মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পরিচালকের দুর্ণীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা অচলাবস্থায় নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ৫ মাস পরও বহাল তবিয়তে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নগর উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিককে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে কার্যতঃ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সংস্থাটিতে। ড. তৌফিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা আর অসদাচরণের অভিযোগ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন তারা। গঠিত হয়েছে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির আহবায়ক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ইমরুল চৌধুরীর কমিটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ড. তৌফিক অদক্ষ এবং তাকে পরিচালক পদে রেখে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তারপরও কেটে গেছে প্রায় ৫ মাস। কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে নিজ পদে ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের প্রশ্ন ড. তৌফিকের খুঁটির জোর কোথায়?
চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) তৌফিককে পরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেয়া হয় উপ-পরিচালকের পদে তারচেয়ে সিনিয়র ফারজানা সমীর উদ্দিনকে ডিঙিয়ে। ২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাকে পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে পদায়ন করা হয়। তবে তিনি চলতি দায়িত্বে থাকলেও কোথাও তা উল্লেখ করেন না। পূর্ণ পরিচালকের মতোই কাজ-কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নগর উন্নয়ন অধিদফতরে খামখেয়ালিপনা, কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টনে চরম স্বেচ্ছাচারী আচরণ, সিনিয়রদের অসম্মান করেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, অনিয়মের মাধ্যমে এবং সিনিয়রিটি লংঘনের মাধ্যমে পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি কোন নিয়মের তোয়াক্কা করেননি। নিজের বিশ^স্ত ও আস্থাভাজন বলেই পরিকল্পনা কর্মকর্তার সিনিয়রিটি তালিকায় ৫ নাম্বারে থাকা আক্তারুজ্জামানকে উপ-পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অপর একটি বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছেন ড. তৌফিক।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আইনের অজ্ঞতার জন্য তিনি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাদের ন্যায্য পাওনা থেকেও বঞ্চিত করছেন। সিএল, বিনোদন ছুটি, জিপিএফ লোন সবকিছুর ক্ষেত্রেই তিনি মনগড়া নিয়ম কানুনে পরিচালনা করেন। পদে পদে হেনস্তা করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ঘন ঘন বদলি আর পদায়নের মাধ্যমে সংস্থাটিতে এক আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছেন। আর দুর্নীতি বা আর্থিক ক্ষেত্রে তৌফিক কোন কিছুর তোয়াক্কা করেন না। জানা গেছে, তিনি একজন অনভিজ্ঞ ও জুনিয়র ব্যক্তিকে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা তৌফিকের সব দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের সহযোগী। চলমান সকল প্রকল্প ও রাজস্ব বাজেটের ছোট-বড় যে কোন পরিমান চেক থেকে তিনি শতকরা ১ শতাংশ হারে কেটে রাখেন। এছাড়া প্রিন্ট না করে এবং সফটওয়্যার না কিনে প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন ড. তৌফিক। নিজস্ব একটা দুর্নীতিবাজ বলয় তৈরি করে তিনি নিজের পকেট ভারী করছেন এবং তার দুর্নীতিতে সহায়তাকারী একটি ক্ষুদ্র অংশও এর ভাগ পাচ্ছে।
ড. তৌফিক নগর উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই এখানে কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে বিরূপ মনোভাব দেখাতে শুরু করেন। নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে তিনি অনেকটাই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। যতই দিন গড়িয়েছে ততই নিজের স্বরূপ প্রকাশ করতে থাকেন তিনি। আর তাই তৌফিকের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি আর অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে নগর উন্নয়ন অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা তৌফিকের অপসারণের দাবিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তারা। যদিও তৌফিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে মন্ত্রণালয়ে পাল্টা অভিযোগ করেছেন।
এদিকে, পাল্টাপাল্টি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত ১১ মার্চ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অডিট) মো. ইমরুল চৌধুরীকে আহŸায়ক এবং যুগ্মসচিব (প্রশাসন শাখা-২) মো. ইসমাইল হোসেন ও উপসচিব (প্রশাসন-৩ শাখা) কে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিকে ড. তৌফিকের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ তদন্ত করে ১০ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ২ মে ওই কমিটি সচিব বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. তৌফিককে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি, সরকার যোগ্য মনে করেই তাকে নিয়োগ দিয়েছে। জানা গেছে, তদন্ত কমিটির এ মতামতে নগর উন্নয়ন অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ড. তৌফিককে সিনিয়রটি লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, ‘সিনিয়রিটি লঙ্ঘন’ অবশ্যই সাধারণ প্রথার লঙ্ঘন। কমিটির কাছে শতকরা ১ ভাগ টাকা কেটে রাখার বিষয়টি ড. তৌফিক অস্বীকার করেননি, তিনি জানিয়েছেন অফিসের নানাবিধ খরচ মেটাতে তিনি এ অর্থ রাখতেন। তদন্ত কমিটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে শতকরা ১ টাকা গ্রহণ করার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া একাই তিনটি গাড়ি ব্যবহার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানিমূলক বদলি, কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপের অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়েছে বলেও জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাছাড়া তদন্ত কমিটি ড. তৌফিকের ব্যক্তিগত ব্যবহার, আচার-আচরণ, ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গালিগালাজ করার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছে, একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরণের ভাষা কাম্য নয়।
কমিটি বলেছে, অধিদফতরে ১৪০/১৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত, তাদের মধ্যে ১০১জনই পরিচালকের বিরুদ্ধে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন। তারা পরিচালকের বিরুদ্ধে মিছিল করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় যে, নগর উন্নয়ন অধিদফতরে পরিচালকের সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। কমিটি আরো বলেছে, এই সমস্যাটি মূলতঃ পরিচালকের আচরণগত কারণে তৈরি হয়েছে। ড. তৌফিকের দক্ষতার অভাব রয়েছে বলেও সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। সবশেষে কমিটি ষ্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে ড. তৌফিককে তার পদে বহাল রেখে নগর উন্নয়ন অধিদফতরের কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নগর উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক ড. তৌফিককে অদক্ষ হিসেবে বলেছে তদন্ত কমিটি। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে ড. তৌফিককে সরিয়ে শিগগিরিই একজন দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে এর দায়িত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন নগর উন্নয়ন অধিদফতরের কর্মরতরা।
ড. খুরশীদ জাবিন হোসেন তৌফিক বলেন, তদন্ত কমিটি আমার কাছে এসেছিল। আমার বক্তব্য নিয়েছে, অন্যদের বক্তব্যও নিয়েছে। তবে পরবর্তীতে এ সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিবেদন আমার কাছে আসেনি।
তদন্ত কমিটির প্রতিবিদেন ও নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালকের অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে জানতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন