বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চীনের বিনিয়োগেও ধস

পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত : তিন বছরে সূচক সর্বনিম্নে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন থেকেই আস্থাহীনতা বিরাজমান। প্রচার করা হয় বিশ্ব অর্থনীতির নতুন শক্তি চীন বিনিয়োগ করলেই পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে। কেটে যাবে খড়া। কেটে যাবে ক্ষুদ্র-মাঝারি বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা। কিন্তু চীনের বিনিয়োগেও পুঁজিবারের দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না। ঢাকার পুঁজিবাজারে চীনের বিনিয়োগ যেন ‘কাগুজে বাঘ’ পরিণত হয়েছে। গতকাল পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতনে সূচক ৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে গেছে।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, চীন মালিকানা নিয়েছে, তারা মার্কেটে বিনিয়োগ করবে বা অনেক কিছু করবে এটা বলেনি। পুঁজিবাজারের সমস্যা ভালো কোম্পানির অভাব। যে সব কোম্পানি নেয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশই শেয়ার হোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করেছে। পুঁজিবাজারে প্রণোদনার পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফেরাতে আইনকানুন সংস্কার জরুরি।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে পৃথকভাবে নজর দেয়া হয় পুঁজিবাজারে। নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিনিয়োগকারীদের তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। এরই অংশ হিসেবে পুঁজিবাজারে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে বাজেটে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে একগুচ্ছ প্রণোদনা দিলেও কার্যত কোনো উন্নতি নেই। পাশাপাশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন এসেছে দেশের বিনিয়োগেও। অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগ এবং চীনের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারের গতি ফেরাবে এমন ধারণা ছিল বাজার সংশ্লিষ্টসহ সবার। কিন্তু বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। উল্টো নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গতকালও পুঁজিবাজারে সূচকের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ডিএসই’র সূচক ৪ হাজার ৯৩৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এটি আগের তিন বছরের মধ্যে সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান।

এদিকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীন আসায় সকলের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করেছিল চীনা কনসোর্টিয়ামের অর্থ এলে পুঁজিবাজারের চিত্র বদলে যাবে। তারা পুরোপুরিভাবে ডিএসইর সঙ্গে যুক্ত হবে। তাদের ধারণা ছিল চীনের টেকনোলজি যুক্ত হলে সার্ভিল্যান্স আরও শক্তিশালী হবে। তাদের বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করবে। মার্কেটের উন্নয়নে কাজ করবে। মার্কেটে যুক্ত হবে নতুন নতুন পণ্য। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার লেভেল বাড়বে। পাশাপাশি সুশাসন আরও শক্তিশালী হবে। ফলে পুঁজিবাজার আরও শক্তিশালী হবে। আসবে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা। পাশাপাশি তাদের দেখাদেখি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। যা পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। না চীনের প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ, না বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে কোনকিছুই ঠিকঠাকভাবে হচ্ছে না। আর তাই বিনিয়োগকারীরা আস্থা সঙ্কটে ভুগছে। যার প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। প্রতিদিনই পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় নামছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা বাজারে এখন ভালো কোম্পানি নেই। ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। তাই দ্রুত বাজারের চিত্র পাল্টাতে হলে ভালো কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে। ভালো কোম্পানি আসলে চীনসহ বিদেশি ব্যবসায়ীরাও আসবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে শক্তভিত্তির ওপর দার করাতে হলে উচ্চ মহল থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। যা এখনো অনুপস্থিত।

সূত্র মতে, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কর অবকাশ সুবিধা, প্রাথমিক শেয়ারে (আইপিও) বিশেষ কোটা, বিভিন্ন আইনকানুন শিথিল করা এবং ঋণ সুবিধাও দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে তিন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর অন্যতম হল বিনিয়োগকারীদের করমুক্ত লভ্যাংশ দ্বিগুণ করা। নতুন নিয়মানুসারে কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে ৫০ হাজার টাকা লভ্যাংশ পেলে তার জন্য কোনো কর দেয়া লাগবে না। গত অর্থবছরে এই সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর কমানো হয়েছে। আগে এই হার ৪০ শতাংশ। এবারের বাজেটে তা ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ওই প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর ১৫ থেকে কমে সাড়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে বহুল কাক্সিক্ষত চীনা ফান্ডের টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ব্রোকারেজ হাউজ মালিকরা। যারা কর ছাড় নিয়ে এই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, এরই মধ্যে তাদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ। অথচ চীনা ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ পুঁজিবাজারের গতি ফেরাবে এমন ধারণা ছিল তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব হাউজ মালিক চীনা ফান্ডের অর্থে কর সুবিধা নিয়েছেন, তারা নির্দিষ্ট বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এর সময়সীমা শেষ হয়েছে গত মার্চে। এ সময়ের মধ্যে তারা পুঁজিবাজারে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তিন বছরের আগে তারা ওই অর্থ পুঁজিবাজার থেকে তুলতে পারবেন না। তবে এ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ করা শেয়ার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ তারা তুলতে পারবেন। অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, চীনা ফান্ড থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বলে যারা কর সুবিধা নিয়েছেন, তারা অনেকেই এই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেননি।

ঢাকা এস্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ারহোল্ডাররা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বলে চীনা ফান্ডের অর্থ থেকে কর সুবিধা নিয়েছেন। সবাই এই অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। যদি না করে থাকেন, এটি বোঝা যাবে এক বছরের হিসাব দাখিল করার পর।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চীনা ফান্ডের অর্থ থেকে ২৪০ জনের মধ্যে কর সুবিধা নেননি ৫৬ শেয়ারহোল্ডার। এদিকে তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন, এখন তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। কারণ, এরই মধ্যে তারা গুনতে শুরু করেছেন লোকসান। একাধিক ব্রোকারেজ হাউজে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।

ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বলেন, যারা কর সুবিধা নিয়েছেন, তাদের সবাই এ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। যদি কেউ না করে থাকেন, এর সংখ্যা ১০ জনের বেশি হবে না। এমন হলে তাদের অর্থ থেকে আরো ১০ শতাংশ ট্যাক্স কেটে নেয়া হবে।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্য ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. সাঈদ হোসেন খন্দকার ইনকিলাবকে বলেন, চীন পুঁজিবাজারের মালিকানা পাওয়া এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এক গুচ্ছ উদ্যোগে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আমার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু আমাদের গোড়ায় গলদ। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অতীব জরুরি। পাশাপাশি আইনের সংস্কার করতে হবে। এটা করতে পারলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, চীন মালিকানা নিয়েছে, তারা মার্কেটে বিনিয়োগ করবে বা অনেক কিছু করবে এটা বলেনি। তারা যেহেতু মালিকানা নিয়েছে তাই যা করার করবে। কিন্তু এটা পুঁজিবাজারের সমস্যা নয়। পুঁজিবাজারের সমস্যা ভালো কোম্পানির অভাব। তিনি বলেন, এ দেশে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, তারা পুঁজিবাজারে আসছে না। যে সব কোম্পানি নেয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশই শেয়ার হোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করেছে। এ প্রশ্ন তো উপর থেকে কেউ করছে না। তাহলে কিভাবে আশা করা যায়, শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বা আস্থায় ফিরবে। একই সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকার, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ প্রতিদিনই বাংলাদেশের পুুঁজিবাজারকে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা কোনো ভালো বার্তা পাচ্ছে না, তাই এখানে বিনিয়োগ করছে না। প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, প্রণোদনার পরিবর্তে আইনকানুন সংস্কার জরুরি। না হলে বিনিয়োগকারীরা আরও আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে গতকালও পুঁজিবাজারে সূচকের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচক ৭৫ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৯৩৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এটি আগের তিন বছরের মধ্যে সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক নেমেছিল ৪ হাজার ৯২৪ পয়েন্টে। ওইদিনের পর গতকাল বুধবার সূচক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতনের পেছনে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন ডিএসই’র সাবেক সভাপতি মো. শাকিল রিজভী। তিনি বলেন, দেশের আর্থিক সেক্টরের সার্বিক প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে একটি লিজিং কোম্পানি অবসায়নের কারণে এই খাতে ব্যাপক ধস নেমেছে। যার প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি গ্রামীণফোনের শেয়ার নিয়ে অস্থিরতা এবং আইপিও‘র মাধ্যমে ৫শ’ কোটি টাকা তুলে নেয়ায় পুঁজিবাজারে কিছুটা তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে এমন দরপতন হচ্ছে। এছাড়াও সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে এমন ঘোষণা নিয়ে বাজারে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, এসব কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ash ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৫:৫২ এএম says : 0
CHORRR BATPARDER NIONTRONE PUJI BAJAR THAKLE KONOKISUTEI KISU HOBE NA !!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন