শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিপথে ঘুরছে কিশোর

চট্টগ্রামে খুন ধর্ষণ ডাকাতি ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোরেরা। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা- কোথায় নেই তারা। মাদকের কারবার, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্রবাজি, দাঙ্গা, হাঙ্গামায়ও আছে তারা। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, বখাটে থেকে নামকরা স্কুলের ছাত্র- অপকর্মে সবাই এককাতারে। বই, খাতা, কলমের বদলে তাদের হাতে উঠে আসছে অস্ত্র, গুলি, ছুরি, মাদক।

কৈশোরের উন্মাদনা আর দুরন্তপনা এখন দুর্বৃত্তপনায় রূপ নিয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার, মাস্তান। নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার করতে তারা তৈরি করেছে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং। পাড়ায়, মহল্লায় হরেক নামে কিশোর গ্যাং এখন আতঙ্কের নাম।
বাসা-বাড়িতে মা-বাবার অবহেলা-অসচেনতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ না থাকার সুবাদে কিশোরেরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কিছু কোচিং সেন্টারও তাদের বিপথগামী করছে। কিশোর বয়সে ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সব মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। নানা উদ্যোগ নিয়েও কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না পুলিশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় কিশোরেরা পথ হারাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও এজন্য দায়ী। নেই খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উপযুক্ত পরিবেশ, জ্ঞানচর্চার সুযোগও সীমিত।

পক্ষান্তরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব হরর সিনেমার কাহিনী তাদের অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। এর ফলে অনৈতিকতার হাতছানিতে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে আগামী প্রজন্ম। বখে যাওয়া কিশোরেরা নিজেদের পরিবার এবং সেইসাথে সমাজের জন্য হয়ে উঠছে আতঙ্কের কারণ। কারাগার থেকে বের হয়ে অনেক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। প্রেমে বিরহ, হতাশাসহ নানা কারণে অনেকে আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে অপরাধের প্রায় ঘটনায় কিশোরদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলছে। কিশোর অপরাধের সর্বশেষ বলি স্কুলছাত্র জাকির হোসেন। সম্প্রতি এমইএস কলেজের সামনে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বন্দর থানা এলাকায় প্রতিবেশী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখার ঘটনায় গ্রেফতার হয় এক কিশোর। ভাড়াটে খুনি হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে কিশোরেরা। গত আট মাসে নগরীতে কিশোরদের হাতে খুন হয়েছেন আরও ছয়জন। দেড় বছরে এ ধরনের ঘটনায় কমপক্ষে ২৫টি মামলা হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে মহানগর এবং জেলার সাতটি আদালতে কিশোর অপরাধের এক হাজার ২০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আগে এসব মামলার বিচার হতো দুটি শিশু আদালতে। এপ্রিলে মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে প্রেরণ করা হয়। এসব মামলায় আসামি কয়েক হাজার শিশু-কিশোর। তাদের মধ্যে বন্দি কয়েকশ আসামি।

চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের দাপট চলছে অনেক আগ থেকেই। তবে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনানকে প্রকাশ্যে হত্যার পর কিশোর অপরাধীদের নিয়ে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। এ সময় পাড়ায়-পাড়ায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকাও করা হয়েছিল। পুলিশের তথ্যমতে, নগরীতে অন্তত ৩শ গ্যাং চিহ্নিত হয়। কিশোরদের আড্ডায় নিয়মিত হানা দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু এরপর পুলিশের এ কার্যক্রম কার্যত থমকে গেছে। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত, সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে কিশোরেরা। কিশোরদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, মাস্তানেরা। নগরীর ষোলশহরে এক পুলিশ সদস্যকে প্রকাশ্যে গুলির ঘটনায় নয়জনকে গ্রেফতার করে উদ্ধার করা হয় বড়ভাইয়ের দেয়া ওই অস্ত্র। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র খুনের ঘটনায়ও অস্ত্র দেয় এক বড়ভাই। কিশোর গ্রæপের বিরোধ মেটাতে গিয়ে বড়ভাই খুনের ঘটনাও ঘটছে। কয়েক মাস আগে নগরীর বাকলিয়ায় খুন হন যুবলীগ নেতা সাইফুল। পরে তার খুনি পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারায়। নগরীতে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিনিয়তই কিশোরেরা গ্রেফতার হচ্ছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, কিশোর অপরাধ ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নিয়মিত কিশোরদের আস্তানায় হানা দিচ্ছে। কিশোর গ্যাং এবং নেপথ্যে যেসব বড়ভাই তাদের তালিকা হচ্ছে। তালিকা ধরে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। কিশোর অপরাধ একটি সামাজিক সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা দমন পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

কিশোর অপরাধ দমনে অভিজ্ঞতা থেকে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন বলেন, কিছু অভিভাবকের অসচেতনতার কারণে শিশু-কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আবার স্কুলগুলোতেও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ সুযোগে কিশোরেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে, কোচিং সেন্টারের নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে তারা নানা অপকর্ম করছে। কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ছিনতাই, খুন, ডাকাতিতে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলের ছাত্র এবং বখাটেদেরও জড়িত থাকার প্রমাণ মিলছে।

বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় শিক্ষা ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোরো বিপথগামী হচ্ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক ভ‚মিকাও রয়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানো রাজনৈতিক দলের কতিপয় অসৎ নেতাও কম দায়ী নয়। গ্রেফতারের পর পুলিশ ঝামেলা এড়াতে কিশোরদের বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণে সংশোধনাগারের বদলে তাদের ঠাঁই হচ্ছে কারাগারে। অভিভাবকেরা সচেতন না হলে এ ধরনের অপরাধ দমন করা যাবে না বলেও মত দেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিআইজি প্রিজন বলেন, উচ্চ আদালতে নির্দেশনা আছে ১৮ বছরের নিচে কোন আসামি কারাগারে থাকতে পারবে না। বাস্তবে এর উল্টো চিত্রও দেখা যায়। বড় কারাগারগুলোতে ৪০০-৫০০ কিশোর বন্দি থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের বয়স পুলিশ ১৮ থেকে ২১ বছর লিখে দিয়েছে। এসব কিশোরেরা সংশোধনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, দাগী অপরাধীদের সাথে থেকে আরও বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। গ্রেফতার কিশোরদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংশোধনের সুযোগ না থাকলে অপরাধ প্রবণতা কমানো যাবে না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর লাইলুন নাহার বলেন, কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে। আর এ সময়ে তাদের মধ্যে প্রচন্ড কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। তারা নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজতে শুরু করে। উন্মাদনা থেকে কোনকিছু করে সবার নজরে আসার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠে। তবে সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনার অভাবে তারা নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিশোরেরা নিজেদের মধ্যে গ্যাং তৈরি করছে। মূলত হিরোইজম থেকে কৈশোরের দুরন্তপনা, দুর্বৃত্তপনায় রূপ নিচ্ছে। বিপথগামী হওয়া থেকে কিশোরদের ফেরাতে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা এবং যথাযথ কাউন্সেলিং জরুরি বলে মত দেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন