বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার কালে-উত্তরকালে

সোহেল আমিন বাবু | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:২১ এএম

উনিশ শতকের সাহিত্যাকাশে বড় মাপের ঘটনাবলি আমরা সকলেই মোটামুটি জানি এবং সে সব ঘটনার মূলে চালিকাশক্তি হিসেবে রামমোহন- বিদ্যাসাগরের ভুমিকা, ডিরোজিও কি ইয়াং বেঙ্গল ইত্যাদির অস্তিত্ব আমাদের মনে গাঁথা আছে। একটি বিষয়ে আমাদের মনোযোগ ততখানি পড়ে নি, তা হল কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলন। সাহিত্যালোচকেরা বলে থাকেন সবই শহর এলিটদের তৈরী, এমন ঢালাও মন্তব একদেশদর্শী; আমাদের মনে থাকে না যে, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার(১৮৩৩-১৮৯৬) পাড়াগাঁর গরিব ঘরের ছেলে, কলকাতায় তাঁর কোন খুঁটি ছিলনা। আসলে ঐ শতকে যুগান্তকারী সমস্ত কিছুর ঊৎসমূল ছিল একটিই ; যুক্তির আলোকে মানুষ্য ধর্ম শনাক্ত করা। ঐ যুগের সমাজসংস্কার,শিক্ষাচিন্তা,ধর্মবুদ্ধি ও চরিত্রবল সবই পুরনো যুগ থেকে আলাদা। দৃষ্টিক্ষেপনের কেন্দ্রন্দিু এখানে মনুষ, এবং বিচারের মাপকাঠি হল যুক্তি। এ দুয়ের সংমিশ্রনে সমাজে ও ব্যাক্তি মানুষে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নীতিজ্ঞান ও আদর্শিকতা। উনিশ শতকের সামন্ত যুগের দরজার ছিটকিনি খোলার কাজটি ছিল বেশ শক্ত। আর সেই শক্ত কাজটিই মফস্বলে বসে হাতে কলমে করে দেখিয়েছেন গ্রামীন এলিট কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ঈশ্বরগুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’র সাংবাদিক ও লেখক। ১৮৬৩ সালে কুমারখালী থেকে তিনি‘গ্রামবার্ত প্রকাশিকা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকায়’ প্রকাশ হতে থাকে সাহিত্য, দর্শন,বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ, নীলকর জমিদার সাহেবদের শোষনের কাহিনি। ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ লেখার মাধ্যমে তাঁর লেখার হাতটিও বেশ পাকা হয়ে ওঠে।
১৮৫৯ সালে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার’র কিশোর উপন্যাস ‘বিজয় বসন্ত’ প্রকাশ পায়। সে সময় বাংলা গদ্য সাহিত্যের ঊন্মেষ কাল। রামমোহন রায়, ঈশ্বরগুপ্ত,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন গদ্য লিখছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস তখনো প্রকাশ হয়নি অর্থাৎ কথাসাহিত্যের প্রথম কাজটিই ঘটে গেল একজন মফস্বল লেখকের হাত ধরে। এ প্রসঙ্গে উনিশ শতকের বিখ্যাত গবেষক শিবনাথ শাস্ত্রী(১৮৪৭-১৮৯৯) তাঁর ‘রামতনু লাহিরী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে হরিনাথ মজুমদার’র ‘বিজয় বসন্ত’ সম্পর্কে কী বলেন একবার শোনা যাক -
‘কুমারখালীর হরিনাথ মজুমদার প্রণীত ‘বিজয় বসন্ত’ এবং টেকচাঁদ ঠাকুর’র ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস’
বাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগে বসে ভাবতে অবাক লাগে উনিশ শতকের শুরুর একটি উপন্যাসে হরিনাথ মজুমদার কিভারে আধুনিকতার লক্ষন যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর চরিত্র সৃষ্টিতেও সৃজনশীলতার সুন্দর কৌশল দেখিয়েছিলেন। তাঁর সামনে তো উপন্যাসের কোন মডেল ছিলনা। তারপরও তিনি উপন্যাস লিখেছেন। একটি গল্প যেখানে এসে থেমে যায় সেখান থেকেই উপন্যাস সামনে এগিয়ে চলার পথে নিয়ে যাবার জন্য গল্পে র বিশেষ দায়বদ্ধতা থাকেনা। কিন্তু এই দায়বদ্ধতা থাকে উপন্যাসের ক্ষেত্রে। গল্প যেখানে ভিত নির্মান করে উপন্যাস সেখানে নির্মান করে বিশাল সৌধ। তাই উপন্যাস একটি বিরাটরে এবং শেষ পর্যন্ত একটি সুনিদৃষ্ট সমাধানের ঈঙ্গিত বহন করে সেই কারনে উপন্যাসের পটভূমি, বিষয়বস্তু, চরিত্র চিত্রন একটি জটিল ব্যপার। এ কাজে যারা সম্যক পারদর্শী তারাই উত্তির্ন হতে পারেন কালের বিচারে। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাসের পটভ‚মি নির্মিত হয়েছে প্রাচীন লোক গল্পের কাহিনি অবলম্বনে।
সমাজ সংস্কারক, সাংবাদিক,সম্পাদক এবং অসাম্প্রদায়িক হরিনাথ মজুমদার’র জীবন কালেই ‘বিজয় বসন্ত’র চতুর্দশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিজয় বসন্ত’ উপন্যাস সম্পর্কে হরিনাথ মজুমদারের জীবনীকার, ঊনিশ শতকের বিশিষ্ট লেখক, ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন’র মন্তব্য- ‘যখন দয়ার সাগর পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় সুললিত বাংলা গদ্যে পুস্তকাদি প্রনয়ন করেন, সেই সময়ে হরিনাথ নদীয়া জেলার একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া‘বিজয় বসন্ত’ রচনা করেন। তিনি স্বীয় প্রতিভাবলে সেই সময় ‘বিজয় বসন্ত’ প্রকাশিত করিয়া পাঠক সমাজের মনোরঞ্জনে সমর্থ হইয়াছিলেন। বলি কি, তাঁহার এই পুস্তক এই শ্রেণীর উপন্যাসের মধ্যে মৌলিকতা, মধুরতা ও প্রকৃত ভাষাগুনে সমাদর লাভ করিয়াছিল’ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার কথাসাহিত্য লিখেছেন কিন্তু তাঁর বড় পরিচয় তিনি গ্রাম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। সেকালে ছোট্ট কিশোরটিও তাঁকে চিনতো ‘এডিটর’মহাশয় বলে। তাঁর সম্পাদিত ‘গ্রামবার্তাপ্রকাশিকা’তে সব সময় তিনি নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কথা বলতেন। স্বশিক্ষিত এই মানুষটি যুগের বিপরিতে অবস্থান নিয়ে বালিকাদের পাঠদানের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিনলেন। তাঁর অনেক গান আছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কিরণচন্দ্র রায়’র কণ্ঠে শোনা যায় তাঁর গান। বাংলাদেশ জতীয় জাদুঘর ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর’ নামে কুমারখালীতে একটি শাখা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে দেশ-বিদেশের লেখক,পর্যটকরা আসেন। এতেই বোঝা যায় কাঙাল হরিনাথ স্বকালে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন একালেও তাঁর পরিচিতি বা জনপ্রিয়তার কমতি হয়নি। অসাম্প্রদায়িক এই কৃতি সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক, সংস্কারক ও সাধক মানুষের মাঝে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শুধূ তাঁর অসংখ্য ভালো কাজের মধ্যে দিয়ে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন