বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

অর্থকড়ির প্রতি মানুষের লোভ চিরন্তন একটি বিষয়। যে কোনো উপায়ে হোক, অর্থ রোজগার করা মানুষের স্বভাব। লোভও বটে। মানুষের এই স্বাভাব ও লোভকে পুঁজি করে একশ্রেণীর ভুঁইপোড় লোক ও প্রতিষ্ঠানও ব্যাপকহারে কাজ করছে। মানুষকে অল্প পুঁজি লগ্নি করে বেশি লাভের আশা দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের পুঁজি সংগ্রহ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এতে যেসব মানুষ তাদের নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ ও লোভাতুর হয়ে বেশি আয়ের উদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের আম-ছালা দুটোই চলে যায়। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করেও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কোনো সন্ধান পায় না। ফলে জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া গতি থাকে না। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমএলএম কিংবা বিভিন্ন সমিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিদের বিনিয়োগ এবং তা খোয়ানোর করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক, লিজিং কো¤পানিসহ প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ, মাল্টি লেবেল মার্কেটিং (এমএলএম) এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দাদন ও সুদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন গ্রামের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী, তরুণী, বেকার তরুণ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। মনভোলানো কথায় মুগ্ধ হয়ে প্রবল আস্থা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি, এমএলএম এবং সুদকারবারিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সঞ্চিত অর্থ। বিপরীতে তারা হচ্ছেন প্রতারিত। অর্থনৈতিকভাবে হচ্ছেন নিঃস্ব। স¤পর্কচ্ছেদ হচ্ছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের। বোনের সঙ্গে ভাইয়ের। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। সুখী পরিবারে নেমে আসছে অশান্তির কালো মেঘ। অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অনেক। চ‚ড়ান্ত ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে পার¯পরিক স¤পর্ক। দেশজুড়ে নীরবে চলছে এমন ভয়াবহ ঘটনা। 

‘অতি লোভে তাতী নষ্ট’ এমন একটি প্রবাদ আমাদের দেশে বহুল প্রচারিত। প্রবাদটি জানা থাকা সত্তে¡ও আমাদের অনেকেই সতর্ক হচ্ছে না। লোভের প্রলোভনে যেমন প্রলুব্ধ হচ্ছে, তেমনি সব হারিয়ে নিঃস্বও হয়ে যাচ্ছে। জীবনের সঞ্চিত শেষ সম্বলটুকু ভুয়া, প্রতারক, অনরেজিস্টার্ড এমএলএম, সামিতির অতি লাভের প্রতিশ্রুতিতে মুগ্ধ হয়ে কোনো খোঁজ-খবর বা বাছ-বিচার না করেই মানুষ লগ্নি করছে। মাসে পর মাস কিস্তি পরিশোধ করে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে দেখা যায়, অধিকাংশ এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস থাকে না। তারা মানুষের সঞ্চিত কোটি কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। যে ব্যক্তি অতি লোভ এবং অতি লাভের আশায় বিনিয়োগ করলো, সে নিঃস্ব হয়ে বসে পড়ছে। তখন আর তার কিছুই করার থাকে না। কোনো প্রতিকারেরও ব্যবস্থা পায় না। কার কাছে প্রতিকার চাইবে। যে প্রতিষ্ঠানের সরকারি বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদনই নেই, সে প্রতিকার পাওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত সেসব প্রতিষ্ঠানেরও অনেকগুলো মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে লোপাট করে দিচ্ছে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে গ্রাহকদের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এক ডেসটিনির কথাই যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে এ প্রতিষ্ঠান মানুষের শত শত কোটি টাকা লোপাট করে এখন বিচারের সম্মুখীন। সম্প্রতি আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড গ্রাহকের ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যেখানে রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের অর্থ লোপাট করে দিচ্ছে, সেখানে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা অজানা-অচেনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতারণার ফাঁদ পেতে মানুষের অর্থ লোপাট করবেই। সমবায় অধিদপ্তরের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে ১ লাখ ৭৪ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। এর মধ্যে মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি রয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার। এগুলোর মধ্যে নিবন্ধিত মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি ২৬৫টি। গত এক দশকে এই সমিতিগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আত্মসাৎকৃত এই অর্থ বিদেশে পাচার, ভূসম্পত্তি ক্রয় ও সমিতির কর্মকর্তাদের ব্যক্তি সম্পত্তি কেনায় ব্যয় হয়েছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বেশির ভাগ রেজিস্টার্ড সমবায় সমিতি মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লোপাট করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। অন্যদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আনরেজিস্টার্ড সমবায় সমিতিগুলোর কি অবস্থা তা বুঝতে বাকি থাকে না। মানুষ যথাযথভাবে খোঁজ-খবর না নিয়ে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর অতি লাভের লোভ দেখানো কথাবার্তা শুনে অতি লোভের আশায় বিনিয়োগ করেছে এবং করছে। ফলস্বরূপ সব হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। পারিবারিক অশান্তি, সংসার ভাঙা এমনকি আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছে। এর জন্য নিজেদের লোভ এবং অজ্ঞতাই দায়ি। অন্যদিকে দায়ি এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান যারা দোকান খুলে মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এটা দোকান খুলে এক ধরনের ছিনতাই করা। কথার প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে এসব প্রাতিষ্ঠানিক ছিনতাইকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সমবায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। কারণ সমবায়ের নাম করেই এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে এবং মানুষকে নিঃস্ব করছে।
সমবায়ের নামে অনিবন্ধিত সমিতি বা এমএলএ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারিদের সচেতন হওয়া জরুরি। তারা সচেতন হবে এভাবে, যে প্রতিষ্ঠান যত লাভেরই প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, কিংবা অল্প পুঁজিতেই লাখপতি, কোটিপতি বানিয়ে দেবে বলে আশা দেয়, সে প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার্ড কিনা তা যথাযথভাবে যাচাই করা, যাতে অর্থ লোপাট করলেও প্রতিকার পাওয়া যায়। অতি লাভ এবং লোভের কারণে বিনিয়োগ করা থেকে সংযত থাকতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে, দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠা যেসব সমবায় সমিতি রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা। মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকে কীভাবে এসব নন ব্যাংকিং লেনদেনকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিংয়ে নিয়ে আসা যায়, তার নীতিমালা প্রণয়ন করা। পাশাপাশি ভুয়া সমবায় সমিতিগুলোকে চিহ্নিত করে সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করার জন্য বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা। কোনটি সঠিক, কোনটা বেঠিক-এ বিষয়গুলো জনসম্মুখে তুলে ধরা। মানুষ বিনিয়োগ করে লাভের আশা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের এই বিনিয়োগ যাতে কেউ মেরে উধাও হয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করা সমাবায় অধিদপ্তরের দায়িত্ব। দেশে যে লাখ লাখ সমবায় ভিত্তিক সমিতি রয়েছে, এগুলোতে মানুষের বিনিয়োগকে নিরাপদ করতে এখনই উদ্যোগ নেয়া দরকার। দরিদ্র মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে ফর্মাল ফিন্যান্সিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এতে দেশে যেমন বিনিয়োগ বাড়বে, তেমনি মানুষের সঞ্চয় নিরাপদ থাকবে এবং তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন