শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী বিশ্ব

কাশ্মীর কখনো ভারতের অংশ ছিল না

তৃতীয় কিস্তি

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:৫৭ পিএম | আপডেট : ২:৫৮ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শাসনকাল ও শাসকের এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় পাঁচশ বছর মুসলমান শাসকরা কাশ্মীর শাসন করেছেন। কাশ্মীরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মুসলিম শাসনামলটিই ‘স্বর্ণযুগ’ হিসাবে স্বীকৃত। কাশ্মীরে ইসলামের আগমন সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক বলেছেন, আরব থেকে উত্তর ভারত হয়ে ইসলাম কাশ্মীরে এসেছে। কাশ্মীর একজন শাসক ইসলাম গ্রহণের পর কাশ্মীরিদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। এছাড়া সুফী-দরবেশদের প্রভাবে বিপুল সংখ্যক কাশ্মীরি ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে কাশ্মীর ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গর্বিত পীঠস্থানে পরিণত হয়। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায়, কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশই মুসলমান। এখনোও সেটা বহাল আছে। জম্মুতে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর প্রায় সমান থাকলেও বর্তমানে হিন্দুর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ, মুসলমানের ৩১ শতাংশ।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগে যখন জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজাদের অধীন তখন তার আয়তন ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩৩৬ বর্গ কিলোমিটার। এই বিশাল ভূখÐ এখন তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজিত হয়ে আছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণে আছে প্রায় এক লাখ কিলোমিটার। যা মোট ভূমির ৪৫ শতাংশ। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে ৭৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ৩৬ শতাংশ। আর চীনের অধীনে আছে ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ১৬ শতাংশ। পরবর্তীতে পাকিস্তান চীনের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত সমঝোতায় চীন পাকিস্তানের মধ্যে থেকে আরও পেয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০শ’ কিলোমিটার। এতে চীনের নিয়ন্ত্রিত এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। পাকিস্তান-ভারত ও চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কাশ্মীর এই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজিত হয়েছে। ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান কাশ্মীরের একাংশ দখলে নেয় যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। বাকি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় চীন কাশ্মীরের অংশ বিশেষ দখল করে, যা তার ভুখÐ বলে চীন দাবি করে। এছাড়া আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তানের কাছ থেকেও চীন কাশ্মীরের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি লাভ করে। এই তিন রাষ্ট্র বিভাজিত কাশ্মীরের ভারত অধিকৃত অংশটি এখন তার স্বায়ত্তশাসন ও অধিকার এবং সংবিধানে বর্ণিত বিশেষ মর্যাদা ও সুযোগ হারালো। শুধু তাই নয়, তাকে দ্বিখÐিত করে লাদাখ এলাকাকে আলাদা করা হয়েছে।
কাশ্মীরের এই বিভাজন ও কাশ্মীরিদের বর্তমান বিপর্যয়ের সূত্রপাত অনেক আগে। কাশ্মীরে মোঘল শাসনের অবসান ঘটে ১৭৫২ সালে। অতপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় আফগান শাসন, যা স্থায়ী হয় ১৮১৯ সাল পর্যন্ত। আফগান শাসন কাশ্মীরিদের জন্য খুব সহনযোগ্য ছিল না। কোনো কোনো শাসক সুশাসক ও ন্যায়বিচারক হিসাবে খ্যাতি লাভ করলেও কোনো কোনো শাসক ছিলেন অত্যাচারী ও জনপীড়ক। শেষ পর্যন্ত আফগান শাসকদের দুর্বলতার কারণে ও জনসমর্থন না থাকায় শিখ সা¤্রাজ্যের অধিশ্বর রঞ্জিত সিং আফগানদের যুদ্ধে পরাজিত করে কাশ্মীর অধিকার করে নেয়। শিখ শাসন স্থায়ী হয় ২৮ বছর (১৮১৯-১৮৪৬)। এরপর ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে (১৮৪৫-১৮৪৬) শিখেরা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে বেশ কিছু প্রশাসনিক প্রদেশ ছিল যার মধ্যে জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, বালটিস্তানের গিলগিট উল্লেখযোগ্য। শিখ সাম্রাজ্যের অধীন জম্মুর শাসক ছিলেন ডোগরা (হিন্দু বর্ণবিশেষ) জমিদারওলাব সিং। পরে তিনি লাদাখ ও বালটিস্তানের শাসন কর্র্তৃত্বও অধিকার করেন। শিখ সাম্রাজ্যের অধিন থাকাকালেই ডোগরা জমিদার ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। যখন ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধ বাধে তখন গুলাব সিং শিখদের পক্ষাবলম্বন করা থেকে বিরত থাকেন। যুদ্ধ শেষে শিখদের পরাজয়ের পর যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে কাশ্মীরসহ শিখ সাম্রাজ্যের কিছু এলাকা ব্রিটিশদের হাতে আসে। ৯ মার্চ, ১৮৪৬ তে এই চুক্তি হয়। এর এক সপ্তাহ পর (১৬ মার্চ) অমৃত সরে গুলাব সিংয়ের সঙ্গে ব্রিটিশদের আর একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে গুলাব সিং ব্রিটিশদের কাছ থেকে কাশ্মীরসহ পাহাড়ী কয়েকটি জেলার মালিকানা লাভ করেন। একটি ভূখÐ এবং তার জনগণ এখানেই অর্থের বিনিময়ে বিক্রী হয়ে যায়। এদিকে লক্ষ্য রেখেই মহাকবি আল্লামা ইকবাল কাশ্মীরিদের ‘বিক্রিত জাতি’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক আর এস গুলের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘ডাচদের কাছে নিউইর্য়ক সিটি বিক্রি হয়েছিল ১৬১৪ সালে ২৪ ডলারে। রাশিয়ানদের কাছ থেকে ১৮৬৭ সালে আমেরিকা কিনেছিল রাশিয়ান আমেরিকা ৭.২ মিলিয়ন ডলারে। পরে তার নাম হয়েছিল আলাস্কা। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৮৪৬ সালে কাশ্মীরকে বিক্রির ঘটনা কোনো জাতি বিক্রি হওয়ার সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। ১৭০ বছর পরও ৭৫ লাখ রুপির ক্রয়চুক্তি যা কাশ্মীর থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে অমৃতসরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, এখনো কাশ্মীরি জাতিসত্ত্বার সমস্যার মূল হিসাবে সামনে আসছে।’


প্রথম কিস্তি

দ্বিতীয় কিস্তি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন