দেশজুড়ে সপ্তাহব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের প্রথম দিনে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ১২ শতাধিক ব্যক্তিকে। তবে জঙ্গিদের অপ্রতিরোধ্য টার্গেট কিলিং প্রতিরোধ করার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে, প্রথম দিনে গ্রেফতারের ধরন দেখে তা প্রতীয়মান হয়নি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই নিরীহ, বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং মামলার পলাতক আসামি। টার্গেট কিলিংয়ের হোতাদের টিকিটিও ধরা যায়নি। বরং এই সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই পাবনার হেমায়েতপুরে সৎসঙ্গ আশ্রমের এক সেবককে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এটাও টার্গেট কিলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ এত হাঁকডাক দিয়ে যে অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে কি সুফল পাওয়া যাচ্ছে এবং কারা লাভবান হচ্ছে? বিশেষ অভিযানের শেষ দিন পর্যন্ত টার্গেট কিলিংয়ের সাথে জড়িত রুই-কাতলস্বরূপ কেউ যে গ্রেফতার হবে না, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। স্বাভাবিক সময়েই টার্গেট কিলিংয়ের সাথে জড়িত মূল হোতাদের কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি, আর ঘোষণা দিয়ে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হবে- এটা সামান্য বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের বিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। আগে থেকেই যদি ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, তোমাদের ধরতে অভিযান শুরু হচ্ছে, তাহলে তারা চুপ করে বসে থাকবে, এমন ভাবনা নির্বোধ ছাড়া কেউ ভাববে না। এ বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, টার্গেট কিলিংয়ের সাথে যারা জড়িত, তাদের কৌশল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কৌশলের চেয়েও অধিক উন্নত। তা নাহলে তারা কোনো না কোনো সময় ধরা পড়তই।
দেশের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান এর আগেও বহুবার মানুষ দেখেছে। কম্বিং অপারেশন বা চিরুনী অভিযান নাম দিয়ে সেসব অভিযানে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, দেখা গেছে তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ। তখন অভিযোগ উঠেছিল, এসব অভিযানে পুলিশের একটি শ্রেণী ব্যাপক হারে গ্রেফতার বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষকে গ্রেফতারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ সে সময় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এবারের সাঁড়াশি অভিযান নিয়েও ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রোজার মাসে এ ধরনের অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে একদিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে ঈদ সামনে রেখে পুলিশের একটি শ্রেণীকে গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাত দিনের বিশেষ অভিযান শেষে যে লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার ফলাফল শূন্যই থেকে যাবে। গত ১৮ মাসে সারা দেশে ৪৯টি টার্গেট কিলিং হলেও পুলিশ একটি ঘটনারও প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি। ঘোষণা দিয়ে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে এসব দুর্বৃত্ত ধরা পড়বে, এমন আশা দুরাশা ছাড়া কিছু নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে পুলিশ বড় ধরনের ধাক্কা খায়। এ থেকে সে নড়েচড়ে বসে এবং জঙ্গি ও টার্গেট কিলিংয়ের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরুর পরিকল্পনা নেয়। মূলত পুলিশের মনোবল চাঙা করার জন্যই এই অভিযান শুরু করা হয়েছে। তবে পুলিশের মনোবল চাঙ্গা করতে গিয়ে যদি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিতে হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অনৈতিকও বটে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এই অভিযানের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উপরও আরেক দফা ডলা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপি’র তরফ থেকে বলা হয়েছে, সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে আবারো বিরোধী দলের উপর চড়াও হয়েছে সরকার। অন্যদিকে অভিযান চলাকালেই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি বারবার অভিযোগ করছে, গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিংয়ে সংসদের বাইরের বিরোধী দল জড়িত এবং তার তথ্য-প্রমাণ তাদের কাছে আছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন এ ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়, তখন অভিযান কোন দিকে যাবে, তা বলা বাহুল্য। বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভিযানে যদি জঙ্গি গ্রেফতারই মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের তালিকা রয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে তাদের ধরার জন্য আয়োজন করে ঘোষণা দিয়ে অভিযান পরিচালনা করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই। এটা অনেকটা চোরকে চুরি করতে বলা আর গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলার মতো হয়ে পড়েছে। অভিযানের মধ্যেই সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের ঢালাওভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপানোর ফলে যা হয়েছে তা হলো, টার্গেট কিলিংয়ের সাথে প্রকৃত জড়িতরা আসকারা পেয়ে যাচ্ছে। তারা বগল বাজাচ্ছে। এই ফাঁকেই আশ্রমের সেবককে খুন করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কিছুই করতে পারবে না। মাঝ থেকে নিরীহ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভোগান্তি বৃদ্ধি এবং পুলিশের একটি শ্রেণীর অবাধ গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে।
যখন কোনো ঘোষণা দিয়ে বিশেষ অভিযান চালানো হয়, তখন এটাই প্রতীয়মান হয়, পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম শিথিল ও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। তাদের অ্যাক্টিভ ও কার্যকর করতে হলে বিশেষ অভিযানের প্রয়োজন পড়ে। অথচ পুলিশের সার্বক্ষণিক কাজই হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অপরাধী সে যত বড় ও ভয়ংকর হোক তাকে গ্রেফতার করে আইনানুগ বিচারের মুখোমুখি করা। আমাদের উদ্বেগের কারণ এখানেই। আমরা দেখছি, পুলিশের হাইয়েস্ট প্রায়োরিটি লিস্টের মধ্যে টার্গেট কিলিং ও জঙ্গী দমন থাকলেও তার কোনো কূল-কিনারা তারা করতে পারছে না। বরং এদের ধরার অভিযানের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ ব্যাপক হারে হয়রানি ও গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে। এটা জুলুমের পর্যায়ে চলে। আল্লাহপাক জুলুমকারীদের বিরুদ্ধে বলেছেন : জালেমদের কর্মকা- সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে, জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে। (সূরা শুরা, আয়াত-২২)। বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে লক্ষ্যে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হয়, সে লক্ষ্যে পৌঁছার পরিবর্তে তা অন্যদিকে মোড় নেয়া শুরু করেছে। আর কে না জানে, ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করা যায়। ঘোষণা দিয়ে অপরাধী ধরা সহজ কাজ নয়। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীদের পুলিশ ধরুক এবং তাদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করুক। তবে এই কাজ করতে গিয়ে একজন বেকসুর সাধারণ মানুষও যেন হয়রানির শিকার না হয়। এ বিষয়টি সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন