বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আমরা যতই নদী রক্ষার কথা বলছি এবং সরকারি সংস্থাগুলো নদী বেদখলমুক্ত করতে যতই অভিযান পরিচালনা করছে, ততই বাড়ছে নদী দখলের ঘটনা। নদীর একস্থানে উদ্ধার অভিযান চলছে তো অন্যস্থান নতুন করে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। একদিকে ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হচ্ছে, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তা পুনরায় দখল হয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এমনকি হাইকোর্টের তরফ থেকেও সরকারের এহেন উচ্ছেদ অভিযান এবং পুনরায় বেদখল হয়ে পড়ার এই বাস্তবতাকে ইঁদুর-বিড়াল খেলা বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ এসব উচ্ছেদ অভিযানের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অনেকে এসব উচ্ছেদ অভিযানকে লোক দেখানো বা ফটো সেশন হিসেবেও অভিহিত করছেন। স্থানীয় প্রশাসন এবং বিআইডাবিøউটিএ’র এক শ্রেণির কর্মকর্তার যোগাসাজশেই প্রভাবশালী দখলদাররা নদী দখলের মচ্ছব চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যায়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের অন্যতম বড় নদী মেঘনার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় নদী দখল করে নতুন সিমেন্ট কারখানা গড়ে তোলার ছবি ছাপা হয়েছে। নদী তীরের বিশাল এলাকা জুড়ে বেড়া দিয়ে রড-কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, নদী রক্ষা কমিশনের নজরদারি কোথায় কেউ জানে না। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা ছাড়া তাদের যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই। বছরের পর বছর ধরে প্রথমে দখল অতঃপর দখলকৃত জায়গায় ব্যাপক আয়োজনের সাথে কলকারখানা গড়ে তুললেও কেউ বাধা দেয় না। অথচ শুরুতেই বাধা দিলে উচ্ছেদ অভিযানের প্রয়োজন হতো না।

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদীসহ ঢাকার চারপাশের নদনদীগুলো দখলে-দূষণে মৃত প্রায়। অব্যাহত দখলবাজি ও ভরাটের কারণে নদীর প্রশস্ততা ও পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে কোথাও কোথাও সংকীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে। যথেচ্ছ স্থাপনা নির্মাণ, নদীতে সরাসরি শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার কারণে এসব নদীর পানি ইতোমধ্যেই তার উপযোগিতা হারিয়েছে। ঢাকা শহরের ২ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে ঢাকা ওয়াসা ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি গতানুগতিক পরিশোধন ব্যবস্থায়ও পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। শহরের চারপাশের নদীগুলো দূষণমুক্ত করা সম্ভব হলে পানির চাহিদা পূরণ অনেক সহজ হতো। এখন রাজধানীর গন্ডি পেরিয়ে আশপাশে, বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব নদনদীতেই দখলবাজি চলছে। সোনারগাঁওয়ে কথিত বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মেঘনা নদী দখল এবং যশোরে ভৈরব নদ দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারাদেশেই নদনদীগুলো দখল-ভরাট ও বেপরোয়া দূষণের শিকার হচ্ছে। গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সরকারের সংশ্লিষ্টরা মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে। নদীরক্ষা কমিশন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পেয়ে মাঝে মধ্যে কিছু রিপোর্ট ও পরিকল্পনার তথ্য প্রকাশ করে, ব্যস এই পর্যন্তই, দখলবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। নদী উদ্ধার ও সংরক্ষণে কার্যকর কোনো স্থায়ী পদক্ষেপও দেখা যায় না।
চলতি বছরের শুরুতে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন সারাদেশে জেলা প্রশাসকদের কাছে নদী দখলের সাথে জড়িতদের নামের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছিল। জেলা প্রশাসকদের পাঠানোর তালিকার সূত্র ধরে সারাদেশের নদীদখলদারদের নামের তালিকা বা সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সারাদেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৭৪২ জন। তবে একথা ঠিক যে, কথিত তালিকার সব দখলদারের অবস্থান সমান নয়। কেউ কেউ নদীভাঙ্গনের শিকার হয়ে নদী তীরে হয়তো নিজের বসতবাড়ি গড়ে তোলতে বাধ্য হয়েছেন। নদীর স্বাভাবিক সীমানা বিকৃত বা পরিবর্তন ঘটে, গতিশীলতায় বিঘœ সৃষ্টি করে এবং দূষণ ঘটায় এমন যে কোনো কর্মকাÐ দখলবাজি হিসেবে গণ্য হবে। তবে নদীতে বেড়া দিয়ে ভরাট করে অথবা কংক্রিটের পিলারের উপর স্থাপনা বা কলকারখানা নির্মাণকারিরাই হচ্ছে আসল ভূমিদস্যু ও দখলবাজ। ঢাকার জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে ঢাকার চারপাশের ৫টি নদীতে ৯৫৯ জন দখলদারের নামের তালিকা জমা দেয়া হয়েছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের কাছে। তালিকায় কাদের নাম আছে এবং তাদের পরিচয় প্রকাশ করা সমীচীন বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে এবার শুরু হোক জবাবদিহিতা ও বিচারের পালা। আইনের ফাঁক-ফোকড় বা দীর্ঘসূত্রতার জেরে এরা যেন পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেশ নজর দিতে হবে। একশ্রেণির মানুষ দশকের পর দশক ধরে নদ-নদী ও সরকারি জমি দখল করে ভোগদখল করে এলেও কোনো জবাবদিহিতা বা বিচারের সম্মুখীন না হওয়ায় সারাদেশে দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে। এখন দখল উচ্ছেদের সাথে সাথে উদ্ধারকৃত জমির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীর সীমানা সুনির্দিষ্ট করণ এবং তীর সংরক্ষণ, সবুজ বেষ্টনি ও ওয়াকওয়ে গড়ে তোলার পাশাপাশি জনকল্যাণে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীতে কলকারখানার বর্জ্য ফেলা এবং অননুমোদিত ও বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাবিহীন কলকারখানা উচ্ছেদ করতে হবে। যাদের অবহেলা বা যোগসাজশে নদনদী দখল হয়েছে, তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন