো দিন বলেও বর্ণনা করে তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় সংবিধান বিজেপি দ্বারা ধর্ষিত হলো’। বিজেপির শরিক সংযুক্ত জনতা দলের নেতা কে সি ত্যাগী বলেন, তারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধী। এটা এনডিএরও এজেন্ডা নয়। ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেন, কাশ্মীরের মর্যাদা বাতিলের মাধ্যমে মূলত ভারতের ভাঙন শুরু হয়ে গেলো। অন্যদিকে, সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৭ সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেয় বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। তাদের মতে, সরকারের সিদ্ধান্ত শুধু জাতীয় ঐক্যের ওপর বিরাট আঘাত নয়, এটা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর সংগঠিত আক্রমণ। অপরদিকে, বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে: এর মধ্যে দিয়ে আসলে কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি তুলে নিয়ে উপত্যকার দরজা খুব সচেতনভাবে খুলে দেওয়া হল ভারতের সব বর্ণ-ধর্ম-ভাষার মানুষের জন্য। ইসরায়েল একদিন যা ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত অঞ্চলে করেছে অথবা চীনও করেছে তিব্বতে, সুন্নি মুসলিম-গরিষ্ঠ কাশ্মীরে ভারতও ঠিক সেই একই ধরনের পদক্ষেপ নিল। এছাড়া, লন্ডন-ভিত্তিক জাস্টিস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অধ্যাপক শল বিবিসিকে বলেন, ‘৩৭০ ধারা বিলোপের আগেই অন্তত দুটি পদক্ষেপ থেকেই পরিষ্কার আঁচ করা যাচ্ছিল বিজেপি সরকার কাশ্মীরেরআবহমান কালের চরিত্রটা পাল্টে দিতে চাইছে। প্রথমত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল কাশ্মীরের জন্য যে ‘ডোভাল ডকট্রিন’ ফর্মুলেট করেছিলেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাই ছিল ভারতের অন্যান্য অংশ থেকে লোকজনকে কাশ্মীরে এনে বসত করানো। যেমন: কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের জন্য আলাদা কলোনি স্থাপন, শিল্পাঞ্চলের জন্য বাকি ভারত থেকে শিল্পশ্রমিকদের এনে বসতি গড়া কিংবা ভারতীয় সাবেক সেনা সদস্যদের এনে জমি দেওয়া । দ্বিতীয়ত, বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও আর্টিকল ৩৫এ বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি তারা সরাসরি ঘোষণা করেছিল বিজেপিকে ভোট দিয়ে জেতালে কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন আনায়াসেই’। যা হোক, উক্ত সিদ্ধান্তের পরপরই বিজেপি ও তার সহযোগী দলের নেতা-কর্মীরা দেশব্যাপী আনন্দ মিছিল করে মিষ্টি বিতরণ করেন। এছাড়া, রাজ্যসভার এমপি ও বিজেপির সিনিয়র নেতা সুব্রমণিয়াম স্বামী বলেন, ‘কাশ্মীর দেশের একটি অঙ্গ এবং এতে আলাদা কোনও আইন কার্যকর হতে পারে না। এখন ৩৭০ ধারা চলে গেছে। এবং কাশ্মির নিয়ে কোনও মধ্যস্থতা হবে না। এবার তাদের ভারতের অংশ আজাদ কাশ্মীরও ফিরিয়ে আনতে হবে। বিজেপির তাত্তি¡ক নেতা ও পলিসি রিসার্চ সেলের সদস্য অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলেন, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আজ থেকে ছেষট্টি বছর আগে কাশ্মীরের সর্বাত্মক ভারতভুক্তির জন্য যে ৩৭০ ধারা বিলোপের দাবি জানিয়েছিলেন, আজ তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরীরাই সেই স্বপ্নকে পূরণ করলেন। আরও জানা গেছে, ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনকে জানানো হয়েছে। এ ঘটনার নায়ক বিজেপির সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

অন্যদিকে, কাশ্মীরের উক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপীই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে টেলিফোনে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে তার সাথে বৈঠকে মিলিত হয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। প্রতিত্তোরে পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল সংক্রান্ত ভারতের ঘোষণা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারতের এই ঘোষণার ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত হবে। প্রতিবেশি দুই দেশের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে। পাকিস্তানের সংসদেও কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা হয়। তাতে ভারতের পদক্ষেপকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওআইসি মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করে কাশ্মীর বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্ব স¤প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘জাতিসংঘের নির্ধারিত নীতিমালা মেনে কাশ্মীর বিষয়ে একটি সমাধানের পথ খুঁজতে হবে’। অন্যদিকে, ভারত ও পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। বাংলাদেশের মানুষও উক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেয়া ৩৭০ নম্বর ধারা বাদ দেয়ার প্রতিবাদ এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার দেশ কাশ্মীরি জনগণের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলে জানান।

স্মরণীয় যে, ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভারত সেনা অভিযান চালিয়ে কাশ্মীর দখল করে নেয়। এর আগে পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর দখল করে নেয়। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ভারত বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে। এই এবস্থায় ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ কাশ্মীর প্রশ্নে একটি প্রস্তাব পাশ করে। তাতে বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি ভারতে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে, সেটি নির্ধারণ করবে সেখানকার মানুষ। কিন্তু ভারত সে সিদ্ধান্ত কখনো বাস্তবায়ন করেনি। বরং ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি বলে কাশ্মীর সংকটকে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে পরিণত করে। উল্লেখ্য যে, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সময় ৩৭০ ধারার অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত রাজ্য করা হয়। ইতিহাসবিদ ড: কিংশুক চ্যাটার্জি বলেন, ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেশনের মাধ্যমে কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যে শর্তে হয়েছিল কালক্রমে ভারত তা থেকে অনেকটা সরে এসেছে। পাকিস্তানও কতকটা জোর করেই এই অ্যারেঞ্জমেন্টের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ফলে সাতচল্লিশে এই সমস্যার শুরু হলেও এখন সেই সমস্যা অনেক বেশি জটিল হয়েছে। স¤প্রতি পাক প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা সফরকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে বৈঠককালে ট্রাম্প বলেন, আমি কাশ্মীর সমস্যার সংকট নিরসনে মধ্যস্থতা করতে রাজী আছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ করেছেন। প্রতিত্তোরে পাক প্রধানমন্ত্রী তাতে সন্মতি জানান। কিন্তু এর পরপরই ভারত ট্রাম্পের উক্ত বক্তব্য প্রত্যাখান করে ।

কাশ্মীরে জনগণ ভারতের উক্ত সিদ্ধান্ত মনে প্রাণে প্রত্যাখান করেছে । ফলে এখন তারা পুর্ণ স্বাধীনতা দিকে ধাবিত হতে পারে। এমনকি এ নিয়ে সন্ত্রাসী ঘটনাও বৃদ্ধি পেতে পারে। বিষয়টি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মানুষও ভালভাবে নেয়নি। সেখানের অবস্থাও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি পাকিস্তানের মানুষও চরম ক্ষুদ্ধ হয়েছে। ফলে পাক-ভারতের মধ্যে কি অবস্থা দাঁড়ায় তাই ভাববার বিষয়। পাক সরকার বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে পারে। তাতে মুসলিম দেশগুলো যে পূর্ণ সমর্থন জানাবে তা নিশ্চিত। এমনকি ভারতের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে। এটা হলে ভারত বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সন্মুখীন হতে পারে। স্মরণীয় যে, স¤প্রতি বিশ্ব পর্যায়ে ভারতের অবস্থান খুব দুর্বল। সোভিয়েতের সাথে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছেড়ে আমেরিকা-ইসরাইল লবিং ধরেছে, যে লবিং বিশ্বে এখন খুব দুর্বল। অভ্যন্তরীনভাবেও ভারতে চরম সংকট সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, কাশ্মীর নিয়ে সরকার-বিরোধী দল মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যা সংঘাতে রূপ নিতে পারে। এছাড়া, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত: কয়েক লাখ সেনা দিয়েও সাত দশক ধরে রাজ্যটি নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়নি। এখন নতুন ব্যবস্থায় তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এমনকি সেখানে ব্যাপকহারে হিন্দুদের পুনর্বাসন করে মুসলিমদের সংখ্যালঘু করা হলেও নয়। অন্যদিকে, কাশ্মীরের পরিণতি দেখে ভারতের যেসব রাজ্যে অহিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা শংকিত হতে পারে। তাই তারা পুনরায় বিচ্ছিন্নতার দিকে ঝুকতে পারে। অন্যদিকে, কাশ্মীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ, বিজেপি ও তার মিত্রদের টার্গেট ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত এবং তারপর সমগ্র অঞ্চলে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ইতোমধ্যেই আসাম, পশ্চিবঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা সফল হলে দ্বিতীয় কর্ম হবে-বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে রামমন্দির নির্মাণ করা। অন্যদিকে, সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথেও ভারতের দীর্ঘদিন যাবত চরম বিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে ১৯৬২ সালে যুদ্ধও হয়েছিল। উপরন্তু ভারতের দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রের যে সুনাম ছিল এবং বহু ধর্মের, বহু ভাষার, বহু জাতের মানুষের মিলনমেলা ভারত বলে যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ছিল, তা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বাতিলের মাধ্যমে ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন