৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ এবং বিশ্বদরবারে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত ঢাকায় ক্যাসিনো খেলা চলেছে প্রকাশ্যে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের রথি-মহারথিরা এই খেলায় যুক্ত থাকায় কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি। কারা ক্যাসিনোর স¤্রাট, কারা কারা ক্যাসিনো খেলা আমদানি করেছেন, কারা টাকার ভাগ পেতেন তা এখন ওপেন সিক্রেট। সব তথ্য-উপাত্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তারপরও ক্যাসিনোর গডফাদাররা অধরা। রাজধানীর বিভিন্ন ক্যাসিনোতে র্যাব-পুলিশের একের পর এক অভিযানে যুবলীগ, কৃষক লীগের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অভিযান চলছে, কিন্তু যারা ক্যাসিনোর মূল হোতা সেই খলনায়করা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এই শুদ্ধি অভিযান কি দুদকের মতোই একচোখা হবে, নাকি অভিযান চলবে। অবশ্য আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে এলেই রাঘব বোয়ালদের গ্রেফতারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে তথা সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত অভিযান শুরু হবে।
মতিঝিলের ক্লাবগুলোর ক্যাসিনোতে কারা যান সে তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ক্যাসিনো খেলার ভিডিও ফুটেজে অনেক চেহারাই ভেসে উঠেছে। এ ছাড়া অভিযানের সময় র্যাব ও পুলিশ ক্লাবগুলো থেকে যে কাগজপত্র জব্দ করেছেন, তাতেও অনেকের নাম রয়েছে। মিডিয়ায় এমন খবরও প্রকাশ হয়েছে, গ্রেফতার এড়াতে ক্যাসিনোর খলনায়করা শত শত নেতাকর্মীর প্রহরায় দুই-তিন দিন অফিসে অবস্থান করেন। পরবর্তী খবর দিরুদ্দেশ!
ক্যাসিনো খলনায়ক হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদসহ কয়েকজন দেশের বাইরে গেছেন। অভিযান শুরুর কারণে তারা দেশে ফিরছেন না। মমিনুল ওয়ান্ডারার্সসহ অন্তত চারটি ক্লাবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তিনি দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন স¤্রাটের আস্থাভাজন। ইসমাইল হোসেন স¤্রাট ও খালেদ ছাড়াও কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, যুবলীগ নেতা মেহরাব হোসেন স্বপন, গাজী সারওয়ার হোসেন বাবু, খায়রুল, উজ্জ্বল, জামান, মুরসালিন, মনির হোসেন, রানা, শাহাদাত হোসেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান উদ্দিন জামাল, ইমরান, তসলিম, জসীম উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া ভিডিওতে অনেক ক্যাসিনো ম্যানের নাম রয়েছে। আরো ক্যাসিনো এক্সপার্ট হিসেবে নেপালের দীনেশ মানালী, রাজকুমার বিনোদ মানালী, অজয় পাকরাল, হিলমিসহ অর্ধশত বিদেশির নাম রয়েছে। তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গ্রেফতার অতঃপর আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোর খলনায়ক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ক্যাসিনোর আদ্যোপান্তের বর্ণনা দিয়েছেন। রাজধানীর ক্লাবগুলোর ক্যাসিনো কারবারির চিত্র তুলে ধরে খালেদ বলেন, ‘স্যার, ধরা যখন পড়েছি, তখন আর চুপ থেকে ফায়দা কী। আমি সব বলব। কিন্তু আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কইরেন না। আমি একা দোষী নই। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাট ছাড়া কিভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা হয়? কাউসার ও সাঈদও আমার সহযোগী। জি কে শামীমও এই কারবারে জড়িত। ক্যাসিনো মানে জুয়া খেলা। এখানে কাঁচা টাকা। শত শত কোটি টাকার খেলা। কাঁচা টাকা পেলে তহন (তখন) সবাই হাত পাইতা দেয়। এই টাকার ভাগ পুলিশকে দিছি। পুলিশের বড় বড় স্যাররা নিছে। আমি যুবলীগের নেতা ছিলাম। সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল। তাদের ধরেন। দেখবেন দেশে আর কেউ ক্যাসিনো কারবার করতে পারবে না।’
খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার এই স্বীকারোক্তিতে বিব্রতবোধ করছেন জিজ্ঞাসাবাদকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, খালেদের তথ্যে ফেঁসে যেতে পারেন পুলিশ সদর দপ্তর ও মহানগর সদর দপ্তরের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে অনেক শীর্ষ কর্তা। মহানগরের মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা বিভাগের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও ফেঁসে যেতে পারেন। জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাটকেই ক্যাসিনো কারবারের ‘গডফাদার’ দাবি করেছেন খালেদ। এর বাইরে যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতার নামসহ ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনেকের নাম বলেছেন খালেদ।
জানা গেছে, খালেদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য মামলার তদারক কর্মকর্তার কাছে জানতে পেরে বিব্রত ডিএমপি কমিশনার গত শনিবার অপরাধবিষয়ক বিশেষ সভা ডাকেন। এই বৈঠকে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগের ডিসি ও থানার ওসিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রাজধানীতে আর কোনো ক্যাসিনো কারবার যাতে না চলতে পারে সে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে ক্যাসিনো কারবারিদের কাছ থেকে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সুবিধা নিয়েছেন তাদের বিষয়ে কার কাছে কী ধরনের তথ্য আছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ডিএমপি কমিশনার বৈঠকে বলেছেন, এখন থেকে ঢাকাতে কোনো ক্যাসিনো কারবার বা জুয়ার আসর চলবে না। জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীর ক্যাসিনোগুলো চলার সময় পুলিশের কোনো সহযোগিতা ছিল কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
খালেদের গ্রæপে ২০ জন
যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অন্তত ২০ জনের নাম পেয়েছে ডিবি। এরই মধ্য তারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাসিনো কারবারে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে অন্তত ২০ জন ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন গোড়ান এলাকার কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, যুবলীগ দক্ষিণের সদস্য খায়রুল, উজ্জ্বল রাজু, রইসসহ আরো অনেকে। এরা তাকে মতিঝিলের শাহজাহানপুর এলাকায় চাঁদাবাজির পাশাপাশি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন।’
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খালেদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছি। কিন্তু তাদের কেউই এলাকায় নেই।’
গ্রেফতারের পর বহিষ্কৃত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদকে তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী স¤্রাটই ক্যাসিনোর আসল রূপকার এবং খলনায়ক। তার হাত ধরেই ঢাকার মতিঝিল থানার বিভিন্ন এলাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলোয় ‘হাউজি’ আসরকে ক্যাসিনোতে রূপান্তর করা হয়। এ কাজে স¤্রাটের সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পান খালেদ। এসব ক্লাবের ক্যাসিনোতে খেলা এবং সেগুলো পরিচালনায় যুক্ত হন আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ, ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণের যুবলীগ সহ-সভাপতি আরমান, সহ-সভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী সরোয়ার হোসেন বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ, সহ-সভাপতি মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা, রানা, শফি মনির হোসেন ক্যাসিনো কারবারসহ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। খালেদ আরো জানায়, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করতেন। বাকিগুলো সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ক্যাসিনোর টাকা বিদেশে কিভাবে পাঠানো হতো সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ বলেছেন, স¤্রাট গত কয়েক বছরে ক্যাসিনো কারবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে নেপাল থেকে এক্সপার্ট এনেছিলেন। তাদের মধ্যে ১১ জন ঢাকার ক্যাসিনো কারবার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন। স¤্রাট সিঙ্গাপুর গিয়ে ক্যাসিনোয় জুয়া খেলায় অংশ নিতেন। তিনি দেশের অনেক টাকা পাচার করেছেন।
খালেদ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির সন্ত্রাসী নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তার ও স¤্রাটের একসময় সুসম্পর্ক ছিল। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর টাকা ওমানের মাসকটে থাকা সন্ত্রাসী নাদিমের কাছে পাঠাতেন তারা। সেখান থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও ভাগ পেত। জিসান বর্তমানে ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাইয়ে বাস করছে। জিসানের সঙ্গে জি কে শামীমেরও সম্পর্ক ছিল। তবে একপর্যায়ে জিসানের সঙ্গে তার ও স¤্রাটের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। আর এর জন্য জি কে শামীম দায়ী। কারণ জি কে শামীম তার টেন্ডার কারবার নিয়ন্ত্রণে এক সময় জিসানকে হাত করেন। খালেদ জানিয়েছেন, ২০১৬ সাল থেকে ঢাকায় তারা ক্যাসিনো কালচার শুরু করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন