আফতাব চৌধুরী
রমজান রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। ইসলামের পতাকাবাহী তথা মুসলমানদের আত্মগঠনের প্রশিক্ষণের জন্য এ এক অপূর্ব সুযোগ। রমজানের এ সিয়ামকে আল্লাহতা’য়ালা অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) করেছেন এই বলে, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রমজানের সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিল, যাতে তোমরা খোদাভীতি অর্জন করতে পার। (সূরা বাকারা-১৮৩)।
এ রমজান মাসেই কোরআন নাযিল করা হয়েছিল, যা সমগ্র মানব জাতির জন্য জীবন-যাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলিতে পরিপূর্ণ কাজেই যে ব্যক্তি এ মাসের সম্মুখীন হবে, তার জন্য এ মাসের রোজা রাখা একান্ত কর্তব্য। আর যদি কেউ সফরে থাকে কিংবা অসুস্থ হয় তাহলে সে যেন অন্য দিনগুলোয় এ রোজার সংখ্যা পূর্ণ করে দেয়। (সূরা বাকারা-১৮৫)।
এটা কারো অজানা নয় যে, রমজানে রোজা রাখা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু শুধুমাত্র উপবাস করার নাম সিয়াম নয়, যদিও উপবাস সিয়ামের একটি অংশ।
এ জন্যই হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলল, পাপাচারে লিপ্ত হলো, কামাচার করলো উপবাসে তার কোনো লাভ নেই। পাশাপাশি যারা পাপাচার, কামাচার, সামাজিক অনাচার থেকে নিজেদের দূরে রাখল তাদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে আল্লাহতা’য়ালার পক্ষ থেকে। রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধকে আল্লাহতা’য়ালা কিয়ামতের দিন মেশকে আম্বরের (মৃগনাভী) সুগন্ধে পরিণত করে তাঁকে সম্মানিত করবেন। বেহেশতে প্রবেশের যে কয়টি দরজা রয়েছে তার মধ্যে রাইয়্যান নামক একটি দরজা শুধুমাত্র রোজাদারের জন্য সংরক্ষিত, কেবলমাত্র রোজাদারেরাই এ দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে এবং তাঁদেরকে ফেরেশতারা স্বাগত জানাবেন। রোজাদারেরা যেহেতু আল্লাহতা’য়ালার উদ্দেশ্যে রোজা রাখে, সুতরাং এর প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহই দিবেন।
রোজাদারের বৈশিষ্ট্য হবে যখন তার সাথে কেউ ঝগড়া করার প্রচেষ্টা করবে তখন সে বলবেÑ “ভাই আমি রোজাদার” অর্থাৎ আমি বিবাদে প্রস্তুত নই। এভাবে রোজাদারেরা ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলবে।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূল (সা.) যখন ইফতার শুরু করতেন তখন আমাদের মনে হতো তিনি বুঝি এ মাসে কোনও ইফতারই করবেন না। আর যদি আপনি তাঁকে রাতে নামাজরত অবস্থায় দেখতে চান তাহলে তা দেখতে পাবেন। আর যদি নিদ্রারত অবস্থায় দেখতে না চান তাহলে তাও দেখতে পাবেন। (বুখারী)
অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির জীবন কতটুকু ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল, আন্তরিকতাপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ হলে এসকল গুণাবলী তার চরিত্রে একত্রে সন্নিবেশ ঘটে তা অনুধাবনযোগ্য বৈকি।]
“আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মুহররম মাসের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হচ্ছে রাতের (তাহজ্জুদ) নামাজ (মুসলিম) যেহেতু রমজানের প্রতিটি ইবাদতের সওয়াবকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয় সুতরাং এ সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হবো কেন?
“মহান আল্লাহ বলেন, আর রাতের একটি অংশে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়। তা তোমার জন্য হবে অতিরিক্ত বস্তু। আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে মাকামে মাহমুদে স্থান দিবেন।” (সূরা-ইসরা-৭৯ আয়াত)।
এ নামাজ গভীর রাতে মা’বুদের কাছে প্রাণের আকুতি নিয়ে নির্জনে আদায় করা উচিত। যারা বিবাহিত তার স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে উৎসাহিত করা উচিত।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনÑ রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রতি সদয় হোন যে রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এবং তার স্ত্রীকেও জাগায় আর স্ত্রী যদি উঠতে অস্বীকার করে তাহলে তার মুখে পানির ছিটা দেয়। আল্লাহ সে মহিলার প্রতি সদয় হোন যে রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এবং নিজের স্বামীকেও জাগায় আর স্বামী উঠতে অস্বীকার করলে তার মুখে পানির ছিটা দেয়। (আবু দাউদ)
তারাবীহ নামাজের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলে খোদা (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করছি ‘আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূল (দ.) রমজানে কিয়াম করার (অর্থাৎ তারাবীহ পড়া) ব্যাপারে কেবল উৎসাহিত করতেন কিন্তু এ ব্যাপারে তাগিদ সহকারে হুকুম দিতেন না। (যাতে এটা ফরজ হয়ে না যায়) তাই তিনি বলতেনঃ যে কেউ ঈমান সহকারে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে রমজানে সিয়াম করে তা পূর্ববর্তী সমস্ত গুণাহ মাফ করে দেয়া হবে। (মুসলিম)
অবশ্য আমাদের দেশের মুসলমানেরা তারাবীহ নামাজ সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে আদায় করে থাকেন। অধিকাংশ মুসলমান এ তারাবীহ নামাজের সাথে এক খতম কোরআন আদায় করে থাকেন।
এ মাসে আরেকটি বোনাস সুযোগ হলোÑ শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে না গণহারে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (দ.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস আসে, জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে আবদ্ধ করে দেয়া হয়।’ (বুখারী ও মুসলিম)
এ মাসে এমন একটা রাত রয়েছে যা হাজার রাতের চাইতেও উত্তম। যে রাতের নাম লাইলাতুল কদর। মহান আল্লাহ বলেন, নিঃসন্দেহে আমি কোরআন নাযিল করেছি কদরের রাতে।’ (সূরা কদর-১) “অবশ্য আমি কোরআন নাযিল করেছি একটি বরকতপূর্ণ রাতে” (সূরা দুখান-৩)
লাইলাতুল কদরের রাতে যাতে আমাদের অগোচরে বিদায় হতে না পারে সে জন্য রমজানের শেষ দশদিনে ইতিকাফ করা হয়ে থাকে।
আয়শা (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেনÑ ‘রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশদিনে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন রমজানের শেষ দশ রাতে শবে কদরের সন্ধান কর।’ (বুখারী মুসলিম) আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, “রাসূল (সঃ) বলেছেন, রমজানের শেষ দশ রাতে বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদরের সন্ধান কর।” (বুখারী) আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূল (দ.) রমজানে (আল্লাহ ইবাদতের ক্ষেত্রে) এমন প্রচেষ্টা ও সাধনা করতেন যা অন্য কোনো মাসে করতেন না। আর তার শেষ দশ দিনে এমন প্রচেষ্টা ও সাধনা করতেন যা অন্য কোনো সময় করতেন না।’ (মুসলিম)
আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “রমজানের শেষ দশদিন শুরু হলে রাসূল (সা.) সারা রাত জাগতেন, নিজের পরিবারবর্গকেও জাগাতেন এবং (আল্লাহর ইবাদতে) খুব বেশি সাধনা ও পরিশ্রম করতেন।” (বুখারী মুসলিম)
এ কদর রাতে আল্লাহতা’য়ালার দরবারে কি বলতে হবে তাও সরওয়ারে কায়েনাত, বিশ্বমানবতার মহান মুক্তির দিশারী, আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের সুন্দরভাবে শিখিয়েছেন।
আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি জানতে পারি কোন রাতটি কদরের রাত তাহলে আমি তাতে কি বলব?’ জবাব দিলেন ‘তুমি বলবেÑ হে আল্লাহ! তুমি অবশ্যই ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা পছন্দ কর। কাজেই আমাকে ক্ষমা কর।’ (তিরমিজী) এ দোয়া রমজানের শেষ দশদিনে করা উত্তম। এ মাসে নেক আমলের সাথে সাথে দান করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “রাসূল (সা.) ছিলেন লোকদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল, আর বিশেষ করে রমজান মাসে তাঁর দানশীলতা আরো বেশি বেড়ে যেত যখন জিব্রাইল (আ.) তাঁর সাক্ষাৎ করতেন। জিব্রাইল (আ.) তাঁর সাথে রমজানের প্রতি রাতে দেখা করতেন এবং তাঁকে কোরআন শিখাতেন। তবে জিব্রাইল (আ.) যখন তাঁর দানশীলতা বৃষ্টি আনয়নকারী বাতাসের চাইতেও বেশি কল্যাণকামী হয়ে উঠতো।” (বুখারী, মুসলিম)
সেহরী খাওয়া সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর বাণী হলোÑ যায়িদ সাবিত (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে সেহরী খেলাম, তারপর নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, সেহরী ও আজানের মধ্যে কতটুকু সময়ের ব্যবধান ছিল?’ জবাব দিলেন, ‘পঞ্চাশ আয়াত পড়ার মতো সময়ের ব্যবধান ছিল।’ (বুখারী, মুসলিম)
ইফতারি সম্পর্কে সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, লোকেরা যতদিন দ্রুত ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের মধ্যে অবস্থান করবে। (বুখারী)
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের এ বিধি-নিষেধগুলো কোরআন মজিদ ও সুন্নাতে মুহাম্মদী (সা.)-এর এক অপূর্ব বৈশিষ্ট্য। এখানে পুলিশ বা গোয়েন্দা লাগানোর প্রয়োজন নেই নিজের খোদাভীতি সে দায়িত্ব পালন করবে। ইহা স্ব-স্ব কল্যাণের জন্যই। যেমন লোকেরা নিজেদের মন অন্তর-হৃদয়কে পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আল্লাহতা’য়ালা তাদের সামষ্টিক অবস্থারও কোনো পরিবর্তন করবেন না। আল-কোরআন
তাই নিজের দুনিয়াবী ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য নিজেকেই আন্তরিকতার সহিত ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে সমর্পণ করতে হবে সর্বাত্মকভাবে। ধন-মাল ও সন্তানাদিও দুনিয়াবী কামিয়াবীর জন্য বাছাই না করে যাচ্ছেতাই কার্যকর কিছু করা আপাতদৃষ্টিতে কল্যাণকর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কল্যাণকর নয়। যেমনÑ ‘কিয়ামতের দিন ধন-মাল পুত্র-সন্তানাদি কোনো কল্যাণ দিবে না, কল্যাণ পাবে শুধু সে লোক যে আল্লাহর কাছে সুস্থ নির্দোষ দিল-অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।’ আল-কোরআন।
এ আলোকে আমাদেরকেই মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে রমজান মাসকে আমরা কীভাবে অতিবাহিত করব। এতে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে মানসিকভাবে অসুস্থ হতে বাধ্য। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখ মানবদেহে একটা মাংস খ- রয়েছে, তা যদি সুস্থ থাকে তাহলে গোটা দেহই সুস্থ হয়ে যায়। আর সেটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে গোটা দেহই অসুস্থ হয়ে যায়। জান সেটা হচ্ছে দিল-অন্তর।’ (আল-হাদীস)
এ জন্যই সম্ভবত বুখারী শরিফের প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে “সমস্ত কাজের মূল্যবান হয় নিয়তের ভিত্তিতে” অর্থাৎ মানুষ তাই পায় যা পাওয়ার জন্য সে নিয়ত করে। সুতরাং পবিত্র রমজানে আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ এ নিয়তে হওয়া চাই, যাতে কাল কিয়ামতের ময়দানে নাজাতের সুযোগ খুঁজে পাই। আমীন
ষ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন