বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ওয়াসার ৪০ কোটি টাকা গচ্চা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম | আপডেট : ১২:০৫ এএম, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নিয়ম লঙ্ঘন করে সরকারী কর্মকর্তাদের একটি অংশ সর্বনিম্ন দরদাতার পরিবর্তে ৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা লোকসান করে একটি সংস্থাকে পানি সরবরাহ প্রকল্প দেয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে, দুটি নিম্নতম দরদাতাদের দরপত্র কেন বাতিল করা হয়েছে প্রকল্প পরিচালককে তার ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে এডিবি।

এডিবি পিডিকে দুই দরদাতাদের কাছে কেন দামের প্রার্থক্য মাত্র ৪ কোটি টাকা তাও জানতে চেয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, ঢাকা পানি সরবরাহ ও নিকাশ কর্তৃপক্ষের (ডিডব্লিউএসএ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ৩৩১ কোটি টাকার চুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন এবং স্থানীয় সংস্থা আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেডকে ৫৯ লাখ টাকা, যদিও এই সংস্থাটি অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে (অপ্রতিক্রিয়াশীল)।

চুক্তিটি চতুর্থ প্যাকেজের আওতায় ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প (ডিডব্লিউএসএনআইপি) শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় কার্যকর করা হবে। আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেডের পক্ষে চুক্তিটি পাওয়ার জন্য ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খান এবং অতিরিক্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার-কাম প্রকল্প পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান এই প্রকল্পের সিংহ ভাগ দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দ্বারা অর্থায়ন করবে বলে অভিযোগ করছে)

অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, ডব্লিউএসএনআইপি’র অধীনে চতুর্থ প্যাকেজের জন্য ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারী ওয়াসা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। স্থানীয় উপ-চুক্তির মাধ্যমে দশটি বিদেশি যোগ্য সংস্থা দরপত্র প্রক্রিয়াতে অংশ নেয়। এডিবি’র সংগ্রহের নির্দেশিকা অনুসারে, প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন শেষে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিক্রিয়াশীল ঘোষণা করা হয়েছিল।

তন্মধ্যে, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হুবেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনস্ট্রাকশন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (এইচআইসিসি) হ›ল একমাত্র প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নির্মাণ উদ্যোগ যা গত ৬০০ বছরে নতুন চীনের নির্মাণে অংশ নিয়েছে। এইচআইসিসি চারটি প্রতিক্রিয়াশীল বিডির মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। এইচআইসিসি ২৯১ কোটি টাকা এবং ১৫ লাখ টাকার দরপত্রের প্রস্তাব দিয়েছে।

চীন ফার্স্ট মেটালার্জিকাল গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। তারা ২৯৪ এবং ৫১ লাখ টাকা প্রস্তাব করেছিল। চীন কনস্ট্রাকশন দ্বিতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো এবং আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড যৌথভাবে ৩৩১ কোটি এবং ৫৯ লাখ টাকা প্রস্তাব করেছে। চারটি দরদাতাদের মধ্যে তারা তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল। চীন জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিজিসি) ছিল চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা। তারা ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি এবং লাখ টাকা প্রস্তাব করেছিল। সাধারণ নিয়ম অনুসারে, সর্বনিম্ন আর্থিক দরদাতাকে অবশ্যই চুক্তি দেয়া উচিত। তবে ওয়াসার এমডি এবং প্রকল্প পরিচালক সম্মত হননি এবং নিয়ম মানতে অস্বীকার করেছেন। তাদের জমাটি অযোগ্য ঘোষণা করার ন্যায়সঙ্গত হিসাবে এবং স্পষ্টতই সর্বনিম্ন দরদাতাদের বাতিল করার জন্য তারা উল্লেখ করেছেন যে প্রথম এবং দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাদের দাম মূল্য মাত্র চার কোটি টাকা ছিল এবং দুটি দরদাতাদের মধ্যে তাদের কিছু ‘অনুরূপ’ ইস্যুও ছিল।

আরএফএল কর্তৃপক্ষ লবিং করে এবং ওয়াসার এমডি এবং প্রকল্প পরিচালককে চাপ দিচ্ছে অবশেষে চুক্তিটি তাদের পক্ষে দেয়ার জন্য। কর্মকর্তাদের উত্থাপিত আপত্তি নিম্নলিখিত দরপত্র বিড পর্যালোচনা করা হয়। কারিগরি কমিটির মাধ্যমে দরপত্র পরীক্ষা করার জন্য একটি অফিসিয়াল চিঠি দেয়া হয়েছিল। তবে প্রযুক্তিগত কমিটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিধি অনুসারে প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাদের জমা দেয়া দরপত্রগুলোতে কোনও ত্রুটি খুঁজে পায়নি। সেই পর্যায়ে, ওয়াসার এমডি এবং পিডি প্রথম এবং দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাদের ত্রুটিগুলো খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই বিষয়টিকে সামনের লাইনে এনে তারা এই দুটি সর্বনিম্ন দরদাতাকে অভিযুক্ত করেছে।

শুধু তাই নয়, পিডি মো. আক্তারুজ্জামান আরএফএল প্লাস্টিকের সাথে যোগাযোগটি পুরস্কারের জন্য এডিবি’র কাছে সুপারিশ করেছিলেন, দু’জন সর্বনিম্ন দরদাতাদের চেয়ে রহস্যজনকভাবে ৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি দিয়েছেন। প্রকল্প পরিচালকের মাধ্যমে এডিবি থেকে চিঠি পেয়ে দু’জন দরদাতাই তাদের লিখিত জবাব প্রেরণ করেছেন। উত্তরে তারা জানায় যে একজন উপ-ঠিকাদার আন্তর্জাতিক টেন্ডারের নিয়ম অনুসারে বেশ কয়েকটি সংস্থার সাথে অংশ নিতে পারে।

প্র্রকল্প পরিচালক আরএফএলের পক্ষে তদবির করার জন্য ফিলিপাইনের এডিবি’র প্রধান কার্যালয়ে যান। আরএফএলের পক্ষে চুক্তি দেয়ার জন্য তিনি এডিবি প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনও নিয়ে এসেছিলেন। আরএফএলকে চুক্তি দেয়ার জন্য বোর্ড সভায় অনুমোদনের চিঠিও রেখেছিলেন তিনি। বোর্ডের কিছু সদস্য স্বচ্ছতার অভাবে এডিবি প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনের চিঠি বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় প্রযোজনা প্রযুক্তিগত ইউনিটে প্রেরণের প্রস্তাব দেন। সেখানে ওয়াসার এমডি এবং প্রকল্প পরিচালক প্রকাশ্যে আরএফএলের পক্ষে তদবির শুরু করেন।

দুদকে জমা দেয়া অভিযোগ বলা হয়, তাসকিম এ খান মেঘনা নদীতে স্থাপন হওয়া গন্ধবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারিত হয়েছিল ২ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যে টেন্ডার আহ্বান করলে দেশি-বিদেশি ৯টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয় সে সময়। এর মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে শুধুমাত্র এমডি তার পছন্দের সুয়েজ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানিকে ৩ হাজার ২শ’ কোটি টাকায় পাইয়ে দেন।

২০১৪ সালে পদ্মা জলশদিয়া প্রকল্পেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে। এই প্রকল্পে কোনো টেন্ডারই হয়নি বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। শুধু তাই নয়, তাকসিম এ খান ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার প্রকল্পটি চায়না সিএমসি কোম্পানিকে পাইয়ে দেন। এই প্রকল্প থেকেও মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি। তবে এই কাজে লোকাল এজেন্ট হিসেবে অরদিদ নামের একটি কোম্পানি তদারকি করে। এদিকে দাশেরকান্দি পয়ঃ শোধনাগার প্রকল্পেও টেন্ডার বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ উঠে ওয়াসার এই এমডির বিরুদ্ধে। এ প্রকল্পে ঠিকাদার হাইড্রো-চায়নাকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ জমা দেয়া হয়েছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, লোকাল এজেন্ট ইস্পাহানী গ্রুপের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এখানেও এক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটে। অপরদিকে ২০১৬ সালের গুলশান-বারিধারা লেক প্রকল্পেও ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এই প্রকল্পে দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আখতারুজ্জামানও আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

প্রকল্পের নামে দুর্নীতির বাইরে ওয়াসায় নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও তদন্ত হচ্ছে। গত দশ বছরে একই চেয়ারে বহাল থেকে নিজ ক্ষমতাবলে অর্থের বিনিময়ে ঢালাওভাবে বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেয়ার মতো অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমডির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ওয়াসার নিয়ম ভেঙে পরিচালক আবুল কাশেম ও একেএম শহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দেয়ার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটান। বিষয়টি নিয়ে যখন ওয়াসা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয় সে সময় অভিযোগের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত দু’জনের বেতন ভাতা বন্ধ ও ওয়াসার সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতির এক দাপ্তরিক আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ অমান্য করে এখনো তাদের ওই পদে বহাল রেখেছেন ওয়াসা এমডি। এছাড়া ওয়াসার কো-অর্ডিনেশন অফিসার শেখ এনায়েত আব্দুল্লাহ, সহকারী সচিব মৌসুমী খানম, চিফ ফাইন্যান্স অফিসার রত্মদ্বীপ বর্মনকে ঢালাওভাবে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন বলে দুদকে দেয়া ওই অভিযোগে বলা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন