শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দক্ষিণাঞ্চলে বেপরোয়া উঠতি মাস্তান আর কিশোর গ্যাং

বরিশাল ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে ছিচকে মাস্তান আর উঠতি মাস্তানরা যথেষ্ট সংগঠিত হয়ে নিজস্ব গ্রুপ বা গ্যাং তৈরি করে এক ধরনের ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে তুললেও তাদের দমনে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় সমাজে অস্বস্তি বাড়ছে। এ অঞ্চলের অনেক পাড়া মহল্লায় তারাই ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে উঠছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে নিরিবিলি জীবন যাপনে আগ্রহী সাধারণ মানুষের জীবন ব্যবস্থা।

সমাজের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত কিশোর বয়সের ছেলেরা নানাভাবে কলুষিত হয়ে বখাটে থেকে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া মহল্লার নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন পার্ক ও চিত্ত বিনোদনের স্থানগুলোতে আড্ডাবাজি, দিনরাত মোটরবাইক নিয়ে স্ট্যান্টবাজি, মেয়েদের ইভটিজিং থেকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা আর ব্যবহারসহ সমাজে অশান্তি সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডে এরা জড়িত। সর্বত্র এদের অবাধ বিচরণ। পাড়া মহল্লায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে চিকা মারা, অনেক রাত পর্যন্ত শোরগোল করাসহ তাদের মান্য করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করাও এদের কাজ।

২০১৪ এর শুরু থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকায় এ বিষয়ে মনোনিবেশ না করায় ক্রমশ এদের ডালপালা বিস্তার লাভ করেছে। গ্যাং কালচারের পেছনে রাজনৈতিক আশীর্বাদ না থাকলেও দৃশ্যমান কোন কারণ ছাড়াই তাদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক ধরনের উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। তবে বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ কয়েকটি জেলার দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে যে কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ সম্পূর্ণ সক্রিয় রয়েছে বলে দাবি করেন।

বরিশাল মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের অন্তত ৩০টি গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় একাধিক গ্যাং গড়ে ওঠায় তাদের নিজেদের মধ্যেও গোলযোগের ঘটনা ঘটছে। নগরীতে গত কয়েক বছরে জেলা স্কুল, উদয়ন স্কুল ও সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক ছাত্র খুন হয়েছে প্রতিপক্ষের হাতে। যার কোনটির বিচারই এখনো শেষ হয়নি।

দক্ষিণাঞ্চলের একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সাথে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরাও ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে। ফলে লেখাপড়ার মানও ক্রম অবনতিশীল। গত ৫ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে অনেকটা হতাশার চিত্রই ফুটে উঠেছে। দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে বরিশাল বোর্ডের ফলাফল খারাপ। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ফলাফল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এমনকি ২০১৫ সালে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশের হার ৯৭.২৬% হলেও ওই ছেলেমেয়েরাই যখন ২০১৯ সালে এসএসসিতে অংশ নিল তখন তাদের পাশের হার ২০% কমে ৭৭.৪১% হয়েছে। এর মধ্যে ছেলেদের পাশের হার ছিল ৭৪.৪১%।

রাস্তাঘাট ছাড়াও বিভিন্ন পার্ক, রেস্টুরেন্ট আর ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোতে দিনরাত স্কুল কলেজগামী ছেলেরা আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছে। সা¤প্রতিককালে পড়–য়া বন্ধুদের সাথে মেয়েদের আড্ডাও ক্রমশ বাড়ছে। নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, স্বাধীনতা পার্ক ও হাতেম আলী কলেজ-চৌমহনীর লেকের পাড়ে বিকেল থেকে অনেক রাত অবধি এদের অবাধ বিচরণ। এসব স্থানে সন্ধ্যার পরে ইয়াবা বেচাকেনারও অভিযোগ আছে। ধুমপান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর স্লোগানটি যত জোরদার হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলের স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের মধ্যে ক্রমশ তার বিস্তার তত লাভ করছে। কোচিং বাণিজ্যের সুবাদে ঘরে পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা যত সংকুচিত হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাবাজিও তত ব্যপ্তিলাভ করছে। অনেক ছাত্রছাত্রীই কোচিং শেষ করে সন্ধ্যার পরে পার্ক আর কথিত মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোর আলো আধারিতে হারিয়ে যাচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে বেশীরভাগ অভিভাবক উদ্বিগ্ন হলেও অনেক বিলম্বে তাদের বোধোদয় ঘটেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদের অনেকের সন্তানেরাই এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। মফস্বলের যেসব ছেলেমেয়ে বরিশাল মহানগরীর বিভিন্ন হোস্টেল বা মেসে থেকে পড়াশোনা করছে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে। নিজস্ব নৈতিক স্খলনের আগে বোধোদয় না হলে সমাজের অন্ধকার চোরাবালি তাদের অনিবার্য ঠিকানা হয়ে উঠছে।

খোদ বরিশাল মহানগরীর জেলা স্কুল মোড় থেকে সদর রোড হয়ে ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকায় তানজিম ও সৌরভ বালা গ্রুপের মত আরো একাধিক গ্রুপ, বটতলা, চৌমাথা, বৈদ্যপাড়া, বিএম কলেজসহ নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সক্রিয়। অনেক এলাকার ভাগ্য নিয়ন্তাও তারাই।

এসব বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অসীম কুমার নন্দী পরিবার থেকে উপযুক্ত শিক্ষা না পাবার বিষয়টিকে প্রাথমিক কারণ বলে তার মতামত পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এমনকি এরই প্রভাবে সমাজে মাদকের প্রভাবসহ বখাটে শ্রেণি তৈরি হচ্ছে বলেও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণেও কিশোর সন্ত্রাসী ও বখাটে গ্রুপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বখাটে ও কিশোর গ্যাংয়ের বেশিরভাগই প্রাপ্ত বয়স্ক না হলেও সহজলভ্য মাদক ব্যবসা এবং সেবনে জড়িয়ে পড়ছে বলে জানান এ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তার মতে, এসব কারণে সামান্য ঘটনা থেকে বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজ থেকে মাদকের প্রভাব নির্মূল করাসহ পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় এবং সামাজিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনারও তাগিদ দিয়েছেন এ শিক্ষাবিদ। তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে অধিকতর সতর্ক হয়ে তাদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় না দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন।

বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন খান এ ব্যাপারে ইনকিলাবকে জানান, কিশোর অপরাধ ও বখাটেপনা কমাতে মহানগর পুলিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতামূলক সভা করছে। অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথেও মতবিনিময় করে সকলকে সচেতন করা হচ্ছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, কিশোররা যেন অপরাধ কর্মকান্ডে যুক্ত না হয় সে লক্ষ্যে বিএমপির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গত সোমবার বরিশাল প্রেসক্লাবে একটি অনলাইন নিউজ-এর উদ্বোধনী সভায় পুলিশ কমিশনার বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করে নগরীর কিশোর গ্যাং দমনে বিএমপি সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন। পুলিশ কমিশনার এসব ব্যাপারে অভিভাবকসহ সমাজের সকলকে সক্রিয় ভ‚মিকা পালনেরও তাগিদ দেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
ইমরান ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ৯:৫৫ এএম says : 0
ঢাকা শহরে খেলার মাঠ নাই বলে কিশোর গ্যাং জন্মায়, তবে গ্রামে কেন আরো বেশি জন্মায়? টক্ শো দিয়ে অপরাধ কমানো অসম্ভব, অপরাধ নির্মূল করতে পারে কঠোর আইন প্রয়োগ.
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন