শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র না চাইলে সংঘবদ্ধ অপরাধ সংঘটিত হতে পারে না

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞানীরা সচরাচর সংগঠিত অপরাধ এর পরও অপরাধ প্রবণতাকে আরও তিনটি স্তরে (যা দ্বারা আইন ভঙ্গ হয়ে থাকে) বিন্যাস করেছেন। যেমন (১) সন্ত্রাস (২) যেখানে অপরাধী ধরা ছোয়ার বাহিরে থাকে এবং (৩) সংঘবদ্ধ অপরাধ।

সংঘবদ্ধ অপরাধের পরিপূর্ণ কোন সঙ্গা প্রদানে অপরাধ বিজ্ঞানী বা আদালত এখন পর্যন্ত ঐক্যমতে পৌঁছতে পারে নাই। আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি পটার স্টুয়ার্ট বলেছেন যে, “সংঘবদ্ধ অপরাধ কি সুনির্দিষ্টভাবে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে যখন অপরাধটি জানতে পারি তখন আমি বুঝতে পারি।” সংঘবদ্ধ অপরাধকে সংঙ্গায়িত করার জন্য ১৯৮০ ইং সনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান একটি কমিশন গঠন করেন, কিন্তু উক্ত কমিশন আলোচনা পর্যালোচনার পর “সংঘবদ্ধ অপরাধ” সংঙ্গায়িত করে নাই বা করতে পারে নাই। তবে তাদের মতে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠিত হওয়ার জন্য তিনটি গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, যথা- (১) একটি অপরাধী চক্র, (২) প্রটেকশন দেয়ার জন্য একটি গ্রুপ (৩) বিশেষজ্ঞ সমর্থক।

সংঘবদ্ধ অপরাধের উপর ১৩ জন অপরাধ বিজ্ঞানী প্রনীত তথ্যমূলক বই পর্যালোচনা করে অন্যতম অপরাধ বিজ্ঞানী Frank Hagan একটি সঙ্গা তৈরী করেছেন যাতে তিনি বলেছেন যে, “There is great consensus in the literature that organigaed crime functions as a continuing enterprise that rationally works to make profit through illicit activities and that is ensures it’s existence through the use of threats or force and through CORRUPTION OF PUBLIC OFFICIALS to maintain a degree of immunity from law enforcement.” Frank Hagan এর মতে Public official অর্থাৎ জনগণের অর্থে লালিত পালিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের সহযোগীতার মাধ্যমেই সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে।

অপরাধ বিজ্ঞানীগণ আরো মনে করেন যে, “Crimes by corporations (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিধিবদ্ধ সংস্থা) during the course of business, or crimes by politicians or goverment agencies, can also be considered part of “Organized” crime. For Example, official misconduct by a gvernment official, obstruction of justice and commercial bribery are all types of organized crime behariour.” রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা দায়িত্ব পালনে সংঘবদ্ধ অপরাধে জাড়িয়ে পড়ে। বিচার ব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাকেও অপরাধ বিজ্ঞানীরা সংঘবদ্ধ অপরাধের অর্ন্তভুক্ত মনে করেন। সরকারের বা ক্ষমতাসীনদের চাহিদা মোতাবেক রায় প্রদান বা বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদান করা বা বিচারিক যে সিদ্ধান্তে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সরকার লাভবান হয় তাহাও সংঘবদ্ধ অপরাধের আওতায় আসে। এখন প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগ যদি লাইনচ্যুত হয়ে অপরাধী চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব কাার উপর বর্তাবে?

জনস্বার্থে আইন প্রনয়ন এবং এর সুষ্ঠ প্রয়োগই একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রের পক্ষে এ দায়িত্ব পালিত হয় জনগণের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের মাধ্যমে। অথচ এ কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডে আইনভঙ্গের পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে বিধায় অপরাধ বিজ্ঞানীরা সচরাচর অপরাধ, হোয়াইট কালার অপরাধ, সন্ত্রাসবাদী অপরাধের পাশাপাশি নতুন করে একটি অপরাধকে নিয়ে গবেষনা করছেন যে অপরাধ খালি চখে দেখা যায় না, পক্ষান্তরে রাষ্ট্র ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিভিন্ন ভাবে। রাষ্ট্র যন্ত্রের পরিচালক বা নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠান “সরকার” লাভবান হলেও ভিকটিম হয় জনগণ পক্ষান্তরে রাষ্ট্র।

প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে ইটালীর প্রখ্যাত মনস্তাত্ববিদ ও আইন বিশেষজ্ঞ Cesare Baccaria বলেছেন যে, “Some times the people became the victime of law” অর্থাৎ “আইন দ্বারা জনগণ ভিকটিম ক্ষতিগ্রস্থ হয়” (যে আইন জনস্বার্থে প্রনীত না হয়ে শাসকদের রক্ষার্থে প্রনীত হয়ে থাকে)। আমেরিকার National Advisory committee on Criminal Justice and goal হোয়াইট কালার ও সংঘবদ্ধ অপরাধের মধ্যে কোন প্রকার তারতম্য খুঁজে না পেয়ে বরং এ মর্মে মন্তব্য করেছেন যে, There are more similarities than defferences between organized crime (সংঘবদ্ধ অপরাধ) and so-called white collar crime. তবে সন্ত্রাসবাদ ও সংঘবদ্ধ অপরাধের মধ্যে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা যে তারতম্য খুঁজে পেয়েছেন তা হলো সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ফয়দা লুটার উদ্দেশ্য আদর্শ ভিত্তিক লড়াই যা করার জন্য রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনকে ভঙ্গ বা অমান্য করা হয়। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ অপরাধের উদ্দেশ্যে আইনকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অর্থনৈতিক ফয়দা হাসিল করা। সরকার, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও অপরাধী চক্র একই সাথে একই উদ্দেশ্যে কাজ না করলে সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠিত করা সম্ভব হয় না।

জাতীয় পত্রিকার ভাষ্যমতে সম্প্রতি শেয়ার বাজার থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে। কিন্তু কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে এখন পর্যন্ত বিষয়টি আইনের আওতায় আনা হয় নাই। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র যদি এ অপরাধে জড়িত না থাকে তবে এ ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয় কিভাবে ? ইতোপূর্বেও শেয়ার বাজার থেকে অনুরূপভাবে মোটা দাগে অর্থ উধাও হয়েছিল, শুনা গিয়েছিল যে তদন্ত করা হবে, কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে নাই। যেখানে সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠিত হয় সেখানে অপরাধী ধরা না পরারই কথা। কারণ যারা অপরাধী সনাক্ত ও বিচার করবে তারাই বা তাদের উপরওয়ালারা যদি জড়িত থাকে তবে অপরাধী সনাক্ত বা বিচার হবে কিভাবে?

মোট অংকের ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রেও বড় আকারের সংঘবদ্ধ অপরাধ সংগঠিত হয়ে আসছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, যাহাতে প্রতারক ঋণ গৃহিতা, ব্যাংকের উচ্চপদস্থ আমলা এবং সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের প্রভাব জড়িত থাকে। দেশীয় কাঁচামালের উত্তম ব্যবহার, বেকারদের কর্মসংস্থান, উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা উর্পাজনের উদ্দেশ্যেই জনগণের গচ্ছিত অর্থ থেকে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য মোটা অংকের ব্যাংক ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু শিল্প কারখানাকে পরবর্তীতে রুগ্ন শিল্প দেখিয়ে একদিকে সুদের অর্থ মওকুফ, অন্যদিকে অল্প মূল্যে সম্পত্তি ব্যাংকের নামে বন্ধক রেখে মোটা দাগের যে ঋণ নেয়া হয় তাতে সে সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংক সম-পরিমাণ অর্থ আদায় করা দূরের কথা ঋণ গৃহিতাদের টিকিটি ধরতেও হিমশিম খেতে হয়। জাহালমের মোটা অংকের ব্যাংক ঋণ সংঘবদ্ধ অপরাধের একটি চিত্র, যাকে মাইল ফলক হিসাবে চিহ্নিত করে সরকার ব্যাংক ঋণ সেক্টরের জাল জালিয়াতি মূল উৎপাটনের সুযোগ গ্রহণের কথা ছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয় নাই বরং জাহালমের কারাভোগ হয়েছে, এর পিছনেও রয়েছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র যাদের হাতেই আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ।

সংঘবদ্ধ অপরাধের উপর গবেষণা করে গবেষক ANDERSON এ মর্মে মন্তব্য করেন যে, “There is a need for information about organized crime activity it self, by which the Government new legislation and its expanding level of effort can be evaluated” ” অর্থাৎ Anderson মনে করেছেন যে, সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সরকারের জানা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন, যাতে এর প্রসার রোধ কল্পে সরকার যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে পারে। বাম রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তা মার্ক্স মনে করতেন যে, ভোগবাদী সমাজের কারণে এক শ্রেণী উচ্চ বিলাসী হয় বিধায় গণমানুষ হয় ক্ষতিগ্রস্থ যার ফলে সম্পদের সুষম বন্টন হতে পারে না, ফলে মানুষের মধ্যে শোষক ও শোষিতের শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। শোষক শ্রেণীরাই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য লোক দেখানো ও জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য মুখে মুখে যত নীতি কথা প্রচার করুক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা। একটি রাষ্ট্রে সংঘবদ্ধ অপরাধ ছাড়া অবৈধভাবে মোটা দাগে অর্থনৈতিক লাভ সংক্রান্ত কোন অপরাধ সংগঠিত হতে পারে না। এদের হাত অনেক লম্বা বিধায় নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ায় মতবিরোধ দেখা না দিলে তারা বিচারের আওতায় আসে না, যদিও আসে তা কাদাচিত। জনগণের চাপে বা সমাজে ভারসাম্য রক্ষার জন্য যতই আইন প্রণীত হোক না কেন সে আইনের মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয় উচ্চ বিলাসী আইন প্রণেতা ও প্রয়োগকারীদের হাতেই। ফলে সমাধানের বা সম্পদের সুষম বন্টনের কোন সিলভার লাইন পরিলক্ষিত হয় না। জনগণ যে তিমিরে সে তিমিরেই থেকে যায়। যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় কোরবানীর চামড়া বিক্রি না করে মাটিতে পুতে রাখার সংবাদ পত্রিকায় ঘটা করেই প্রকাশিত হয়েছে। সরকার বলেছে যে, চামড়ার মূল্য কমে যাওয়ার পিছনে কোন সিন্ডিকেট কাজ করেছে, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। সরকারের ভিতরে থাকা সরকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতা ছাড়া সিন্ডিকেট তৈরী হতে পারে না। সংঘবদ্ধ অপরাধের জন্যই সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়ে থাকে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিলেও অনুরূপ কারণেই মাদকের প্রসার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সরিষায় যদি ভুত থাকে তবে সে ভুত তাড়াবে কে?

লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন