শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ছাত্রদলের কাউন্সিলে সিন্ডিকেটের কালো থাবা

গণতন্ত্র চর্চায় বাধা নিজ দলের নেতারাই

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ১২:১১ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে সর্বস্তরেই ভোটের মাধ্যমে কমিটি করতে চান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরই ধারাবাহিকতায় চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ড্যাবের পর ছাত্রদলের ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী শনিবার। কাউন্সিলকে ঘিরে কোন রকম প্যানেল, লবিং, গ্রুপিং যেনো না হয় সেজন্য শুরুতেই দেয়া হয়েছিল নির্দেশনা।
ছাত্রদলের কমিটি গঠনে যারা সবসময় প্রভাব বিস্তার করেন তাদের সবাইকেই রাখা হয়েছে কাউন্সিল পরিচালনা কমিটিতে। নিয়ম অনুযায়ী ছাত্রদলের কাউন্সিল উপলক্ষে গঠিত নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, যাচাই-বাছাই কমিটি ও আপিল কমিটির নেতারা কোনও প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা কিংবা ভোট চাইতে পারবেন না। কিন্তু এ তিন কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তির পক্ষে কাউন্সিলরদের কাছে ভোট চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে মিটিং করে তাদেরকে সর্তক করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে লিখিত নির্দেশনাও। কিন্তু সতর্ক করে দেয়া, লিখিত নির্দেশনা দেয়ার পরও কোন কাজই হচ্ছে না।
বিএনপির কেন্দ্রীয়, অঙ্গসংগঠনের নেতা এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সমন্বয়ে গড়া সিন্ডিকেটের কালো থাবা পড়েছে ছাত্রদলের কাউন্সিলে। এসব নেতারা বিভক্ত হয়ে গেছেন নানা গ্রুপে। পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে চলছে ব্যাপক লবিং আর তদবির। সেইসাথে ভোটারদেরকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের অফার। নগদ টাকার পাশাপাশি দামি মোবাইল ফোন গিফট, ঢাকা যাতায়াতের বিমান টিকিটেরও অফার। আর ভোট না দিলে ভোটারদের দেখানো হচ্ছে ভবিষ্যৎ রাজনীতি দেখে নেয়ার ভয়ভীতি।
ছাত্রদলের ৫ জন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাত্রদলের সাবেক একজন সভাপতি এবং অঙ্গসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ভোটারদের ফোন করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। তার পছন্দে প্রার্থীকে ভোট দিলে টাকার অফার করা হচ্ছে। নিজ জেলা থেকে ঢাকা যাওয়া আসা বিমান ভাড়া ও ঢাকায় তারকা হোটেলে থাকার অফার দেয়া হচ্ছে। তবে তার কথা না শুনলে ভবিষ্যতে কিভাবে রাজনীতি করি তা দেখে নেয়ারও হুমকী দেয়া হচ্ছে।
ছাত্রদলের কাউন্সিলে সিন্ডিকেটের টাকা উড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তুলে কয়েকজন ভোটার বলেন, এই টাকার উৎস কোথায়? তারা বলেন, সারাদেশে হামলা-মামলায় জর্জরিত নেতা-কর্মীরা ঘরে থাকতে পারেনা। ঠিকমত দু-মুঠো খাবারও জোটেনা অনেকের। অনেকেই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় বাসার দারোয়ান বা রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। অথচ ছাত্রদলের কাউন্সিলকে সামনে রেখে বিমান কর ঘুরে ফিরে ভোট চাচ্ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ঢাকার নামিদামী হোটেলে রুম বুক করে কাউন্সিলরদের থাকার জন্য ব্যাবস্থা করছে। অঞ্চলভেদে নামিদামী স্মার্ট ফোন গিফট করছে কাউন্সিলরদের, মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে কাউন্সিলরদের কাছে। বিএনপির সূত্র জানায়, দুটি বলয় দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। জুয়েল-হাবিব (আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল-হাবিবুর রশীদ হাবিব) কমিটি ছিল বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী বলয়ের। কিন্তু এ্যানী-টুকু ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক হয়ে রাজীব-আকরাম কমিটি গঠন করে। নিজের বলয়কে শক্তিশালী করতে সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ৭৩৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করে তারা। যে কমিটিকে ছাত্রদলের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যর্থ, বিশৃঙ্খল ও বাণিজ্যিক কমিটি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারা। সাবেক কয়েকজন ছাত্র নেতা পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলে তাদেরকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে সতর্ক করে দেন তারেক রহমান। দেয়া হয় লিখিত নির্দেশনাও।
সুলতান সালাউদ্দিন টুকু সভাপতি হিসেবে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে আর এ্যানী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাহনেওয়াজকে প্রার্থী করে পৃথকভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই বলয়কে সমর্থন দিচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মির্জা আব্বাস, ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, হাবিবুর রশিদ হাবিব, রাজীব আহসান, হায়দার আলী লেলিন, আমিরুজ্জামান খান শিমুল। তবে এ্যানী-টুকু বলয়ের সক্রিয় সদস্য শহীদুল ইসলাম বাবুলসহ অনেকেই এই বলয় থেকে এখন নিষ্ক্রিয়।
কট্টর আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসাবে নীতিগতভাবে শ্রাবণের পরিবর্তে লিংকনকে প্রার্থী করার জন্য টুকুকে অনুরোধ করেছিলেন টুকু গ্রুপের সদস্যরা। কেননা শ্রাবণের বাবা যশোরের কেশবপুর আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান, এক ভাই থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, এক ভাই থানা যুবলীগের সাবেক আহবায়ক, আর এক ভাই বর্তমান থানা ছাত্রলীগের আহবায়ক। ছাত্রদলের আরো পরীক্ষিত নেতা থাকার পরও বিতর্কিত শ্রাবণকে ছাত্রদলের সভাপতি প্রার্থী করায় টুকুকে নিয়ে দলের মধ্যে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে, ইলিয়াস গ্রুপের পছন্দের প্রার্থী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার। কিন্তু বিবাহিতের অভিযোগে মেহেদীর প্রার্থিতা বাতিল করে। ইলিয়াস গ্রুপে যোগ্য প্রার্থী না থাকায় সভাপতি হিসেবে তারা ফজলুর রহমান খোকনকে ভেতরে ভেতরে এবং হাফিজুর রহমানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে। সভাপতি প্রার্থী হিসেবে সব থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের প্রার্থী ইলিয়াস গ্রুপ সমর্থিত হাফিজুর রহমান ও উত্তরাঞ্চলের ফজলুর রহমান খোকন। এদের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের এককপ্রার্থী হিসেবে খোকনের রয়েছে বিশাল ভোটব্যাংক। তবে ভোটের হিসেবে পিছিয়ে নেই হাফিজও। তারও রয়েছে বিশাল পরিচিতি এবং ভোট ব্যাংক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির নবীন সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের সকল নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ করে খোকনের পক্ষে মাঠে নামিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলের প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলও খোকনের পক্ষে কাজ করছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন শীর্ষ নেতাও খোকনের প্রতি সমর্থন রয়েছে।
এদিকে যুবদলের নীরব-টুকুর দ্ব›দ্ব ছাত্রদলের কাউন্সিলে প্রভাব ফেলেছে। শ্রাবণের পক্ষে টুকু যেখানেই ভোটের জন্য ফোন করছে পরক্ষণেই নীরব খোকনের পক্ষ হয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাচ্ছে। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আমিরুল ইসলাম খান আলীম উত্তরাঞ্চলের নেতা হিসেবে সুকৌশলে খোকনের জন্য একদিকে যেমন ইলিয়াস গ্রুপের সমর্থন জোগাড় করছে, তেমনই সাইফুল আলম নীরব, আব্দুল বারী ড্যানি, বেনজীর আহমেদ টিটু, আহমেদ আযম খানসহ টুকু বিরোধী সকল নেতাকে খোকনের পক্ষে মাঠে নামিয়েছে। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনেরও সমর্থন রয়েছে খোকনের প্রতি। টুকু গ্রুপ থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল মতিন, আবু সাইদও খোকনের জন্য মাঠে নেমেছে।
কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তাইফুল ইসলাম টিপু, ওবায়দুর রহমান চন্দনও ভোট চাইছেন। সদ্য বিদায়ী ছাত্রদলের সহসভাপতি, তরিকুল ইসলাম টিটু, নাজমুল হাসান, আব্দুল ওয়াহাব, নূরুল হুদা বাবু সকলেই মাঠে নেমেছে। টুকু-এ্যানীর সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য অনেকেই খোকনকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে শ্রাবণের পারিবারিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন হাফিজ। ইলিয়াস আলী গ্রুপের সাবেক ছাত্রদল নেতা সাইফুল ইসলাম জুয়েলের প্রার্থী হিসেবে তিনি পরিচিত।
সাধারণ সম্পাদক পদে ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুনের প্রার্থী মোহাম্মদ কারিমুল হাই নাঈম, হাবিব-রাজীবের প্রার্থী জাকিরুল ইসলাম জাকির, আকরামুল হকের প্রার্থী মো. ইকবাল হোসেন শ্যামলন। তবে পর্দার আড়ালে সাধারণ সম্পাদক নিয়ে হিসাব নিকাশ করছে কে হবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। শাহনেওয়াজ, আমিন, জুয়েল না শ্যামল তা দুই একদিনের মধ্যে জানা যাবে। তবে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাহনেওয়াজকে সমর্থন দিচ্ছে নোয়াখালী অঞ্চলের বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, বেলাল আহমেদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Rubel Hossain ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:০৯ এএম says : 0
বিমান দিয়া ঘুরাঘুরি , ভালোই ।ছাত্রদলের নেতৃত্ব টাকাওয়ালার কাছেই যাক।
Total Reply(0)
সোরইয়ার হোসেন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১০ এএম says : 0
অসাধু সিন্ডিকেটের খপ্পর থেকে বের হতে পারছে না বিএনপি। রাজপথের রাজনীতিতে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কারণে বারবার সমালোচিত হচ্ছে দলটি। এবার ছাত্রদলের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে হেভিওয়েট দুই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে দলের অভ্যন্তরে। আপিল কমিটির সাথে বাছাই কমিটির নেতাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রদলের নেতারা বলির শিকার হচ্ছেন বলেও নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। অসন্তোষ বিরাজ করছে ছাত্রদলের ভোটারদের মাঝেও। দেখা যাক নির্বাচন হতে হতে কি হয়।
Total Reply(0)
মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১২ এএম says : 0
ছাত্রদলের নেতৃত্ব যাবে আংকেলদের হাতে। কারণ বিএনপির ছাত্রসগঠন ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রে আছে ছাত্রদলের নেতা হতে গেলে অবশ্যই বিবাহিত, হতে হবে। যদি বাচ্চা থাকে তাহলে আরো ভাল। বিএনপি যেমন অথর্ব এক সংগঠন, ছাত্রদল তার চেয়ে বেশী অথর্ব এক সংগঠন।
Total Reply(0)
সাইফুল কবির ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১৬ এএম says : 0
ছাত্রদল নতুন কমিটি থেকে যে ভালো কিছু আশা করা ঠিক হবে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।
Total Reply(0)
মেরিন-500 ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১৬ এএম says : 0
যারা নিজ দলে গণতন্ত্র আনতে পারছে না তারা কিসের গণতন্ত্র অধিকার ফিরিয়ে আনতে চাই!!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন