শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বপ্ন ছাড়া দেশ-জাতির কল্যাণ করা যায় না

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালি জাতি তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা এনে দেবেন। শহীদ জিয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন, নবতর রূপ দেবেন, জনগণকে জাগিয়ে তুলবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা, চীনের মাও সে তুং, ইরানের ইমাম খোমেনি, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্নÑ তারা সবাই স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্ন না থাকলে তারা বড় কিছু হতে পারতেন না। জাতির জন্য যা করেছেন তা করতে পারতেন না। ছোটবড় সবারই স্বপ্ন থাকে। কারো স্বপ্ন সফল হয়, কারো হয় না। আমিও স্বপ্নহীন মানুষ নই। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৫ জুন ১৯৯৬ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থাকা অবস্থায় আমার মনের অভ্যন্তরে, চিন্তাজগতের গভীরে লক্ষ্যবস্তু চলাচল করছিল। পেশাদার সৈনিকের জন্য উল্লেখযোগ্য ‘ভদ্র’ লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, পেশার সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া। দুর্ঘটনাক্রমে যখন ১৯৯৬ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে গেলাম, তখন লক্ষ্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তায় বসলাম। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কোথাও আর চাকরি করব না। কিন্তু আমার চিন্তাজগতের মোড় তথা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে ঢাকা মহানগরের বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।

নিজের চিন্তা ও আগ্রহকে পরিশীলিত এবং প্রস্ফুটিত করতে সাহায্য করেছে ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত আমার নাগরিক জীবনের কর্মকাÐ এবং সাথীরা। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সে লক্ষ্য স্থির হয়েছিল এরূপ : স্বীকৃত পন্থায় জনগণের খেদমত ও সেবা করার সুযোগ চাই। তাহলে আমার কণ্ঠকে, আমার আহŸানকে, আমার বক্তব্যকে, আমার নিবেদনকে যত বেশি সম্ভব বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে পৌঁছাতে হবে। মাহাথির মোহাম্মদ ২১-২২ বছর বয়সে যা চিন্তা করেছিলেন, আমি সেটা ৫৭-৫৮ বছর বয়সে চিন্তা করছিলাম। বলে রাখা ভালো, ৫৭-৫৮ বছর বয়সে মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়া নামক দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
আমার কথায় ফিরে আসি। যাদের কাছে আমার এই আহŸান, বক্তব্য ও নিবেদন পৌঁছেছে এবং পৌঁছবে, তাদের মধ্য থেকেই সহকর্মী ও সহযোদ্ধা পেয়েছি এবং পেতে হবে। সাড়ে ছয় বছর ধরে পেয়ে আসছি, আরো পেতে হবে। একের বোঝা, দশের লাঠি- এটা একটা বাংলা প্রবাদ। আরেকটি প্রবাদ হচ্ছে, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন এবং এই পরিবর্তন একা কোনো একজন ব্যক্তি পূর্ণভাবে আনতে পারবেন না, সমষ্টিগত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রাজনীতি। আন্দোলন হচ্ছে রাজনীতির একটি অংশ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিগত বিভিন্ন দশকে তথা বিভিন্ন সময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকেও ওই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। প্রতি আন্দোলনের একাধিক পর্যায় থাকতে পারে, যেমন এক রকম হচ্ছে: শর্ট টার্ম বা নিকট মাত্রা বা তাৎক্ষণিক বা অতি সা¤প্রতিক। আরেক রকম হচ্ছে: দীর্ঘমেয়াদি বা দূরবর্তী মাত্রার। কিন্তু এ মুহূর্তে কোনো উল্লেখযোগ্য আন্দোলন চলমান না থাকলেও নতুন করে বা হঠাৎ কোনো আন্দোলন যে গড়ে উঠবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদি আন্দোলন হয়, তাহলে সে আন্দোলনেরও এরূপ দু’টি সময়ভিত্তিক মাত্রা থাকতে পারে। যেটাই হোক না কেন, দিনের শেষে তথা আন্দোলনের শেষে আমরা পরিবর্তন চাই। সরকার যারা পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যে যেমন দলীয় পরিবর্তন চাই, আবার পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের মধ্যেও গুণগত পরিবর্তন চাই। তাহলেই আন্দোলন যথার্থ মর্যাদা পাবে।
মোট ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডা: মাহাথির মোহাম্মদ। এই ২২ বছরে তিনি অনগ্রসর পশ্চাৎপদ কৃষিমুখী একটি দেশ ও সমাজকে পরিণত করেছিলেন শিল্পমুখী বা শিল্পের পথে অগ্রসরমান উন্নত দেশে, যে দেশটি পৃথিবীর সব দেশের তালিকায় ব্যবসার পরিমাপে ১৭তম বৃহৎ ব্যবসায়ী দেশ হয়ে উঠেছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেয়ার পর কয়েক বছর সময় নিয়ে তার আত্মজীবনী লিখেছেন। ইংরেজি ভাষায় লিখিত বইটি ৮৪৩ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। প্রথম প্রকাশ হয়েছে ২০১১ সালে। ওই বইয়ের নাম- ‘অ্যা ডক্টর ইন দ্য হাউজ: দি মেমোয়েরস অব তুন ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ’। বইটি পড়ার পর একাধিকবার এ বিষয়ে লিখি। আমার লেখা পড়ার পর, উৎসাহিত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরে অবস্থিত বিখ্যাত সুফিবাদী ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ‘বায়তুশ শরফ’ প্রকাশনী থেকে ওই জীবনীগ্রন্থের চুম্বক অংশ অনুবাদ করে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। চুম্বক অংশটিও তিন শ’ পৃষ্ঠার বেশি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হলো, ডাক্তার মাহাথিরের আত্মজীবনী এবং সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ-এর আত্মজীবনী এই বই দু’টি, বাংলাদেশ নিয়ে যারা চিন্তা করেন তাদের জন্য এখনো খুব উপকারী। মাহাথিরের বইয়ের দশম অধ্যায় হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি এবং ওই সময়ের গল্প। ১৯৪৭ সালে মাহাথির মোহাম্মদ ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজটি সিঙ্গাপুর শহরে। নাম ছিল : ‘কিং অ্যাডওয়ার্ড-৭ কলেজ অব মেডিসিন’।
পুস্তকের দশম অধ্যায়ে মাহাথির নিজে যা বলেছেন, সেখান থেকে দু-একটি কথা এখানে আমার ভাষায়, ভাবার্থ হিসেবে তুলে ধরছি। পুনরায় নিবেদন করছি, কথাগুলো মাহাথিরের, ইবরাহিমের নয়। এখানে ‘আমি’ শব্দ মানে মাহাথির, ইবরাহিম নয়। ‘নেতা হতে চেয়েছিলাম যেন আমি স্বপ্নের কাজগুলো করিয়ে নিতে পারি এবং আমার চিন্তাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি। আমার স্কুলজীবনের সহপাঠীরা আমাকে নেতা হিসেবে মেনে নিত, কিন্তু যারা একটু বয়স্ক তারা আমাকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করতেন না। অতএব, বয়স্করা যেন অন্তত আমার কথা ও প্রস্তাবগুলো শোনেন, তার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হলো আমার ক্রেডেনশিয়ালস বা আমার জীবনের অর্জন বৃদ্ধি করা। জীবনে অর্জন বা পরিচিতি বৃদ্ধি করতে হলে অন্যতম কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডিগ্রি নেয়া। কারণ আমাদের এই সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রিধারী ব্যক্তি গোটা দেশেই অতি নগণ্য সংখ্যক ছিলেন।
গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করা শুরু করলাম। আমি চেয়েছিলাম একজন আইনজীবী হতে কারণ, বিতর্ক পছন্দ করতাম এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রশংসা পেতাম। কিন্তু ওই সময় আইনজীবী হওয়ার জন্য যে ভালো ডিগ্রি প্রয়োজন, সেটি ইংল্যান্ড ছাড়া কোথাও পাওয়া যেত না। আমার পরিবারে আমাকে ইংল্যান্ডে পড়ানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। তাই আমি উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে স্কলারশিপ বা বৃত্তির জন্য আবেদন করলাম। আমার অনেক বন্ধুই বৃত্তি পেয়েছিল, কিন্তু আমি পেলাম না। আমাদের সরকার, আমাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাবিদ্যা গ্রহণের জন্য স্কলারশিপ দিলো। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আগ্রহী কোনো দিনই ছিলাম না, কিন্তু নিয়তি আমাকে চিকিৎসাবিদ্যায় জড়িত করল। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতাম, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। এ ক্ষেত্রেও ভাগ্য আমার উপকার করল। কারণ, পরবর্তীকালে যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলাম তখন আবিষ্কার করেছিলাম যে, একটি দেশের প্রশাসন পরিচালনা এবং একজন রোগীর চিকিৎসা করার মধ্যে প্রচুর মিল আছে। একটি দেশ চালানো মানে শুধু পার্লামেন্টে তর্ক করা নয় বা শুধু আইন বানানো নয়।
একটি দেশ চালানো মানেÑ ওই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসুস্থতাগুলো সারিয়ে তোলার জন্য চিকিৎসা করা। অন্তত নীতিগতভাবে, একটি দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যাধিগুলো চিকিৎসা করার যে প্রক্রিয়া বা প্রসিডিউর, সেগুলো কোনো একজন মানুষের দেহের অসুস্থতার চিকিৎসা করার জন্য প্রযোজ্য প্রক্রিয়া বা প্রসিডিউরের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনো আমরা ব্রিটিশদের অধীন ছিলাম। ব্রিটিশরা মনে করত, ডাক্তাররা নিরীহ ও গোবেচারা; তারা শাসনকারী ব্রিটিশদের জন্য কোনো ঝামেলা করে না, কারণ তারা করতে জানে না। অপরপক্ষে, ব্রিটিশরা মনে করত, আইনজীবীরা একজন মানুষের শরীরে ঘাড় ব্যথার মতো, তারা শাসনকারী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের জন্য সব সময়ই ঝামেলার একটি কারণ হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটেই ভাগ্য আমাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত করে দিলো আমার ২২ বছর বয়সে। মেডিক্যাল কলেজে আমার সব ফি বা বেতন মওকুফ ছিল। সরকার থেকে পেতাম ১৫ ডলার এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেতাম ১০ ডলার। এই মোট ২৫ মালয়ি ডলার দিয়ে আমার খরচ মিটাতাম। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ‘স্ট্রেইটস টাইমস’ এবং ‘সানডে টাইমস’ নামক দু’টি পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলাম এবং এর মাধ্যমে ৪০-৫০ ডলার অতিরিক্ত উপার্জন করতাম। এই দিয়ে আমি মোটামুটি ভালোমতোই জীবন যাপন করছিলাম।’ সম্মানিত পাঠক, মাহাথির মোহাম্মদের নিজের জবানীতে আত্মজীবনীর অংশ বিশেষের ভাবার্থ এখানে শেষ।
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদের স্বপ্ন ছিল, তিনি নিজের দেশ ও সমাজের নেতৃত্ব দেবেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের নেতা ও মানবাধিকার সংগ্রামী মার্টিন লুথার কিং একটি বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন, যে ভাষণের শিরোনাম ছিল- ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’, অর্থাৎ আমার একটি স্বপ্ন আছে। আজকের কলাম এই বলে শেষ করতে চাই, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই যেন স্বপ্ন থাকে। সেনাবাহিনীর অফিসার ইবরাহিমের স্বপ্ন ছিল। রাজনীতিবিদ ইবরাহিমের স্বপ্ন আছে। রাজনীতিবিদ ইবরাহিমের স্বপ্ন দেশকে নিয়ে, জাতিকে নিয়ে। তবে সে স্বপ্ন পূরণের জন্য সহকর্মী, সহযাত্রী, সহযোদ্ধা প্রয়োজন; সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সাংগঠনিক চেষ্টা প্রয়োজন, আন্দোলন প্রয়োজন। এখন যে আন্দোলনে ব্যস্ত সেটি শর্ট টার্ম বা নিকটমাত্রার। এই শর্ট টার্ম আন্দোলন সফল হলে, দীর্ঘমেয়াদি বা দূরমাত্রার দেশ গড়ার স্বপ্ন, সমাজ বদলের স্বপ্ন, পরিবর্তনের স্বপ্ন পূরণ করা সহজ হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
llp ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৮:৫২ এএম says : 0
Whatever you learn from the leadership of Singapore and Malaysia will not help you in Bangladesh in any way. You just wasted your time in reading those books. This is because Singapore and Malaysia is surrounded by China who is a benevolent country. China helps other countries to develop and does help to resolve crisis wherever it can. China is a positive force. Bangladesh on the other hand is surrounded by India who never helps to solve anyone's crisis, rather creates crisis wherever it can. Since India's politics is culture driven (which is as bad as religious politics) and since we don't have natural border, and since India is a poor country, India cannot tolerate a successful Bangladesh and Pakistan. You should rather study how Ukraine is trying to be independent and successful with EU by resisting the immense pressure from Russia.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন