শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

চোখের জল নীল

শফিক নহোর | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকালে মনে হয় জীবনটা ঠিক এভাবে কবে যেন ডুবে যাবে, একটা অলিক মায়ায় সংসারের টানে পরে থাকতে হয় শামুকের মত। অপ্রাপ্তির ব্যথায় মাঝে-মধ্যে বেদনার ঝড় শুরু হয় মনের ভিতরে। চারিদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরূপ হলেও সংসারে অভাব অনটন আলোকিত সুখকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, ডানাভাঙা পাখির মত ছটফট করতে হয় রাতদিন অবধি। সংসারে একটু সুখ ফিরে আসুক। আজাদ সারাদিন অফিসে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে, সংসারের হাল ধরার জন্য। আমি কিছু ছেলেমেয়ে প্রাইভেট পড়াতাম, আজাদের মন তা সায় দেয়নি। আমি কিছুদিন পর তা ছেড়ে দেই। এদিকে আমার ছেলেকে সময় দিতে হয়। আজাদের বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে, শুরু হয় তার পেনশনের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে। পারিবারিক রিষারিষি যা আমাকে ব্যথিত করত ,
-বৌমা, ‘ তোমার ব্যাংক একাউন্টে কিছু টাকা রেখে দিতে চাই ? আজাদ যেন তা না জানে ।
-বাবা আপনার ছেলের একাউন্টে রাখলে বেশি ভাল হয়, আজ বাদে কাল কেউ না— কেউ জানবে , তখন আপনাকে সবাই দোষারোপ করবে, আমি আপনাকে নয়-ছয় বুঝিয়েছি, একথা বলবে। তা-ছাড়া সুমি জানতে পারলে আমাদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাধাবে। তারচেয়ে আপনি টাকা পাবার পর, সুমি এবং আজাদকে সমান করে ভাগ করে দিন। সুমির বিয়ের সময় শুনেছি , অনেক টাকাপয়সা খরচ হয়েছে ; এ-বাড়ির সবার-মুখে শুনেছি , লোকমুখে অনেকই বলাবলি করেছে অনেক দেনা-দায়িক আছেন। সে টাকা নিয়ে আজাদকে দেখতাম ভীষণ চিন্তিত।
-বৌমা তুমি এক হিসেবে ঠিকই বলেছো, ‘যাক বাদ দাও সে কথা।
-আজাদ এখনো আসছেনা কেন? তোমাকে কি কিছু জানিয়েছে , বৌমা?
-না বাবা , কিছুই তো জানাই নি ।
-আজাদকে ফোন দিয়ে দেখছি ফোনে পাওয়া যায় কি-না ,
-হ্যালো এতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি রিসিভ করছে না কেন?
-আমি অফিসে ব্যস্ত আছি , তোমাকে ফ্রি হয়ে ফোন দিবো , রাখছি এখন ।
-আম্মা বাবা এখনো আসছে না কেন?
-রিয়ান বাবু পড়তে বসো , তোমার বাবা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে । আমাকে বিরক্ত করো না প্লিজ !
রিয়ান বই নিয়ে একাই পড়তে বসেছে , আমি বাহিরের লাইটটি জ্বালিয়ে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম, বাহিরে কেমন যেন ঘন অন্ধকার মনে হচ্ছে আজ। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে আমাবশ্য আজ । বই খাতা উল্টো পালট করছে , রিয়ান, আমি খুব আদর করে ওর স্কুলের পড়া গুলো দেখিয়ে দিলাম। অনেক হোম ওয়ার্ক বাকী , ছোট বাচ্চাদের এত হোম ওয়ার্ক দেয়। যা দেখলে আমার নিজেরই মাথা ঘুরা শুরু হয়।
-রিয়ান আবার ও জিজ্ঞাসা করল, আম্মা বাবা এখনো আসছে না কেন ?
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে ,পরাণটা অস্থির হয়ে আসছে , অস্বস্তি ও দুর্বল লাগছে । আজাদ এখনো আসছে , অফিসে ফোন দিলাম। মেয়েটি বলল, স্যার তো সন্ধ্যা সাতটার দিকে বের হয়েছে, আমি মনে-মনে অনেক কিছু ভাবছি , আগামী কাল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। হয়তো , আমাকে কোন সারপ্রাইজ দিবে, হয়তো আমাকে না জানিয়ে মার্কেটিং করতে গেছে। কিন্তু এত রাত পর্যন্ত। তার পরে মোবাইল ফোন বন্ধ । এগারটা বেজে গেছে , আমার প্রচন্ড চিন্তা হতে লাগলো। বারটার দিকে, সুমিকে ফোন দিলাম,
-সুমি, তোমার ভাইয়া কি? তোমাদের ওখানে গেছে ।
- না তো ভাবি ভাইয়া আসেনি ?
- কেন ? কোন সমস্যা ?
- এত রাত হয়ে গেল, এখনো বাসায় আসছে না , তার পরে ফোন বন্ধ ।
- দেখি, আজাদের বন্ধুদের কাছে ফোন দিয়ে।
রাতে একে একে আজাদের বন্ধুদের ফোন দিয়েছি , কেউ আজাদের সন্ধান দিতে পারলো না। রাত দুন্টার দিকে পুলিশকে কমপ্লায়েন্ট করা হল, আমাকে সান্তনা দিল বলল,
-চিন্তা করবেন না । বিষয়টা আমারা দেখছি,
সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি, রিয়ান বার বার ওর বাবাকে ডাকছে, আমি কতবার ঘুমাতে বললাম, ছেলেটা কোন ভাবেই ঘুমাতে পারেনি। পরের দিন শোনতে পেলাম, গুলশান লেকের পাশে একটা লাশ পরে আছে পুলিশ আমাকে ফোন দিয়েছে, আমার ছেলে ও আমার শ্বশুরকে নিয়ে গুলশান থানায় গেলাম। লাশ দেখে আমি চিনতে পারলাম এটা আজাদের লাশ। আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না, আমার কোন শক্তি নেই, আজাদের বাবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আজাদের কবর দেখতে প্রতি বছর গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়। ‘‘আজাদের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয়, আজাদ আমাকে পিছন থেকে ডাকছে, কতবার পিছনে ফিরে দেখি, বারবার ধোঁকা খেয়ে যাই , আজাদের আজ পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী । আমাদের আজ বিবাহ বার্ষিকী !› আজাদ মরে যাবার পরে কখনো তা পালন করা হয়নি , আমি মৃত্যু বার্ষিকী পালন করি । থানা পুলিশ কত কিছু হল । পুলিশ আজাদের খুনিকে ধরতে পারেনি আজো।
আমি রিয়ানকে স্কুলে যখন নিয়ে যেতাম, রাস্তায় বখাটে ছেলেরা আমাকে উত্যক্ত করতো, হুমকি দিতো, আমার শ্বশুরকে সব বলতাম, থানায় জানানো হয়েছিল, থানা থেকে আজাদের মার্ডার কেস তুলে দিতে বলতো , রিয়ান ও অসুস্থ শ্বশুরকে নিয়ে আমি খুব বিপদে পড়ে যাই, আজাদের মৃত্যুর পর সুমি , সবকিছু ভাগ করে নিয়েছে , পেনশনের টাকা , বাড়ির জমি কিছু নগদ অর্থ । সংসার চালানোর মত অবস্থা নেই , শ্বশুরের পেনশনের সাত-লক্ষ টাকা । কিছু দেনা-দায়িক ছিল , তার মধ্যে টাকা সমান দু›ভাগ করা হয়েছে , তার অর্ধেক নিয়েছে সুমি । সুমির স্বামী নেশাগ্রস্ত, শহরে নেতামো করে । তবুও আমাদের সংসারের চেয়ে তদনন্তর ভাল চলে ওদের । তিনলক্ষ টাকা একটি ব্যাংকে ফিক্সড করে রাখা , পরের বছর আমার শ্বশুর বিয়োগ হল আমাদের মায়াময় পৃথিবী থেকে , অতঃপর আমি মায়ের কাছে চলে যাই গ্রামে । রিয়ানকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম ।
ক›য়েক বছর পরে ,
আমার ভাই, শহিদুল , খুব ভাল মানুষ, ভাল একটা চাকরি করে, এখনো বিয়ে করেনি, মা খুব মেয়ে দেখছে, ভাইয়ের ছুটির দিনে মেয়ে দেখার ধুম পরে যায় । অবশেষে ভাইয়ার বিয়ে হল। বিয়ের পর থেকে শুধু হল আমাকে নিয়ে ঝামেলা।
আমাকে কেন? খেতে দেয় । আমার ছেলের লেখাপড়ার খরচ কেন বহন করছে, এ নিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে ভাবির মাঝেমধ্যে ঝগড়া হয়, প্রথম দিকে ভাইয়া এ বিষয় গুলা আড়াল করতে চাইত, পরিবেশ এমন হয়েছিল ,ভাইয়া পারতো না। আমাকে ডেকে নিয়ে একদিন বলল,
-পলিদি তোকে একটা কথা বলবো বলবো বলে বলতে পারছি , তুই কথা গুলো কিভাবে নিস । আমি জানি কথা গুলো শোনার পর তুই খুব কষ্ট পাবি রে পলিদি । প্লিজ ! কথা গুলো একটা সহজ ভাবে নিবি তুই , আমি তুই এক বছরের ছোট বড় হলেও , আমাদের সম্পর্ক ঠিক বন্ধুর মত ।
-ঠিক আছে এমন ভঙ্গিমা করবার কি আছে , যা বলার বল শুনি ।
রুপা , পছন্দ করে না তোরা আমাদের সঙ্গে থাক । আমি ভাবছি কি মাসে-মাসে তোকে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিবো , তুই রিয়ানের দাদা বাড়ি চলে যা , সেখানেই তো রিয়ানের আসল বাড়ি ।
আমার চোখ ভিজে , আসছে , শহিদুলের কথা শুনে মনে হচ্ছে কেউ আমার কানে গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে । আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির পিছন দিয়ে বাড়ির প্রবেশ পথে রুপা ভাবির সঙ্গে দেখা , মুখে মেকি হাসি এনে বললাম , ভাবি এত রোইদ এর মধ্যে কোথায় যান । আপনার ভাইকে দেখছি , বললো পুকুর পাড় থেকে আসছি , দেখলাম না তো পুকুর পাড়ে । ভাবি ভাইয়াকে নজরদারিতে রাখছে , আমি বুঝতে পারলাম। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ভাইয়া , আমার ও রিয়ানের সঙ্গে তেমন কোন কথা বলে না । ভাইয়ার সুখের কথা চিন্তা করে , আমি সিদ্ধান্ত নেই , এখানে আর থাকবো না । বিষয়টা মাকে জানালাম , মা খুব আঘাত পেয়েছে মনে। কোন কথা বললো না । হয়তো পরে কোন এক সময় মা ভাইকে বিষয়টা বলেছে , পলি চলে যাবে । মানুষ কি বলবে । সাত পাঁচ অনেক কথা হয়েছে । ভাবির সঙ্গে প্রায় সময় ভাইয়ার ঝগড়া লেগে থাকতো , একদিন সকালে উঠোন ঝাড়ু-দিতে গিয়ে দেখি ভাইয়া , আমাদের রান্না ঘরের পাশে কাঁঠাল গাছে ফাঁসি নিয়েছে , মানুষ এত আঘাত সহ্য করতে পারে । ভাইয়ার লাশ কাঁচি দিয়ে কেটে মাটিতে নামানো হলো । মা প্রায় পাগল হয়ে গলে । মাঝে মধ্যে খুব হাসতো , কারো সঙ্গে কথা বলতো না । আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে থাকতো । ভাইয়া মারা যাবার তিন মাসের মাথায় , ভাবি নিখোঁজ ! পরে আমারা জানতে পারলাম । ভাবি পরকীয়া করে অন্যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে করেছে ; সংসারের হাল ধরবার মত কিছুই রইল না । আমার পিট একেবারে দেওয়ালে টেকে গেছে । আমি নাজির-গঞ্জ বাজার থেকে বলরাম কাকার ঘি , অনলাইনে বিক্রয় করতে লাগলাম । প্রথম দিকে খুব কঠিন হয়ে গেল আমার জন্য । তবুও আমি
থেমে যায়নি। আমার এক বন্ধুর পরামর্শ নিয়ে শুরু করলাম, ই-কর্মাস ব্যবসা। লোকজন আমার ঘি ,খুব পছন্দ করতে লাগলো। বিকাশে টাকা চলে আসতো আগেই, সে টাকা থেকেই বলরাম কাকাকে টাকা দিয়ে দিতাম আমার লাভের অংশ রেখে। আজ আমার ছেলে কলেজে পড়ছে। আমি ব্যবসা শুরু করছি , নিজের মত করে। আমার আন্ডারে অনেক ছেলে-মেয়ে কাজ করে। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি, এখন মনে হয় সুখেই আছি। সত্যি বলতে কি সুখ হলো আপেক্ষিক বিষয়।
আমার ননদ আজ আমার দোকানে চাকরি করছে, পুলিশ আজাদের আসামিকে ধরতে পারছে। পুলিশ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই পারে। সুমি আমার সামনে মাথা নিচু করে চলে। ওর কস্টাও আমার চেয়ে কম কিসে? নিজের স্বামী তার আপন ভাইয়ের খুনি। আমি বিধবা কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে সাহস দিচ্ছি। নিজেকে ঘরে বসে না রেখে কিছু একটা করাতে। আগামী দিনগুলি শুধুই মেয়েদের স্বপ্ন পূরণের আর প্রতিশোধের। সমাজের অবহেলিত মেয়েরা আজ স্বপ্ন দেখে নিজের পৃথিবীটা নিজের মত করে সাজাতে। আজ আজাদের একুশ তম মৃত্যুবার্ষিকী। সে ছিল সৎ ও দেশপ্রেমিক। আজ সংবাদ পেলাম রিয়ান বিসিএস –এ পাশ করছে, আমি আজ খুব আনন্দিত! দুটি চোখের জল সত্যি দু’রকম একজন মায়ের -এ থেকে আর কি বড় স্বপ্ন হতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
ওমর ফারুক ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৮:৫৬ পিএম says : 0
সুন্দর লিখুনি । আরো বেশী করে শফিক নহর লেখা প্রকাশ করলে পডে আনান্দ পাব।
Total Reply(0)
ওমর ফারুক ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৮:৫৬ পিএম says : 0
সুন্দর লিখুনি । আরো বেশী করে শফিক নহর লেখা প্রকাশ করলে পডে আনান্দ পাব।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন