শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

“আরবী প্রথম মাস-‘মহ্রম’ ও শহীদানে কারবালা”

নাজীর আহমদ জীবন | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আরবী বর্ষের প্রথম মাস ‘মহ্রম’ অর্থ পবিত্র, সম্মানিত বা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এ মাসে কোন রূপ যুদ্ধ, ঝগড়া, ফাসাদ নিষিদ্ধ। রাসূল (সাঃ) এ মাসে কখনো কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হননি। এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। আশুরার আদি প্রেক্ষাপট গ্রথিত আছে বিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের শিকড় মূলে। আর, এর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে যুগ কালকে পরিবেষ্টিত করে। একক দিন হিসাবে ১০-ই-মহ্রম-এ যত ঐতিহাসিক ও সৃষ্টিগত ঘটনা ঘটেছে অন্য কোন দিনে তা হয় নাই। সবশেষে যোগ হয় কারবালার মরু প্রান্তরে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই অক্টোবর ৬১ হিজরীর ১০ই মহ্রম শুক্রবার; বড় দুঃখজনক ও বেদনা দায়ক ঘটনা যা এ দিনকে আরও স্মরণীয় ও বরণীয় করেছে। যা প্রেমিক হৃদে আনে অশ্রæ ও বেদনা।

হাদীস শরীফে মহ্রম মাসকে “আল্লাহর মাস” বলা হয়েছে। আর কোরআনে বর্ণিত সম্মানিত চার মাসের মধ্যে ‘মহ্রম মাস’ একটি। রমযানের রোজা ফরজ হবার পূর্বে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “রমযানের রোজার পর সর্বোত্তম হলো-আশুরার রোজা; যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ।” রাসূলের হাদীসে এসেছে; এ দিনে পৃথিবী ও ফেরেশ্তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়। আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে প্রেরণ ও তওবা কবুল, ইউনুস নবী মাছের পেট হতে মুক্তি। আয়ূব নবীর রোগ মৃুক্তি; দাউদ নবীর তওবা কবুল; ঈসা নবীকে আকাশে উত্তলন; এ দিনে দুনিয়া ধ্বংস হবে; এ দিনে পৃথিবীতে প্রথম রহমতের বৃষ্টি হয়; এ দিনে রাসূলের উম্মতদের গোনাহ মাফের ওয়াদা আল্লাহ করেন; এ দিনে রাসূল (সাঃ) কে চিরতরে নিষ্পাপ ঘোষণা করা হয়; ইত্যাদি

রাসূল (সাঃ) বলেছেন; “তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ। কিন্তু এতে ইহুদীদের সাথে এক করোনা। এটা এ রকম যে, আশুরা পূর্বের দিন বা পরের দিন রোজা রাখ। যে ব্যক্তি আশুরার রোজা রাখে সে ষাট বছর দিনে রোজা ও রাতে ইবাদত করার সওয়াব লাভ করে।”

তিনি বাধ্য হয়ে “মোহাম্মদী বংশ অর্থাৎ সৈয়দ বা মীর বংশ” রক্ষার জন্য তিনি তাঁর নিজ প্রিয় ছোট মেয়ে ফাতেমা (রাঃ) এর সাথে নিজ চাচাতো ভাই আলী (রাঃ) এর বিবাহ দিয়ে বংশের ধারা ঠিক রাখেন। ইমাম হাসান ও হোসেন (রাঃ) জন্ম নেবার পর তিনি একদিন আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা দু’জন আমারই বংশ ধর, আমার কন্যারই পুত্রদ্বয়। আমি তাদেরকে ভালবাসি, তুমি ও তাদেরকে তোমার প্রিয় পাত্র করে নাও, এবং যারা তাদেরকে ভালবাসে তাদেরকেও তুমি ভালবাস।” (মিশকাত ও তিরমিযি)

বিশ্ব নবী স. বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই হাসান হোসেন দুনিয়াতে আমার দু’টি ফুল।” (তিরমিযী)। তিনি আরো বলেন, “হোসেন আমার, আর আমি হোসেনের।” (তিরমিযি)

রাসূল (সাঃ) এর ইন্তেকালের সময় ইমাম হাসান ও হোসেন নানাজীর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। হযরত আলী; রাসূলের কষ্ট হবে ভেবে
তাদের উঠিয়ে নিতে গেলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, “এ দু’জনকে আমার থেকে এবং আমাকে এদের থেকে সরিয়ে নিও না। কারণ; এ দু’জনকে
বিপদাপদ স্পর্শ করবে।” রাসূল; ইমাম হোসেনকে একটু বেশী ভালবাসতেন স্নেহ চুম্বন দিতেন।

বড় দুঃখের বিষয় সে; এ দু’টি ফুলকে অকালে পৃথিবী থেকে ঝড়িয়ে দেয়া হ’ল। উদ্দেশ্য যে ‘মোহাম্মদী’ জন্ম নিয়েছে একে অংকুরে শেষ করা যাতে আগামী পৃথিবীতে ‘মোহাম্মদী’ না থাকে। কিন্তু আল্লাহর খাস্ ইচ্ছায় জয়নুল আবেদিন (সাধক কুলের মাথার মুকুট) মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন। বড় ইমামকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। বিষের তীব্র প্রতিক্রিয়ার তাঁর পাতলা পায়খানা ও বমি শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁর নাড়ি ও কলিজা টুকরো টুকরো হয়ে বের হয়ে আসে এবং তিনি শাহাদত প্রান্ত হন।

“রাসূল (সাঃ) মদীনাকে রহমতের নগর বলেছেন। ইমাম হাসান ও হোসেনকে উনি বলেছিলেন, কোন অবস্থায় যেন মদীনার অন্যত্র না যায়। তাহলে কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। প্রথমবার বিষ প্রয়োগ করার পর হাসান নানাজীর রওজায় ছুটে যান এবং বেঁচে যান; দ্বিতীয়বার বিষ প্রয়োগ করা হ’লে ছুটে যান রওজায় বেঁচে যান। কিন্তু তৃতীয়বার আর যেতে পারলেন না বা চেষ্টা করলেন না। এবারই শাহাদত প্রাপ্ত হলেন।

হোসেন, কুফার শাসন কর্তার আমন্ত্রনে বিশ্বাসী হয়ে নানাজীর রওজা ছেড়ে চলে গেলেন। ফলে সৃষ্টি হ’ল ‘কারবালা’। এ থেকে শিক্ষার আছে। জয়নুল আবেদিন কোনক্রমে আল্লাহর ইচ্ছায় রক্ষা পেল। এভাবে সৈয়দ বংশ কোন রকমে রক্ষা পেল। সেই থেকে আজ অবধি চলে আসছে। শহীদী দরজা আল্লাহর নিকট প্রিয়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন ঃ “আল্লাহর দরবারে যে সর্বোচ্চ সম্মান শাহ্দাতে ছিররী ও শাহাদাতে জাহেরী রক্ষিত আছে তা তিনি হযরত ইসমাইলকে দেন নাই। তা শুধু আমার নাতিদ্বয়ের জন্য সংরক্ষিত আছে।” তাই ইমাম হোসেন (রাঃ) কারবালার যুদ্ধে নামবার পূর্বে বলেছিলেন ঃ আমার নানাজী বলেছেন যে; “আধ্যাত্মিক জগতে আমাকে সুউচ্চ মর্যাদার আসন দান করা হবে তা পূর্ব নির্দ্ধারিত। কিন্তু শহিদী মৃত্যু ছাড়া তা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।”

এ অন্যায় ও অসম যুদ্ধের পূর্বে এজিদ বাহিনী পানিকে রাজনৈতিক ঘৃণ্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। তিনি দিন ধরে ইমাম হোসেন এর শিবীরে একটুও পানি নেই। অনাহার ক্লিষ্ট, পিপাসর্ত ছোট শিশু, আপনজন ও সঙ্গী সাথীদের করুন মুখের দিকে চেয়ে বীরযোদ্ধা-বীর পুরুষ ন্যায়ের প্রতিক ইমাম হোসেনের চোখে ও পানি এলো। তিনি বঝুতে পারলেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে আমরা। ইব্নে যিয়াদ চার হাজার সৈন্য নিয়ে ফোরাত নদী ঘিরে ফেলেছে। পানির জন্য শিশু সন্তানরা আর্তচিৎকার করছে, শিবিরে পানির জন্য হাহাকার উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে এসে স্মরণ করতে হয় সেদিন হযরত ইব্রাহীম পুত্র ইসমাইল এর জন্য এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর ইচ্ছায় পানির ব্যবস্থা হয়েছিলÑ

“জম জম ক‚প” সৃষ্টির মাধ্যমে।

হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রাঃ) উনার প্রকৃত নাম হযরত আলী ইবনে হোসাইন। জয়নুল আবেদীন তাঁর উপাধি বা কুনিয়াৎ। যার অর্থ সাধক কুলের মাথার মুকুট। হিজরী ৩৮ সনে জন্ম। কারবালার যুদ্ধের সময় এক কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কেবল একটু সুস্থ। কিন্তু দু’বছরের ছোট ভাই আলী আসগর কে নিয়ে আব্বাজান ফোরাত তীরে পানি পান করাবার জন্য যেতে তীর বিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ এর সংবাদ শুনে তিনি যুদ্ধে যার জন্য অধীর হয়ে পড়েন। হযরত ইমাম হোসেন পীড়িত পুত্রের শয্যাপার্শ্বে এসে তাকে শান্তনা প্রদান করে বলেনÑ“হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) তাঁর উম্মতের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত যে জ্ঞান ভান্ডার আমার জান্নাতবাসী পিতাকে দান করেছিলেন সে এল্মে মারেফাত আমার বড় ভাই হযরত হাসান (রাঃ) হতে আমি পেয়েছিলাম। আজ আমি নবী বংশের শেষ প্রদীপ হিসেবে তোমার নিকট তা আমানত রেখে বিদায় নিচ্ছি। আমি দোয়া করছি রোজ কিয়ামত পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) এর জ্ঞান ভান্ডারের এ ফোয়ারা তোমার মাধ্যমেই উম্মতে মোহাম্মদীর কাছে পৌঁছাবে। এরপর নিজ পুত্রকে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আজ কারবালার মরু প্রান্তরে জেহাদে অংশ নেয়া অপেক্ষা ও কঠিনতম কাজ আমি তোমার উপর অর্পণ করে যাচ্ছি। এরপর ছেলেকে কিছু উপদেশ দান করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর হেফাযতে রেখে যুদ্ধ ক্ষেত্রে চলে যান।

কি অপরাধ ছিল এ মহান পবিত্র আওলাদে রাসূলের? যিনি পাক পাঞ্জাতনদের একজন। যার পবিত্র মুখেও পবিত্র কপালে রাসূল (সাঃ) স্নেহ চুম্বন দিতেন। চেহারা মোবারকে ছিল নানাজীর আদল। রাসূল বলেছেন; “আল্লাহর জন্য, আমার সাথে মোহাব্বত রাখো এবং আমার মোহাব্বতের খাতিরে আমার বংশধরদের সাথে মোহাব্বত রাখো।”

এজীদ বাহিনী যোহরের নামাজে সেজদারত অবস্থায় ইমাম হোসেইন কে শহীদ করলো। শহীদ হবার পূর্বে তাঁর পবিত্র শরীরে ছিল ৩৩টি তীর ও ৪৩টি তরবারীর আঘাত।
(চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Khaled Reza ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৬:০৯ এএম says : 0
Very nice.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন