বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

সব হারানো মানুষের আর্তনাদ

নিঃস্ব ৩ হাজার পরিবার, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ঊনচল্লিশ বছর বয়সী নোমান রশীদ গত ১৭ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে। গত জানুয়ারিতে পুরাতন টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে নতুন করে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। তিনটি ঘর ছিল নোমানের। নতুন ঘরে ফ্রিজ এনেছেন, কিনেছেন নতুন খাটও। মেয়ের বিয়ের কথা চলাতে ঘরগুলোকে নতুন রূপে সাজিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে লাগা ভয়াবহ আগুনে তার সব স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেছে।

গত শুক্রবার রাতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি। আগুনে পুড়ে বস্তির অধিকাংশ ঘরই ছাই হয়ে গেছে। শেষ আশ্রয়স্থলে অবশিষ্টের খোঁজে ব্যস্ত ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার বস্তিবাসী। পুড়েছে ঘরে থাকা খাট, টিভি, হাড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়, চুলা, ফ্রিজ, কাঠের আসবাবপত্র, সোনার গহনা ও নগদ টাকাসহ নানা মূল্যবান জিনিসপত্র। পড়ে আছে শুধু পোড়া টিন! এই পোড়া টিনের নিচেই সব হারানো মানুষগুলো হাতড়ে খুঁজে চলেছেন জিনিসপত্র। খুঁজছেন; কিন্তু পাচ্ছেন না। ধ্বংসস্তূপে সব হারানো মানুষগুলো আর্তনাদ করছেন।

আগুনের লেলিহানে পোড়া সবকিছু হাতড়ে খুঁঁজতে গিয়ে না পেয়ে অনেকেই কাঁদছেন। কেউ কেউ ঘরের পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ আবার মনকষ্টে ঘরের পাশেই যাচ্ছেন না। কারণ তারা জানেন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই পুড়তে। তবে টিনের নিচে খুঁজতে গিয়ে যা পাচ্ছেন তা নিয়ে চলে আসছেন সবাই। গতকাল শনিবার সকালে পুড়ে যাওয়া বস্তিতে গিয়ে এমন সব দৃশ্য দেখা গেছে।

নোমান রশীদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মেয়ের জন্য পাত্র আসতেছে। বিয়ের চিন্তা করে ঘর গোছাচ্ছিলাম। ব্যবসা করে কিছু টাকা জমাইছি। সেই টাকা দিয়ে অনেক কিছু কিনছি। এখন আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে আগুন। জানি সব শেষ, তবুও খুঁজতে এলাম। যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ঘরের জায়গাতে টিন ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই। মেয়ের বিয়ে গেল, ঘর গেল, জামা-কাপড়সহ ঘরের সবকিছু গেল। জানি না কী হবে? কিছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে সবকিছু ফেলে একদিকে চলে যাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তিটিতে বরিশাল ও ভোলাসহ বেশ কটি জেলার ছিন্নমূল মানুষের বসবাস ছিল। গত ৪০-৫০ বছর ধরে অনেকেই বসবাস করে আসছিলেন। এবারই প্রথম আগুনে এত বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হলেন তারা। শনিবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঝিলের ওপর বাঁশ আর কাঠের গাঁথুনিতে তৈরি শত শত ঘরের শেষ চিহ্ন বলতে দেখা যায় পোড়া টিন, বাঁশের পুড়ে যাওয়া খুঁঁটির অবশিষ্টাংশ। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী কেউ গালে হাত দিয়ে অসহায়ত্ব নিয়ে ঠায় বসে। কেউ বা উদ্ধার করার চেষ্টায় অবশিষ্টাংশ। গত রাতের আকস্মিক আগুনের সময় বস্তিবাসীদের অধিকাংশই উপস্থিত ছিলেন না। কারণ ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ বস্তির বাসিন্দা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন।

এমনই একজন রিও গার্মেন্টের কর্মী আকলিমা আক্তার। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঈদের কারণে গ্রামের বাড়ি ভোলায় গিয়েছিলাম স্বামী সন্তানের সাথে। আগুনের খবর শুনে রাতেই গাড়িতে উঠে ঢাকা আসি। কিন্তু এসে দেখি আমার ঘর কোনটা বোঝা বড় দায়। পুড়ে সব ছাই। এর মধ্যে পুড়ে যাওয়া লোহার খাট, স্টিলের আলমারি, হাড়ি-পাতিল যা কিছুটা ব্যবহার করার মতো তাই উদ্ধারের চেষ্টা করছি।
তিনি কান্না করে বলেন, অনেক দিনের কষ্টের টাকায় গুছিয়েছিলাম সংসার। হঠাৎ আগুনে এভাবে সব পুড়ে ছাই হবে ভাবতে পারিনি।

বস্তির সাতটি ঘরের মালিক দুর্ঘটনায় পা হারানো শফিকুল ইসলাম বলেন, ১৫ বছর আগে এখানে এসে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করি। ১৫শ’ টাকা করে সাতটি ঘর ভাড়া দিয়েই আমার নিজের সংসার চলে। কিন্তু এই আগুনে ভাড়াটিয়াদের সাথে নিজেরও কিছু নেই, সব পুড়ে শেষ।
আছিয়া বেগম (২৮) স্বামী আর এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন ওই বস্তিতে। তার রাখা দুই ভরি স্বর্ণ খুঁঁজতে এসে তিনি পাননি। না পেয়ে নীরবে তাকিয়ে কাঁদছেন আছিয়া। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই ভরি সোনা-দানা ছিল একটা বাক্সতে। খুঁজতে আইলাম, বাক্সই পাচ্ছি না। পুড়ে গেছে সব। আর কখনো সোনার গয়না পরতে পারব না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বহুত কষ্ট করে কিনছিলাম এগুলো। নিজের ঘর তো এখান থেকে চলে যেতে মন চায় না। তাই বসে আছি।

রহিম হোসেনের মেয়ে রোমানা আক্তার। রোমানা তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বই-খাতা আর কবুতরের খোপ খুঁজতে এসেছিল সে। কিছুই না পেয়ে নিজের ঘরের পোড়া টিনের উপর দাঁড়িয়ে কাঁদছিল রোমানা। তখন সে বলছিল, আমার অনেক কবুতর ছিল, সব উড়ে গেছে। আমাদের ঘর পুড়ে গেছে। আমার বই-খাতাও পুড়ে গেছে। কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। এখন কই থাকব জানি না। আমরা গরিব আর ঘরবাড়ি বানাতে পারবে না আব্বু। আমাদের সব শেষ।

নরসিংদীর মনোহরদী থেকে এসেছেন সুমাইয়া (২৫)। বলেন, ঈদের ছুটিতে স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার স্বামী একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বস্তির সাত নম্বর রোডের নয় নম্বর গলিতে তাঁর ঘর ছিল। আগুন লাগার খবর রাতে শুনেই স্বামীকে নিয়ে ভোরে এসেছেন। আগুনে পুড়ে সব সমান হয়ে গেছে। তিনি ঈদের আগে কাপড়চোপড়সহ যেসব জিনিস সঙ্গে নিয়ে গেছেন, তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন কোথায় থাকবেন, তা জানেন না। তাদের স্কুলে থাকতে দেয়া হবে বলে শুনেছেন। কিন্তু এখনো কেউ কোথাও যায়নি। এখনো সবাই বস্তির আশপাশেই আহাজারি করছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মিরপুর ৭ নম্বরের বস্তিটি অবৈধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়ি টিন ও কাঠের। একেকটি বাড়ি টিন দিয়েই তিন-চারতলা করা হয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি করা এসব ঘরের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। বস্তির আশপাশের বাড়িগুলোতেও আগুন নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
স্থানীয় বাসিন্দা খায়রুল বাশার বলেন, বস্তির পাশেই তাদের বাসা। তারা আগুন ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ছিলেন। দ্রুত বাড়ি ছেড়ে সবাই বাইরে চলে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগুন নেভানো সম্ভব হওয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছেন।
আগুনের খবর পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্যা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। তারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সহায়তা আশ্বাস দেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্যা বলেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক বস্তিতে থাকত। সবাই ঈদে বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসে কেউ কিছু পায়নি। এখানে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মিরপুরের রূপনগরের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা, আহার ও বাসস্থানসহ সবধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর জন্য চিকিৎসা, আহার, বাসস্থান সব ধরনের সহযোগিতা করছে সিটি কর্পোরেশন।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, বস্তিতে প্রায় ৬০০ মতো ঘর ছিল, আমরা কিছু ঘর এবং পরিবারগুলো সেভ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আগুনে বস্তির ৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ আগুনে কেউ নিহত হননি, তবে ৪ জন আহত হয়েছেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটের দিকে মিরপুরের চলন্তিকা মোড় সংলগ্ন বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা ধরে ২৪টি ইউনিটের প্রচেষ্টা ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় রাত সাড়ে ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তবে রাত দেড়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নির্বাপন করা সম্ভব হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন