শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইয়েমেন যুদ্ধ, হুথি ড্রোন হামলা এবং অস্ত্র বাণিজ্যের ফাঁদ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

সাড়ে চার বছর আগে সউদি আরবের নেতৃতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ সহায়তায় গঠিত সামরিক জোট ইয়েমেনে নজিরবহিীন বিমান হামলার শুরুতে সউদি সামরিক মুখপাত্র বলেছিলেন, এই অভিযান হবে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। সম্ভবত দুই সপ্তাহের মধ্যে ইয়েমেনের হুথিদের পরাস্ত করে সেখানে সউদি আরবের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তারা ভেবেছিল। ইয়েমেনে সউদি আরবের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এডেন বন্দর ও হার্বারের মধ্য দিয়ে সউদি তেল রফতানির বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ছিল সউদি জোটের ইয়েমেন হামলার মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে হরমুজ প্রনালীতে ইরানের নিয়ন্ত্রণ পাশ কাটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সউদি তেল সরবরাহের বিকল্প রুট নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনে সউদি আরব ও আমিরাত গত কয়েক দশকে ইয়েনে বেশ কয়েক বার সংঘাতে জড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সউদি আরব ও আমিরাতের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা এবং সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। সউদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটেও আরব আমিরাত অন্যতম শরিক দেশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একদিকে এডেন বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে সউদি আরব ও আমিরাতের মধ্যে এক প্রকার প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। গত মাসের প্রথমদিকে এডেন বন্দরের কাছকাছি এলাকায় সউদি সমর্থিত যোদ্ধাদের উপর আমিরাত বাহিনীর বিমান হামলার খবর পাওয়া যায়। এরই মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সামরিক জোট ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডি-ফ্যাক্টো আমির মোহাম্মদ বিন জায়েদের আগ্রাসি পররাষ্ট্রনীতি তার দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষের জন্ম দেয়ার পাশাপাশি ইয়েমেন যুদ্ধে সউদিআরকের সাথে স্বার্থদ্বন্দের কারণেই হয়তো তারা সউদি জোট ত্যাগ করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা। সউদি জোটের হামলায় ইয়েমেনের প্রধান প্রধান জনপদগুলোর অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি দেশে নিরব দুর্ভীক্ষ ও মহামারি দেখা দিলেও ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের মোটেও কাবু করা যায় নি। সামরিক অভিযানের চারবছর পেরিয়ে এসে তাদেরকে সউদি লক্ষ্যবস্তুতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্ত প্রত্যাঘাত হানতে দেখা যাচ্ছে। গত মাসের শেষদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়েমেনে নিজেদের পরাজয় ব্যর্থতা স্বীকার করে হুথিদের সাথে শান্তি আলোচনার পথ খুঁজছে সউদি জোট। এরই মধ্যে হুথিদের হাতে এ সপ্তাহে এক চরম আক্রমনের শিকার হল সউদি আরব। হুথিদের ড্রোনগুলো মাঝে মধ্যেই ইয়েমেন সীমান্তবর্তি সউদি শহরগুলোতে আঘাত হানছিল। গত শনিবার বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ড্রোন থেকে ফেলা বোমায় সউদি আরবের প্রধান তেলক্ষেত্রে হামলা চালালে সউদি আরামকোর তেল স্থাপনা অভাবনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই হামলায় সউদি আরবের প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমান ৫ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি বলে প্রকাশিত একটি সুত্রে জানা গেছে এ হামলার পর সউদি তেল উত্তোলন আপাতত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। গত শনিবারের হামলার পর একজন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক লিখেছেন, নিরাপত্তার নামে সউদি আরবের ২৯৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট কোনো কাজে আসেনি। ‘র‌্যাগ ট্যাগ’ হুথি মিলিশিয়ারা আরামকো তেলখনিতে হামলায় যে ড্রোনগুলো ব্যবহার করেছিল তার নির্মান খরচ নাকি বড় জোর ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। অথচ ২০১৯ সালে সউদি আরবের সামগ্রিক সামরিক বাজেট প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলার! গত বছর শুধমাত্র অস্ত্র ক্রয় খাতে তাদের বাজেট ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি। সউদি আরামকোর তেল ক্ষেত্রে হুথি ড্রোন হামলার পর পেট্টোলিয়ামের বিশ্ববাজার অস্থির হে য় পড়েছে। ইতিমধ্যে দাম বেড়েছে ১০ ভাগ।

সমর শক্তি, সামরিক প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্বল ও অনগ্রসর জাতি আফগানিস্তানের তালেবানরা তিরিশ বছর আগে পরাশক্তি সোভিয়েত সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে আফগানিস্তানকে দখলদার মুক্ত করেছিল। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের সহায়তা করেছিল। আফগানিস্তানে হেরে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়ার পেছনে বড় ভ’মিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। আজ তিন দশক পেরিয়ে এসে আফগানিস্তান এখন মার্কিন দখলদারদের কবলে। দেড় যুগ ধরে আফগান তালেবানদের সাথে লড়াই করার পর মার্কিন দখলদার বাহিনী এখন চরম পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার নিরাপদ এক্সিট প্লান ঠিক করতে তালেবানদের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার পথ খুঁজছে মার্কিন সেনাবাহিনী। অবশেষে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনায় যথেষ্ট অগ্রগতির কথা শোনা যাচ্ছিল। তবে আনপ্রিডিক্টেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই রহস্যজনকভাবে তালেবানদের সাথে সমঝোতার আলোচনা বন্ধের ঘোষণা দেন। নাইন-ইলেভেন বা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক ও পেন্টাগনে বিমান হামলায় শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ার তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে ধুলায় পরিনত হয়ে যায়। এ ঘটনার জন্য তাৎক্ষনিকভাবে মুসলিম জঙ্গিবাদি গ্রæপ আল কায়েদাকে দায়ী করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবিøউ বুশ। ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা এবং আফগান তালেবানদের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে মার্কিন বাহিনী ন্যাটোসহ বিশাল সামরিক শক্তি নিয়ে আফগানিস্তানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ইরাকেও হামলা চালিয়ে ইরাক দখল করে নেয়। ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ব্যাপক গণবিদ্ধংসী অস্ত্রের মুজদ গড়ে তুলেছেন, এমন মিথ্যা অভিযোগে ইরাকে হামলা চালিয়ে বাঙ্কারে আত্মগোপনে থাকা সাদ্দাম হোসেনকে ধরে সামরিক আদালতে বিচারের নামে কোনো এক ঈদের দিনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। ইরাকের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদগুলোকে ধ্বংস্তুপে পরিনত করার পর আস্তে আস্তে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইরাক হামলার আগে কথিত ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশনের গোয়েন্দা তথ্য ছিল মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। মূলত: জায়নবাদি ইসরায়েলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মার্কিন গোয়েন্দা ও মিডিয়াগুলো এই অপপ্রচার চালিয়েছিল। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ এবং লাখ লাখ ইরাকি এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে ইরাকে মার্কিনীদের অর্জন প্রায় শুন্য। এখন ইরাকের উপর ইরানিদের প্রভাব ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন জনগণ জায়নবাদ ও নিউকন প্রভাবিত মিডিয়ার চোখেই আন্তর্জাতিক সব কিছু দেখা এবং বিচার করতে অভ্যস্থ। ইরাক যুদ্ধের ৫ বছরের মাথায় পরিচালিত মার্কিন জনমত জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৫৫ ভাগ মার্কিনী মনে করেছেন ইরাক যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় ভুল ছিল। আর আফগানিস্তান যুদ্ধের ১৮ বছর পেরিয়ে এসে মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকরা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এগার সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে হার্বাড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর স্টিফেন এম ওয়াল্ট লিখেছেন, ‘উই লস্ট ওয়ার ইন আফগানিস্তান, গেট ওভার ইট’। এর কয়েকদিন আগেই ক্যাম্প ডেভিডে চলমান আফগান-মার্কিন শান্তি আলোচনা স্থগিত করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে তিনি একাধিকবার বলেছেন, তিনি হলে আফগানিস্তানে বিজয়লাভ মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার ছিল। তিনি প্রকারান্তরে ব্যাপক গণহত্যার মধ্য দিয়ে বিজয়ের কথা বলেছেন। হাজার হাজার কিলোমিটার মহাদেশ মহাসমুদ্র পেরিয়ে এসে গণহত্যার মধ্য দিয়ে কিসের বিজয় লাভের ইঙ্গিত দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট! গণকবর ও ধ্বংসস্তুপের উপর তারা কোন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

মহাযুদ্ধের কথা বাদ দিলে শুধুমাত্র সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের উপর কোনো পরাশক্তির রাজনৈতিক বা কৌশলগত বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। আফগানিস্তান ও ইরাকে তা প্রমানীত হয়েছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা মাত্র তিন দশকের মধ্যে বিশ্বের দুই মহাপরাশক্তি সোভিয়েত বাহিনীকে পরাস্ত করার পর এবার মার্কিনীদের ঠোলা বানিয়ে ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। তার চেয়েও বড় চমক হচ্ছে, ইঙ্গ-মার্কিন-জায়নবাদি ইসরাইলের মদদপুষ্ট সউদি নেতৃত্বাধীন হাজার হাজার কোটি ডলারের সমর সজ্জিত বাহিনী ইয়েমেনের ভুখা-নাঙ্গা হুথি বিদ্রোহীদের হাতে মার খেয়ে এখন পালানোর পথ খুঁজছে। দশকের পর দশক ধরে তেল বিক্রির টাকায় শত শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোনো কাজে আসছে না। অথচ এই যুদ্ধব্যয় মেটাতেম তাদের অর্থনীতি এখন ঘাটতি বাজেটে পরিনত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কৃত্রিম সংকট, সংঘাত, গৃহযুদ্ধ ও যুদ্ধের হুমকি জিইয়ে রেখে অস্ত্র বিক্রির নামে তেল বিক্রির হাজার হাজার কোটি ডলার লুটে নেয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। একেকজন মার্কিন নাগরিকের ঘাড়ে ঋণের বোঝা জিডিপির চেয়ে বহুগুণ বেশি। এখন চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করতে গিয়ে তারা কর্মসংস্থান ও অথনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধসের মুখে পড়তে বসেছে। হাজার হাজার কোটি ডলারের প্রযুক্তি, যুদ্ধাস্ত্র ও সমরসজ্জা দিয়েও যখন কোনো যুদ্ধেই বিজয় লাভ করতে পারছে না, এমনকি ইরানি প্রক্সি যোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। যে তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে এমন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে, সে তেলসম্পদও তারা রক্ষা করতে পারছে না। গত দেড় দশকে ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পরাজয় ও ভরাডুবি নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন যুদ্ধবাজ পাপেট বা লাঠিয়াল ইসরাইলের কথিত অপরাজেয় বাহিনী হেজবুল্লাহ ও হামাসের হাতে একাধিকবার মার খেয়ে খামোশ হতে বাধ্য হয়েছে। মাত্র একদিনের ড্রোন হামলায় সউদি আরবের অর্ধেক তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এসব যুদ্ধ সম্পর্কে নেপথ্য কুশীলবদের নতুন করে ভাবতে করবে। তবে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। অব্যাহত অপপ্রচার-প্রোপাগান্ডা, সামরিক-বাণিজ্যিক- অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যেও ইমানি শক্তি ও দেশপ্রেমে বলিয়ান মুসলমান মুজাহিদদের কাছে উদ্ধত ও যুদ্ধবাজ সামরিক পরাশক্তির মার খাওয়ার ধারাবাহিক পরিনতি বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমাদের চলমান সামরিক-অর্থনৈতিক কলাকৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। জবরদস্তি ও জবরদখল করে কোনো জাতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা বৃহৎ শক্তির উপর সব সময়ই বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়। সাত দশকেও ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরীদের এতটুক বশ করতে পারেনি ইসরাইলের জায়নবাদি ও ভারতের হিন্দুত্ববাদি শাসকরা। দশকের পর দশক ধরে রক্ত ঝরানোর পর এসব নির্যাতিত জাতি এখন সব পরাশক্তির দেয়াল ভেঙ্গে অকুতোভয়ে জেগে ঊঠতে শুরু করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবাননের ভ’-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে কাশ্মীর পরিস্থিতির খানিকটা পার্থক্য থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতীয় বাহিনীর সাথে ইসরাইলীদের গোপণ সামরিক সমঝোতার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের সামরিক সরঞ্জাম ক্রেতাদের মধ্যে ভারত অন্যতম অবস্থানে রয়েছে বলে জানা যায়। একের পর এক পরাজয় ও ব্যর্থতার কারণে বর্ণবাদ, আধিপত্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের টেবলেট গিলিয়ে যুদ্ধবাদি হিস্টিরিয়াগ্রস্তদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার দিনও ফুরিয়ে আসছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ২০১৮ সালে ইয়েমেনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ও হুমকির মুখে থাকা জাতি হিসেবে বর্ণনা করেছিল। ইয়েমেনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সউদি জোটের হামলার কারণে ১ কোটি ৪০ লাখ ইয়েমেনি নাগরিক দুর্ভীক্ষ ও মহামারিতে জীবন সংশয়ের মধ্যে রয়েছে বলে জাসিংঘ মানবাধিকার কমিশন গত বছর রিপোর্ট দিয়েছিল। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল ইয়েমেন আজ ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌছেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইয়েমেনের রয়েছে চার হাজার বছরের ধারবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস। রাসূল হজরত মোহাম্মদ(স.)এর জীবদ্দশায় ৬৩০ খৃষ্টাব্দে সাহাবি আলী রা: কে ইয়েমেনে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ইসনানা উপজাতীয় ও সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত ইয়েমেনিদের সব বিভেদ ঘুচিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইয়েমেনের রাজধানীর সানা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন ধারাবাহিক ঐতিহ্যমন্ডিত শহর। প্রায় চার হাজার বছর ধরে এ শহরটি প্রানবন্ত সুসভ্য ও সমৃদ্ধ মানব বসতি বা নগরী হিসেবে টিকে আছে। পুরনো সানা ইউনেস্কোর ওর্য়াল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৭২ সালে। সপ্তম শতাব্দীতে (সম্ভবত রাসূল হজরত মোহাম্মদ(স.) জীবদ্দশায়)নির্মিত গ্রেট সানা মসজিদে কোরআনের প্রাথমিক পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল। নবীজি নিজেই এই মসজিদ নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তদারকি করেছিলেন বলে জানা যায়। সউদি জোটের হামলায় অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থপানা, স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা বসতবাড়িসহ বহু প্রাচীন পুরাকৃত্বি ধ্বংস হয়ে গেছে। লাখ লাখ ইয়েমেনি শিশু, ও নারী খাদ্যভাবে কঙ্কালসার দেহে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সউদি আরবের প্রধান তেল স্থাপনায় হুথি ড্রোন হামলার পর ইয়েমেন যুদ্ধ কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা অনুমান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এই হামলা নিয়ে পশ্চিমারা নতুন ওয়ার প্লান বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়ে পড়েছে। হুথিরা হামলার দায় স্বীকার করার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে হামলার দায় ইরানের উপর চাপানোর উপর চাপানোর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। ইতিপূর্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের লাঠিয়াল বশংবদ রাজ শক্তিগুলোর মদদে আট বছরব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধ আমরা দেখেছি। সমগ্র আরব শক্তি ও পশ্চিমারা সম্মিলিতভাবে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে সব রকম মহায়তা দিয়েও ইরানকে পরাজিত করা যায় নি। যুদ্ধের ব্যয় মিটাতে দেউলিয়া প্রায় ইরাকি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং দেনা পরিশোধ করতে সাদ্দাম হোসেনকে কুয়েত দখলের প্ররোচনা দিয়েছিল মার্কিনীরা। কুয়েত দখলের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইরাকের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী। এরপর প্রলম্বিত অবরোধ আরোপের মধ্য দিয়ে ইরাকে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরপরও যখন সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাবনাময় শক্তি হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তখনই ইরাকে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নিয়েছিল। এসবই হয়েছিল জায়নবাদি ইসরাইলের স্বার্থে ও মদদে। সে ইরাক আবারো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনায় পশ্চিমারা পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ইরানের পরমানু প্রকল্প প্রশ্নে মার্কিনীরা শান্তিচুক্তি করেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে চুক্তি থেকে সরে গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে আবারো ইরানের সাথে আলোচনার পথ খুঁজছে। আফগানিস্তানের তালেবানদের সাথে আলোচনা ভেস্তে দিয়ে ট্রাম্প তার অপরিনামদর্শিতা ও অস্থির চিত্তের প্রমান দিয়েছেন। তবে যুদ্ধবাজ জন বোল্টনকে বরখাস্ত করে ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মধ্য দিয়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানির সাথে ট্রাম্পের একটি বৈঠক যখন সম্ভাব্য হয়ে উঠেছিল, ঠিক তখন হুথি ড্রোন হামলায় সউদি তেলক্ষেত্রে অভাবনীয় ক্ষতিসাধিত হল। হাজার হাজার কোটি ডলারে কেনা ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সউদি অর্থনীতির মেরুদন্ড রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে তার দায় কার? মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্র বাণিজ্যের ফাঁদ এড়িয়ে সব পক্ষ সংযত হয়ে এবার শান্তি ও সমঝোতার পথ খুঁজবে, এটাই শান্তিকামী বিশ্বের প্রত্যাশা।

bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
তুমন ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৭ এএম says : 0
ট্রাম্প একজন জোকার, তার কথা বিশ্বাস করা যায় না।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন