শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

হজে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজনীয়তা

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। (দেখুন: সহিহ বুখারি, হাদিস নং ) অনন্য এ ইবাদতটি তাদের উপর ফরজ যাদের সামর্থ আছে। (দেখুন: আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭) সামর্থ আছে শারিরিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে। কারণ, এ দুটির সমন্বয়ে এ ইবাদতটি সম্পন্ন করা যায়। এ ইবাদতটিতে এমন কিছু কর্তব্য পালন আবশ্যকীয় যা শারিরিক সামর্থবান ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষ্যে করা সত্যিই দুষ্কর। তাই অর্থের সাথে শারিরিক সামর্থ থাকার বিষয়টিকে শর্তারোপ করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, প্রতি বছর প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ হজ পালন করে থাকে। আমাদের দেশ থেকে যারা হজে গমন করেন তারা ১৫ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত তাদের এ যাত্রা দির্ঘায়িত হয়। অধিকাংশই প্রায় ৪৫ দিনের অভিযাত্রা করে থাকেন। এ দিনগুলোর মধ্যে ৫ দিন থাকে যা মূল হজের কার্যক্রমের জন্যে নির্ধারিত। সেকাজগুলো সম্পন্ন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। কারণ, নির্দিষ্ট নিয়ম শুধু নয় এত সংখ্যক মানুষকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। না হলে, হজ আদায় হবে না। যেমন, ৯ তারিখের পূর্ণদিন আরাফাতের মাঠে অবস্থান করা, এদিনগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা, এবং তদপরবর্তী কয়েকদিন মিনার তাবুতে অবস্থান পূর্বক জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করা। প্রচÐ গরমের মধ্যে পাহাড়ী রাস্তায় হাটতে হয় বেশ অনেক পথ। উল্লেখযোগ্য ছায়া নেই, নেই বাসা-বাড়ির মতো আরামদায়ক ঘর বা বিছানা। সাথে যোগ হয় খবারের ভিন্নতা। ফলে, একধরণের কষ্টের মধ্যে ¯্রষ্টার প্রতি নিজের ভালবাসাকে প্রমাণ করতে হয়। আমাদের দেশ থেকে যেসব ব্যক্তি হজ করতে যান, তাদেরকে নূন্যতম তিন লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়। অনেকের জন্যে এ টাকাটা ব্যয় করা কষ্টসাধ্য যেমন হয় তেমনি এতগুলো টাকা একসাথে খরচের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে এক ধরণের মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অর্থ ও কষ্ট একাকার হয়ে, নতুন পরিবেশের ভিন্নতায় কিছু সমস্যা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হজের সময় বিভিন্ন কারণে, আচরণ, মানসিকতা এবং ঘুমের উপর যথাক্রমে ৬৫%, ৬৩% এবং ৫৯% বিরুপ প্রভাব পড়ে। এমনকি শারিরীক অসুস্থার খবরও পাওয়া যায় প্রায় ২৮% শতাংশ রেগিদের যারা নিকটস্থ কোন চিকিৎসা কেন্দ্রে তাদের সমস্যা নিয়ে যান। বিভিন্ন শারিরীক সমস্যা নিয়ে যারা হাসপাতালে যান তাদের মধ্যে প্রায় ৩৪% মানসিক সমস্যায় ভুগেন। ফলে, প্রায় ৭৯% রোগিদেরকে বিভিন্ন ঔষধ দেয়া হয় এবং ৬.৫% রোগীদেরকে কাউন্সিলিং করা হয়।” (সূত্র: : https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/17953234) ) ২০১৬ সালের অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১২% রোগীদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল তাদের মানসিক সমস্যার কারণে। তার মধ্যে ৯৩.২% রোগির আগে কখনও মানসিক সমস্যা ছিলনা বলে জানা যায়। তাছাড়া মানসিক অবসন্নতা প্রায় ৪৫.৭% রোগীদের, ইনসোমনিয়া বা ঘুম না আসার সমস্যা প্রায় ৭.৩% এবং কিছুই ভাল লাগেনা এমন সমস্যা প্রায় ৫.৬% হাজীদের। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5479097/)

যেসব কারণে এরকম সমস্যার সৃষ্টি হয় তা হলো: (১) হজ এবং এর আনুসঙ্গিক কার্যাবলীর কষ্ট সম্পর্কে আগেই ধারণা না থাকা, (২) হজ এবং এ সংক্রান্ত বেশ কিছু অর্থ একসাথে খরচ করা বিশেষ করে হজ থেকে ফেরার পরে আত্মীয়-স্বজনদেরকে বিভিন্ন উপহার-উপঢৌকন দেয়া কেন্দ্রিক খরচের চিন্তা, (৩) আত্মবিশ্বাসের অভাব বিশেষ করে একটু বেশি বয়সী হাজিদের মধ্যে এটি লক্ষ্য করা যায় যে, তারা সব কার্যক্রম ঠিকমত করতে পারবে তো? (৪) শারিরীক দূর্বলতা কিংবা অসুস্থতা, (৫) হজের সময়ে আবাসন ব্যবস্থা। যেহেতু এত অধিক সংখ্যক লোক একই সাথে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে হয় তা চাহিদা মত আবাসন পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, (৬) খাবার। বিশেষ করে, সেখানের খাবারের ভিন্নতা এবং অনেক সময় স্বাদের ভিন্নতাও এক ধরণের অসস্থিতে ফেলে দেয় অনেককে, (৭) ভিন্ন আবহাওয়া। সেখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত গরম বিশেষ করে আরাফার মাঠে এবং মিনায় অবস্থানকালীণ সময়ের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেয়া অনেকের জন্যে কষ্টের হয়ে উঠে, (৮) হোটেল কিংবা তাবুতে এবং হজের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদনের সময়ে অন্যদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা, (৯) হারিয়ে যাওয়া, টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তা এমনকি নিজের জীবন হারানোরও দুশ্চিন্তা, (১০) সন্দেহ, সংশয়, অপ্রাসংগিক কথা-বার্তা, আলোচনা-সমালোচনা, ভীতি সন্ত্রস্থ হওয়া, অন্যের দ্বারা ঘুমের বিঘœ হওয়া এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা, (১১) সর্বোপরি, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি টান এবং তাদেরকে ছেড়ে থাকার জন্যে নিজেকে নিঃস্বঙ্গ মনে করা। এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তোরণের জন্যে এবং হজের সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে সর্বোচ্ছ পুরুষ্কার হজে মাবরুর পাবার জন্যে যেসকল কাজ করা যেতে পারে তার অন্যতম হলো: (১) আগে থেকে কোন অভিজ্ঞজনের দ্বারা হজের যাত্রার শুরু থেকে বাসায় ফেরা পর্যন্ত সকল বিষয়ে খুটিনাটি জেনে নেয়া, (২) হজের সময়ে সকল প্রতিক‚লতাকে মেনে নেয়া এবং তা উত্তোরণের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রস্তুতি এবং দৃঢ়তা তৈরি করা, (৩) এটা মনে করা যে, যে সকল প্রতিক‚লতার স্বীকার হতে হবে তা হয়ত আল্লাহর পক্ষ্য থেকে পরীক্ষা সুতরাং সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে এমন মানসিক প্রস্তুতি নেয়া, (৪) যত কঠিন পরিস্থিতি হোকনা কেন সেখানে ধৈর্যধারণ করা কারণ এগুলোতে আল্লাহর বিশেষ পুরুস্কার নিহীত আছে (দেখুন: আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ১৫৫), (৫) অন্যের প্রতি সদয় এবং সহিষ্ণু হওয়া এ মনে করে যে, অন্যরা কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং পরিস্থিতি থেকে এসেছে। সুতরাং সবাই আপনার মতো নাও হতে পারে, (৬) সাহায্য প্রত্যাশীদেরকে নিজ উদ্যোগে সহযোগিতা করা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহযোগিতা হলেও তা আপনার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করবে, (৭) সমস্যা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি অন্যান্যদের সাথে শেয়ার করা যাদের উপর আপনি ভরসা করতে পারেন, বা যাদের সাথে আপনার কথা বলতে ভাল লাগে। এমনকি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেও অজানা বিষয়গুলো জেনে নেয়া এটি শুধু আপনার মধ্যে ভাললাগা অনুভ‚তি তৈরি করবে না বরং আপনার একাকিত্বকেও দূরে ঠেলে দিতে সহায়তা করবে, (৮) হজের বিশেষ কার্যক্রমের মধ্যে ছাড়া অন্যান্য সময়গুলোতে দেশে কিংবা ওখানের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, খোঁজ খবর রাখা। সম্ভব হলে, আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করা। এমন হতে পারে আপনার কোন আত্মীয় হয়ত অন্য কোন কাফেলায় হজ পালন করছে, ভিন্ন হোটেলে, তাবুতে থাকে। সময় করে তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করুন। একসাথে কার্যক্রমগুলো পালন করার চেষ্টা করুন। সত্যিই মানসিক শক্তি ফিরে পাবেন। মনেই হবে না আপনি ভিনদেশে আছেন। (৯) দেশে রেখে যাওয়া পরিবার পরিজনের চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর উপার সপে দিন। এমনকি অনেকেই সামাজিক, ব্যবসায়িক কিংবা পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়েও ওখানে বসে চিন্তা করেন। বাদ দিন এগুলো। সবকিছুই আল্লাহর উপর ছেড়ে দিন। নিজেকে হালকা মনে হবে, ইনশাআল্লাহ। এবং (১০) সবসময় মনে করুন যে, মাবরুর বা কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (দেখুন, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪১১) সুতরাং মাত্র এই কয়েকটি দিন যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সকল কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করতে পারেন তাহলে মু’মিন জীবনের একমাত্র কাম্য জান্নাত নিশ্চিত। এটি সার্বক্ষনিক স্মরণ রাখার চেষ্টা করবে। শক্তি পাবেন।

আমাদের পরামর্শ হলো, সরকার কিংবা হজের এজেন্সিগুলো উপরোক্ত বিষয়গলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে হজে গমনেচ্ছুকদেরকে অবহিত করতে পারেন তাহলে তারা আগে থেকেই এসব বিষয়ে সচেতন হয়ে শারিরীক-মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবেন। যা সত্যিকার অর্থেই তাদের হজকে মাবরুর হজে পরিণত করতে সহায়তা করবে। সত্যি বলতে কী, অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, আমাদের অনেকেই ঢাকার হাজি ক্যাম্প থেকেই বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন, মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এটি নিশ্চিতভাবে একধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তখন পুরো যাত্রাটাই কিন্তু কষ্টের হয়ে উঠে। সুতরাং ভাল ব্যবস্থাপনা বাড়ি থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত; এজেন্সি হোক, সরকারের হোক, বিমান কতৃপর্ক্ষ হোক কিংবা সৌদি আরবেন আবাসন, যানবাহন, ও খাদ্যের হোক, সত্যিকার অর্থেই মানসিক দৃঢ়তা তৈরির পাশাপশি বিভিন্ন ধরণের অসুবিধা থেকে হাজিদেরকে মুক্তি রেখে হজের সর্বোচ্চ প্রতিদান পেতে সহায়ক বলে আমরা বিশ্বাস করি। এটি একজন হাজির মূল চাওয়া-পাওয়াও। আল্লাহ আমাদের সকল ভালকাজ গুলোকে ত্রæটিমুক্ত করে কবুল ও মঞ্জুর করুন। আমিন।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন