শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আমলে সালেহ সমাচার

এ. কে . এম ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অনুরূপভাবে পবিত্র কুরআনে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনসহ প্রায় ৪৫টি স্থানে এই নির্দেশ রয়েছে- যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে...। এ সকল নির্দেশাবলী দ্বারা সার্বিকভাবে একথা প্রতিপন্ন হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান এবং আমল পরস্পর সম্পূরক ও অপরিহার্য্য মিলিত রূপ। এ দুটোর একটিকে অপরটি হতে কোনক্রমেই পৃথক করা যায় না। পরকালে নাজাত, নিষ্কৃতি, উন্নতি ও কামিয়াবীর মূল মানদন্ড এ দু’টির উপর সমভাবে নির্ভরশীল। সামান্যতম পার্থক্য যা লক্ষ্য করা যায়, তাহলো মর্যাদার ব্যাপার। মর্যাদার ক্ষেত্রে ঈমানকে আমলের উপর স্থান দেয়া হয়েছে মাত্র।

যে সকল বিশ্বাসী বান্দাহদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াবী হুকুমত ও সালতানাতের ওয়াদা ও অঙ্গীকার করেছেন, তারাও ঐ শ্রেণীভুক্ত যারা ঈমানের সাথে নেক আমলেরও পাবন্দ। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আল্লাহপাক ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে যমীনের বুকে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।” (সূরা নূর : রুকু-৭) আখেরাতের মাগফেরাত ও শুভ জীবিকার অঙ্গীকারও তাদের স্বপক্ষেই করা হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ পাক তাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে, তাদের প্রতি ওয়াদা করেছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মাগফেরাত এবং বৃহত্তর বিনিময়। ” (সূরা ফাতহ : রুকু-৪)

কোন কোন আয়াতে ঈমানের পরিবর্তে ইসলাম অর্থাৎ আনুগতাকে এবং আমলে সালেহের স্থলে ইহসান অর্থাৎ পূণ্যকর্মকে স্থানদান করা হয়েছে। উদাহরণত: একটি আয়াতে ইহুদী ও নাসারাদের এই দাবী যে, ‘জান্নাতে শুধু কেবল তারাই প্রবেশ করবে” বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “হাঁ, যে কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয়, তার ফল তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দু:খিতও হবে না।” (সূরা বাকারা : রুকু-১৬)

সুতরাং সকল আয়াতসমূহের দ্বারা এই নিয়মতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, মুক্তির উপায় শুধু কেবল ঈমানের উপরই নির্ভরশীল নয়, বরং ঈমানের সাথে আমলে সালেহও থাকতে হবে। আর এটা অত্যন্ত স্পষ্ট কথা যে, ইসলামপূর্ব মাজহাবগুলোতে কম এবং বেশীর মাত্রা ছিল প্রকট। পৌলের পত্রাবলী অনুসারে জানা যায় যে, খৃস্টানদের মতে মুক্তি লাভের উপায় শুধুমাত্র ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে বলা হয়, কেবলমাত্র পুণ্যকর্মের দ্বারাই নির্বান লাভ করা যায়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ধ্যান-ধারণাকে মুক্তিলাভের পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পয়গাম্বর (সা:) এর পয়গাম মানুষের নাজাতের উপায় হিসেবে আত্মিক ঈমান এবং দৈহিক নেক আমল উভয়ের সম্মিলিতরূপকে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

অর্থাৎ প্রথম জিনিস হচ্ছে এই যে, আমাদের নিয়ম-নীতিসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার একীন ও বিশ^াস হবে। তাকে ঈমান বলা হয়। আর দ্বিতীয় জিনিসি হচ্ছে সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক আমাদের আমল ও কাজ সহীহ ও বিশুদ্ধ হবে। এটাই আমলে সালেহ। সকল প্রকার কামিয়াবীর ভিত্তি ও এ দু’টি জিনিসের উপর নির্ভরশীল। কোন রুগ্ন ব্যক্তি শুধু কেবল ডাক্তারী নিয়ম-নীতিকে সহীহ বলে মানলে রোগ-বালাই থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে না। যতক্ষণ না সে সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক আমল না করে। অনুরূপভাবে শুধু ঈমানের নিয়ম-নীতিকে স্বীকার করে নেয়া মানবিক মুক্তি ও কামিয়াবীর জন্য যথেষ্ট হতে পারে না। যতক্ষণ না সেই নিয়ম-নীতি মোতাবেক পরিপূর্ণ আমল করা হয়। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই ঐ সকল মু’মিন সফলকাম হয়েছে, যারা স্বীয় নামাজে একান্তই প্রনত, যারা বেহুদা কাজ-কর্মের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী এবং যারা যাকাত আদায়ে তৎপর এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে... এবং যারা স্বীয় আমানত এবং অঙ্গীকারের প্রতি সযতœ সচেতনতা অবলম্বন করে এবং যারা স্বীয় নামাজের হেফাজত করে, আর এই সকল লোকই (জান্নাতের ) ওয়ারিস।” (সূরা মু’মিনুন : রুকু-১)

এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ পাক প্রতিটি বস্তুুকে আমাদের উপাদান ভিত্তিক কার্যকারণের অধিনস্থ করে দিয়েছেন। এখানকার উন্নতি, অগ্রগতি কামিয়াবী, মুক্তি ও সৌভাগ্য শুধু কেবল আত্মিক বিশ^াস এবং ঈমানের দ্বারাই হাসিল করা যায় না, যতক্ষণ না এই আকীদাহ ও বিশ^াস মোতাবেক মোতাবেক আমল করা না হয়।

শুধু এই বিশ^াস যে, রুটি আমাদের ক্ষুধার সার্বিক এলাজ, তা আমাদের ক্ষুধা নিবৃত করতে পারে না। কিন্তু এরজন্য আমাদের চেষ্টা পরিশ্রম ও সাধ্য-সাধনা করে রুটি অর্জন করতে হবে এবং এই রুটি চিবিয়ে ঢোক গিলে উদরস্থ করতে হবে। আর এই বিশ^াস যে আমাদের পা আমাদেরকে একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে পারে এই বিশ^াস আমাদেরকে একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যেতে পারে না, যতক্ষণ না আমরা এই বিশ^াসের সাথে দু’পায়ের হরকত বা পদচারণায় উদ্বুদ্ধ হই। একই অবস্থা আমাদের জাগতিক অন্যান্য কাজ-কর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য একারণেই এই পৃথিবীতে আমল ছাড়া শুধু ঈমানী কামিয়াবী অর্জনের ক্ষেত্রে অচল ও বেকার। তবে এতটুকু ঠিক যে, যারা এই নিয়ম-নীতিসমূহকে বিশুদ্ধ বলে বিশ^াস করে, তারা ঐ সকল লোক হতে উত্তম যারা এগুলোকে মোটেই মানে না। কেননা এদের মাঝে প্রথম শ্রেণীটির কখনো না কখনো সঠিক পথে আগমন করা এবং নেক আমল পালন করার নিশ্চয়তা ও আশা আছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটির ক্ষেত্রে যেহেতু প্রথম ধাপই অনুপস্থিত এজন্য আখেরাতেও তারা অস্বীকারকারীদের মোকাবেলায় হয়ত আল্লাহ পাকের ফজল ও করম লাভের অধিক উপযোগী হবে। কেননা তারা কমসে-কম সেই ফরমানকে সঠিক বলে ধারণা করেছিল।

নেক আমলের প্রকার ভেদ :

আমলে সালেহ বা নেক আমলের পরিধি খুবই বিস্তৃত। এর মাঝে মানবিক উত্তম কর্মকাÐের যাবতীয় শাখা-প্রশাখা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুুষ্টি ও খোসনুদী অর্জন করা। এতদসত্তে¡ও নেক আমলের সামগ্রিক তিনটি শ্রেণী রয়েছে। যথা (১) ইবাদত, (২) আখলাক এবং (৩) মোয়ামালাত।

ইসলামী পরিভাষা অনুসারে ‘ইবাদত’ শব্দটি খুবই বিস্তৃত। এরমাঝে ঐ সকল প্রতিটি কাজই জড়িত আছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর খোশনুদী অর্জন করা। এজন্য আখলাক ও মোয়ামালাতও যদি নেক নিয়তের সাথে পালন করা হয়, তাহলে এগুলোকেও ইবাদত বলে গণ্য করা হবে।

কিন্তু ফিকাহবিদগণ তাদের পরিভাষায় এই তিনটি শ্রেণীর জন্য পৃথক পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। যার সম্যক বিবরণ এভাবে পেশ করা যায়। প্রথমত : নেক আমল দু’ভাগে বিভিক্ত। (১) যেগুলোর সম্পর্ক খাসভাবে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত, এগুলোকে ইবাদাত বলে। (২) যেগুলোর সম্পর্ক বান্দাহদের সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো আবার দু’ভাগে বিভক্ত, যথা (ক) যেগুলো মানবিক দায় দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং (খ) যেগুলো আইনগত জিম্মাদারী বলে বিবেচিত। এর প্রথমটিকে আখলাক এবং দ্বিতীয়টিকে মোয়ামালাত বলা হয়। নেক আমলের এই তিনটি শ্রেণীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বর্তমান নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়।

ইবাদত :

“হে মানবমন্ডলী। তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর।”

(সূরা বাকারাহ : রুকু-৩)

ইবাদতের অর্থে সাধারণভাবে যে সকল নির্দিষ্ট কর্মকান্ডকে বুঝানো হয়, যেগুলো মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বপূর্ণ বারাগাহে পালন করে থাকে। কিন্তুু এ হচ্ছে ইবাদতের সবচেয়ে সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত অর্থ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে যে হাকীকত প্রকাশ করেছেন এর মূল মর্যাদা এই নয় যে, অতীত মাযহাবগুলোর ইবাদতের তরীকা ভিন্ন ইসলামে ইবাদতের পৃথক কোন তরীকা নির্দিষ্ট হয়েছে। বরং ইসলামী ইবাদতে একথাই বলা হয়েছে যে, ইবাদতের হাকীকত ও উদ্দেশ্য কি? আর একই সাথে অতীতের ভ্রান্ত ইবাদতের তরীকাসমূহের বিশুদ্ধিকরণ ও পরিপূর্ণতা দান করা এবং সংক্ষিপ্ত বর্ণনাবলীর ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ এবং অস্পষ্ট শিক্ষার দিক নির্দেশনাগুলোর সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনা তুলে ধরা হয়েছে।

(চলবে)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন