শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপার সম্ভাবনার রাতারগুল

অব্যবস্থাপনায় অরক্ষিত প্রাকৃতিক শিল্প

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

প্রকৃতির অনন্য দান দেশের একমাত্র ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেটের রাতারগুল। উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর; মাঝখানে পানিবেষ্টিত সিলেটের বন রাতারগুল। পানির ওপর জঙ্গল পরিবেশ তৈরি করেছে এক ধরনের বুনো সৌন্দর্য। গা ছমছম করবে ঠিকই কিন্তু সে রকম ভয় ধরাবে না। রোমাঞ্চের শিহরণ জাগাবে, আবার নিবিড় মমতায় জড়াবে। তাই রাতারগুলের স্থির পানির হাতছানিতে মাতে অন্তরের টান।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীতে মিঠা পানিবেষ্টিত বন আছে মাত্র ২২টি। এই উপমহাদেশে আছে এর দু’টি। একটি শ্রীলঙ্কায়, অপরটি সিলেটের রাতারগুল। ল্যাটিন আমেরিকায় আমাজনের মতোই এখানকার গাছগাছালির বেশিরভাগ অংশ বছরে চার থেকে সাত মাস পানির নিচে থাকে। বর্ষা মৌসুমের প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে (মে-সেপ্টেম্বর)। শীতকালে পানিবিহীন পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙা। তখন পানি আশ্রয়ী প্রাণীকুলের আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া লেকে।
অরণ্য ও স্ফটিক পানির আশ্চর্য সুন্দর এই মিতালী পর্যটকদের কাছে পরিচিত হতে শুরু করে ২০১১ সাল থেকেই। সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন হলেও রাতারগুল সিলেট শহরের বেশ কাছাকাছি। কিন্তু এই কাছাকাছি গন্তব্যটুকুও প্রায় অচেনা ছিল সিলেটের মানুষের কাছেই। পর্যটন সম্ভাবনা একটি অঞ্চল কী ভাবে দ্রুত বদলে দিতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ রাতারগুল।
বন বিভাগের প্রায় ছয় কোটি টাকার প্রজেক্ট অনুমোদিত হয়ে বনের ভিতর সুউচ্চ টাওয়ার তৈরি করেছে। শুধু তাই নয়, বন কর্মকর্তাদের জন্য আধুনিক কার্যালয় ও বাসস্থান এবং বনের ভেতর দিয়ে ইট-বিছানো রাস্তা হচ্ছে! এ নিয়ে পরিবেশবাদীদের চরম আপত্তি থাকলেও কর্মকান্ড সম্পাদনে তাদের থামাতে পারেনি কেউ। কথিত উন্নয়ন নামের বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেই দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ স্বরূপ হারাচ্ছে বহুকাল ধরেই।
দেশের নদ-নদী ও বনবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প, সড়ক-সেতু-ভবন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি, মানুষের জীবন ও সম্পদ নিয়ে ভয়াবহ সব চুক্তি, ঋণনির্ভরতা সৃষ্টি, জাতীয় সক্ষমতার ক্ষয় ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নামের কনসালট্যান্ট এবং আমলাদের ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে লাভবান হয় দেশ-বিদেশের কতিপয় গোষ্ঠী। তার মধ্যে বহু বিশেষজ্ঞও আছে যারা এগুলোর কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না। কিন্তু ভোগান্তি বহন করতে হয় মানুষকে।
উন্নয়ন নামের এসব প্রকল্পের যথেষ্ট বিরোধিতা হয়নি বলেই দেশে নদী পাহাড় জমি বিল এবং শেষ বিচারে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। রাতারগুলের সম্ভাবনাও সে পথেই রুদ্ধ। পুকুর খননের অভিজ্ঞতার জন্য যেখানে সরকারি খরচে থাইল্যান্ড যেতে হয়, সেখানে সোয়াম ফরেস্টের মতো অমূল্য সম্পদ রক্ষা ও গঠনে যথাযথ অভিজ্ঞতাহীন, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রাকৃতিক এ অমূল্য সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতের ব্যর্থতা অর্থনীতিক সমৃদ্ধসহ বেঁচে থাকার মূখ্য বাহন সবুজ প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠছে ক্রমশ। নানা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এই মিঠাপানির বনে অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত। বনের স্বাস্থ্য সন্তোষজনক।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রায় ৬৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়। রাতারগুল ছাড়াও সিলেটের অন্য বনগুলোর সংরক্ষণ, সুরক্ষাসহ বন বান্ধব পরিবেশ আরো নিবিড় হবে এ প্রকল্প অনুমোদন ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে।
রাতারগুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে মূল বনে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র বাহন। বনে প্রবেশের জন্য ৩টি পথ রয়েছে। মটরঘাট, রাতারগুল ঘাট ও চৌরঙ্গি ঘাট। তিন ঘাটে প্রায় ২৫০ নৌকা নিয়ে সিন্ডিকেটও তৎপর। পর্যটকদের জিম্মি করে ভাড়া আদায়ের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ২ ঘণ্টার জন্য ৭৫০ টাকা হারে ভাড়া ঠিক করে দেয়। বনের ভেতর পর্যটকরা সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে একনজরে গোটা বনের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকার পরও নিজ দায়িত্বেই পর্যটকরা ঘুরছেন বনজুড়ে। বন চরিত্রের বিপরীত হলেও বনের নির্জনতায় গলা ছেড়ে গান ধরা, সেলফিবাজিতে মজা নিচ্ছেন আপন মনে। বনের শুকনো স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে গাছগাছালির বন্ধনে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলার দৃশ্য তো রয়েছেই।
স্থানীয়দের মতে, পর্যটক নির্ভর উপার্জনে মনোযোগী হয়ে পড়েছে স্থানীয় কৃষকরা। বন ঘেঁষা কৃষি জমি এখন পতিত। বনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে গিয়ে নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে। এহেন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক প্রভাবে রাতারগুলের অপার সম্ভাবনা এখন ম্লান।
রাতারগুল বনবিভাগের বিট কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বলেন, বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতিতে বনটির ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে একটি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও। তারা পর্যটকদের জন্য টিকেট পদ্ধতির জন্য সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। টিকেট পদ্ধতি শুরু হলে একটা দৃশ্যমান ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাতারগুল চলে আসবে বলে তার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, বিশাল এই বনটি দেখার জন্য বনবিভাগের মাত্র ৩ জন লোক। এছাড়া রাতারগুল বনে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল, অপচনশীল বর্জ্যরে সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। যা বনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট জেলা সভাপতি আবদুল করিম কিম জানান, বন বিভাগের অবহেলা ও নজরদারির অভাবে এই বনের অস্তিত্ব হুমকিতে। ‘ভ‚মি সন্তান বাংলাদেশ’ রাতারগুলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। সংগঠনটির সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, বনের অভ্যন্তরে ইকো ট্যুরিজম সৃষ্টি না করে বনকে কেন্দ্র করে তার পার্শ্ববর্তী এলাকার গ্রামীণ জনপদে বসবাসকারী জনগণকে সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারটি ভেবে দেখা দরকার।
সিলেট বিভাগীয় গণদাবী ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সুরক্ষায় মনোযোগী হলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে উঠতো। তারাই সরকারের নজরে সহজে দিতে পারতেন গণমানুষের চাহিদা ও বাস্তবায়নের সঠিক রূপ। রাতারগুলে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ, এ সম্পদ মানুষের জন্য। কিন্তু আমরা যে ব্যর্থ তার উদাহরণ রাতারগুল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন