শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

চট্টগ্রাম বন্দর ও আজকের চট্টগ্রাম

প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন খান
দুই বাংলা মিলে এ কালেও ধারাবাহিকভাবে জীবন্ত নগরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামই সবচেয়ে পুরনো। রাজধানী ঢাকা কয়েক বছর আগে চারশ বছর অতিক্রম করেছে, কলকাতার বয়স সোয়া তিনশ। চট্টগ্রাম সে তুলনায় বেশ প্রাচীন। মালয়ী এক ঐতিহাসিক পঞ্জিতে উল্লেখ আছে, চতুর্থ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম থেকে বুদ্ধগুপ্ত নামে এক নাবিক যাত্রা করেছিলেন সেদেশের উদ্দেশে। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙের বিবরণীতেও চট্টগ্রাম ভ্রমণের উল্লেখ আছে। চট্টগ্রামের এই গুরুত্বের কারণ এর বন্দর। কর্ণফুলী নদী অববাহিকায় অবস্থিত সমুদ্র-তীরবর্তী এই জনপদের বন্দর হিসেবেই বিকশিত হওয়া ছিল অবধারিত। প্রাচীন বৌদ্ধ রাজ্য সমতট ও হরিকেলের সমৃদ্ধ নগরী এটি। বৌদ্ধ, আরব এবং অন্যান্য সূত্রের উল্লেখসমূহ বিচার করলে মানতেই হয় যে, চট্টগ্রামের বয়স দেড় হাজার বছরের কম নয়। বন্দরের কারণেই এর ধারাবাহিকতা ও বিকাশ।
সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জয় করে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে বন্দরে অনেক জাহাজ নোঙ্গর করা অবস্থায় দেখতে পান। এর দু’শ বছর পরে শেরশাহ বাংলা অধিকার করে নিলে চট্টগ্রামের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। চট্টগ্রাম অধিকৃত হয় আরাকান রাজ্যের। তথাপি এক হিসেবে দেখা যায়, ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দরে আনুমানিক তিয়াত্তর লক্ষ অষ্টাশি হাজার দু’শ তেত্রিশ টাকার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। কিন্তু আরাকান রাজের সহযোগিতায় দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় পর্তুগিজ নাবিক, বণিক, অভিযাত্রী ও জলদস্যুরা। তারা লুণ্ঠন, দাসপ্রথা এবং ধর্মান্তরের মতো জবরদস্তি চালিয়ে সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে। এসব কাহিনী তৎকালীন সাহিত্যে উল্লেখ হয়েছে। তবে পর্তুগিজরাই আবার বন্দরের দিকে মনোযোগ দেয়। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন জোয়াও দ্য সিলভেইরা তার জাহাজ লোপো সোয়ানা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে হাজির হন। তাকে অনুসরণ করে আসতে থাকে পর্তুগিজ বণিক, নাবিক ও ভাগ্যান্বেষীরা। তারা চট্টগ্রাম বন্দরকে উল্লেখ করেছেন পোর্দো গ্রান্দে বা বড় বন্দর নামে।
১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিক দ্য বারোজ চট্টগ্রাম সম্পর্কে লিখেছেন ‘বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুখ্যাত নগরী’। এই সমৃদ্ধি ও সুখ্যাতির কারণ এর বড় বন্দরটি। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান ও তার পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান চট্টগ্রাম দখল করে নেন। মুঘল যুগেও চট্টগ্রাম বন্দরের সমৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। তবে এরপর আরাকানি, পর্তুগিজদের মধ্যে হাতবদল হয়ে বন্দরের কর্তৃত্ব চলে আসে ইংরেজদের হাতে। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত প্রথম অ্যাংলো-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বর্মী আধিপত্য প্রকট হলেও উদীয়মান ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজ বন্দরের গুরুত্ব বুঝে নিজেদের ঘাঁটি শক্তিশালী করে এবং শীঘ্র বন্দরসহ চট্টগ্রামের ওপর পূর্ণ অধিকার কায়েম করে।
ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৭ সালে পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট প্রণয়ন করে বন্দর পরিচালনাকে একটি আইনসিদ্ধ সংস্থার অধীনে কাঠামোবদ্ধ করে। এ সময় বন্দরের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ছিল পাঁচটি কাঠের ও একটি পন্টুন জেটি। ১৮৮৯-৯০ সালে বন্দরে ১.২৫ লক্ষ টন রফতানি পণ্য খালাস করা হয়। এদিকে মূলত আসামের চা রফতানির জন্য ব্রিটিশ সরকার বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা করলে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। চট্টগ্রাম হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর, এরসঙ্গে পোর্ট কমিশনারের সদর দপ্তর হওয়ায় চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে বহু উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তার আবাসস্থল। রেলওয়ে ও বন্দরের অধিকারে নগরীর বিস্তার ঘটে, উন্নয়ন হয়। চট্টগ্রাম ক্লাবের পত্তন হয়, ব্রিটিশ-বর্মী স্থাপত্যরীতিতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীতে কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন, চট্টগ্রাম আদালত ভবন ও একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নির্মিত হয়। এভাবে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই পাহাড়-সমুদ্র-নদী ঘেরা এই জনপদ একটি আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে।
নগরীর সঙ্গে সঙ্গে বন্দরেরও উন্নয়ন ঘটেছে। ব্রিটিশ আমলের পোর্ট কমিশনারের স্থলে পাকিস্তান আমলে পোর্ট ট্রাস্ট গঠিত হয় এবং এ অঞ্চলের প্রধান বন্দর হিসেবে এর উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যেমন এ বন্দর জাপানি বোমা হামলার শিকার হয়, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী এর মুখে নদী ও সমুদ্রে বিস্তর মাইন পেতে রেখে জাহাজ চলাচল অসম্ভব করে তোলে। তার আগে আমাদের মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা অসম সাহসিকতার সঙ্গে বন্দর চ্যানেলে অনেকগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পরে তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সরকারের একটি অগ্রগণ্য কাজ হয়ে ওঠে বন্দর-মুখের মাইন পরিষ্কার করা। এ কাজে সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে বন্ধুরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। অ্যাডমিরাল জুয়েঙ্কোর নেতৃত্বে রুশ নৌবাহিনীর একটি অভিজ্ঞ দল মাইন পরিষ্কারের কাজ করেন এবং ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণভাবে মাইনমুক্ত হয় ও জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ ঘোষিত হয়।
বাংলাদেশ আমলে বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি শক্তিশালী ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা হয়ে ওঠে। খুলনার মংলা বন্দর চালু হওয়া সত্ত্বেও আজও চট্টগ্রাম বন্দরই দেশের প্রধান বন্দর। সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশকে একদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক বিকাশের স্বার্থে এই নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর কথা ভাবতে হবে, আবার একই সঙ্গে প্রতিবেশী ও দূরবর্তী পরাশক্তির ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যবহৃত না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে এটি একটি চ্যালেঞ্জ। ১২৯ বছর শেষ করে ১৩০ বছরে পা রাখছে চট্টগ্রাম বন্দর। বছরে ৫০ হাজার টন কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্য নিয়ে ১৮৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর এখন বছরে হ্যান্ডেল করছে সাত কোটি টনেরও বেশি পণ্য। ২০১৫ সালেই ২০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেল করে ‘টু মিলিয়নস ক্লাবে’ প্রবেশ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। এখন ২০৩৬ সালের আগেই ৫০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডেল করার স্বপ্ন দেখছে চট্টগ্রাম বন্দর। এ জন্য তৈরি হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। বাস্তবায়ন করা হচ্ছে একডজন প্রকল্প। সকল বাধা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাড়ছে সক্ষমতা। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হচ্ছে নতুন সরঞ্জাম। বন্দর সুরক্ষিত করতে সংরক্ষিত এলাকায় বাড়ানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা। জাহাজ আগমন ও প্রস্থান কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করতে স্থাপন করা হয়েছে ভিটিএমআইএস (ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম)। কনটেইনার খালাস কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করতে যুক্ত হয়েছে সিটিএমএস (কনটেইনার টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) প্রযুক্তিও।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্দর এগিয়ে যাওয়ায় নৌপথে বাড়ছে সমুদ্র বাণিজ্য। প্রতিষ্ঠার শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে পাঁচ থেকে ১০টি জাহাজ এলেও গত বছর এ বন্দরে নোঙর করে দুই হাজার ৭৩০টি জাহাজ। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪১০টি। ১৯৭৭ সালে ২০ ফুট দীর্ঘ (টিইইউএস) ছয়টি কনটেইনার হ্যান্ডেল করে বন্দর। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে ২০ লাখ ২৪ হাজার ২০৩ টিইইউএস। স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর দায়িত্ব চেপেছে অনেক বেশি। ফলে বন্দরে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন ছিল কালের দাবি। পাকিস্তান আমল থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বরাবর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
আমরা জানি একদিকে দেশের অর্থনীতির বহর বাড়ছে আর অন্যদিকে সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক আয় বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বর্তমান কাঠামোয় চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। ভারত চায় তার পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে মাল পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরের সহযোগিতা। আবার চীন তার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রবেশ ও বহির্গমন পথ হিসেবে চট্টগ্রামকে ব্যবহার করতে চায়। এদিকে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। তাই ভারত-চীন ছাড়াও জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর দৃষ্টিও রয়েছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামের দিকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন