শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

ক্লাব পাড়া যখন ক্যাসিনো পাড়া!

অস্থির ক্রীড়াঙ্গণ

জাহেদ খোকন | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:০২ পিএম

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি পরিচিত নাম মতিঝিল ক্লাব পাড়া। এখনে ছোট, বড় মিলিয়ে ১১টি ক্লাব রয়েছে। যাদের মূল কাজই হলো খেলাধুলা পরিচালনা করা। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? খেলাধুলার আড়ালে এসব ক্লাবে নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে জুয়ার আসর। অনেকটা হাক-ডাক দিয়ে চলছে ক্যাসিনো বানিজ্য! সরেজমিনে গেলে দেখা যাবে মতিঝিল ক্লাব পাড়ার জগৎটাই আলাদা। রঙিন আলোর ছটায় সেখানে চলছে জমজমাট ক্যাসিনো ব্যবসা। ক্রীড়ার জন্য জন্ম হলেও এসব ক্লাব নিজেদের জন্মকথা বা উদ্দেশ্য বেমালুম ভুলে গিয়ে বছরের পর বছর করে যাচ্ছে অনৈতিক কাজ। যা শুধু খেলাধুলাই নয়, সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর।

ক্লাব পাড়ার এখন নতুন নাম দেয়া যেতে পারে ‘ক্যাসিনো পাড়া’! এটা একটা অন্ধকার জগৎ। এই জগতে যারাই পা দিয়েছে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সম্প্রতি ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের পর ক্লাব পাড়ার সেই অন্ধকার জগতে আলোচ্ছটা পড়েছে। আলোচ্ছটার সেই আলোয় ভেসে ওঠেছে তথাকথিত ক্রীড়া সংগঠকদের কোটি কোটি টাকা কামানোর গল্প। এই গল্প শুনলে মনে হবে ক্যাসিনো যেন টাঁকশালের চেয়েও বড় কোনো টাকার মেশিন!

সামনে ক্লাবের সাইনবোর্ড কিন্তু ভেতরের একটা অংশ একদম আলাদা। যেখানে জুয়ারি ছাড়া সাধারণ মানুষ কিংবা ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রবেশ নিষেধ। ভুল করেও কেউ সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে বিশালদেহী নিরাপত্তা কর্মীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। তাই বিভিন্ন ক্লাবের এই জগৎ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নেই সাধারণ মানুষের।

বছরের পর বছর যাদের নাকের ডগায় চলেছে জুয়া ও মাদকের ব্যবসা সেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশে লটবহর নিয়ে হানা দেয় ক্লাব পাড়ায়। যা এখন ‘ক্যাসিনো’ পাড়া নামেই পরিচিত। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) অভিযান চালায় মতিঝিল ক্লাব পাড়াস্থ বিভিন্ন ক্লাবের ক্যাসিনোতে।

প্রথমেই উন্মোচিত হয় ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের প্রকৃত রূপ। এক সময় যে ক্লাবটির খ্যাতি ছিল ফুটবলার তৈরির কারখানা হিসেবে। সেই খ্যাতি ধুলোয় মিশিয়ে তা এখন হয়ে উঠেছে জুয়ার আসর। এই ক্লাব ২০১৬ সালে ফুটবলের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ থেকে প্রিমিয়ারে উঠলেও টাকার অভাব দেখিয়ে খেলেনি দেশের সর্বোচ্চ লিগে। অথচ ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াকে গ্রেফতারের পর জানা গেল ওই ইয়ংমেন্স ক্লাবে প্রতি রাতেই হতো কোটি কোটি টাকার জুয়া!

একই অবস্থা পাশের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবেরও। খেলার নামে ঠনঠন অথচ জুয়ায় যেন আলো ছড়িয়েছে ওয়ান্ডারার্স। র‌্যাবের প্রথমদিনের অভিযানে ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স, ওয়ান্ডারার্স এবং গুলিস্তানস্থ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের আসল কর্মকান্ড সম্পর্কে জেনেছেন দেশবাসী।

শুধু মতিঝিল ক্লাব পাড়াই নয়, ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসা চলে রাজধানীসহ দেশের অনেক অভিজাত এলাকাতেই। যার প্রমাণ ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লিগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজের গ্রেফতার হওয়া। জুয়া ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই তাকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। অবশ্য র‌্যাবের অভিযানের পর হঠাৎ করেই থমকে গেছে মতিঝিলের ক্যাসিনো পাড়া। বন্ধ হয়েছে দেশের সব ক্রীড়া সংগঠনের জুয়া বাণিজ্য।

ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা! এটাকে কি চোখে দেখছেন দেশের স্বনামধন্য ক্রীড়া সংগঠকরা? তা জানতে শনিবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি ও সাবেক তারকা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ক্রীড়ার উন্নয়নে জুয়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকতে হবে এটা বাজে কথা। সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমি শুধু একটা কথাই বলবো। আর তা হলো সরকার যা করছেন, ভালোই করছেন।’

বাফুফের সহ-সভাপতি আরেক সাবেক ফুটবলার বাদল রায় বলেন, ‘মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছি। সোনালী অতীত ক্লাবেও আমাদের মতো সাবেক খেলোয়াড়দের যাতায়াত রয়েছে নিয়মিত। কিন্তু আমরা কখনো জুয় খেলার সঙ্গে জড়াইনি। তবে আমি মনে করি এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন ক্লাবে জুয়ার বোর্ড ভাড়া দেন বা ক্যাসিনো চালান। এই ব্যবসার টাকা ওই ক্লাবের খেলাধুলা উন্নয়নে খরচ হয় না। এমন অসাধু কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা দরকার। যারা খেলা নয় ক্যাসিনোর দখলে রেখেছেন ক্লাবপাড়া’কে।’

অভিযোগ রয়েছে ক্যাসিনো চালানোর জন্য ক্লাব কর্মকর্তারাই শতভাগ দায়ী। কিন্তু এটা মানতে নারাজ ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক লোকমান হোসেন ভুঁইয়া। তার দাবি, তারা কেবল তাদের জায়গা ভাড়া দিয়েছেন। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। লোকমান বলেন, ‘আমি জানি দেশে ক্যাসিনো ব্যবসা অবৈধ। এটা পুরোপুরিই অবৈধ। আমরা ক্যাসিনোর জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে আমাদের করার কিছুই নেই।’ তিনি যোগ করেন, ‘এটা সত্য ক্যাসিনো থেকে আমরাও লাভবান হই। কিন্তু এটা আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। অতীতে আমরা এটা ছাড়াই ক্লাব চালিয়েছি। খেলাধুলার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা কেবল ক্যাসিনো থেকে ভাড়া পাই।’

লোকমান দাবি করেন, জুয়া ছাড়া তাদের আয়ের একমাত্র উৎস হলো অনুদান। ক্লাব চালানোর জন্য যা যথেষ্ঠ নয়, ‘জুয়া বা ক্যাসিনো থেকে আমরা যে অর্থ পাই তা খুব বেশি নয়। মোহামেডানের মত ক্লাবের দৈনিক খরচই আছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তাই আমাদের অনুদানের দিকে চেয়ে থাকতে হয়।’ লোকমান আরো বলেন, ‘ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। এমনকি ক্যাসিনোর কারো সঙ্গে আমার দেখাও হয়নি। তারা বিভিন্ন লোক মারফত বিভিন্ন সময়ে টাকা পাঠিয়ে দেয়।’

ক্লাবগুলোতে জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসা বন্ধ করার সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানান ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুহিন। তিনি বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনেও একই পদে আছেন। তুহিন জানান, স্পন্সরের অভাবে তারা জুয়ার বোর্ড বা ক্যাসিনো ভাড়া দিয়েছেন।
তার কথা, ‘যদি ক্লাবগুলো যথেষ্ঠ স্পন্সর পায় তাহলে কেউ-ই এটা করবে না।’ তুহিনের দাবি, তিনি জানেন না কে তাদের ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেছে, ‘ক্যাসিনো যারা চালু করেছে আমি তাদের কাউকে চিনি না। আমরা কেবল এ থেকে ভাড়া গ্রহণ করি।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন