শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পরিবর্তনের প্রত্যাশা এবং একান্ত কিছু কথা

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশে সেনাবাহিনী থেকে অকালীন অবসরে যাওয়ার পূর্বেকার ৯ দিন তথা সেনাবাহিনীতে চাকরি জীবনের সর্বশেষ ৯ দিন ছিলাম ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ (বিআইআইএসএস)-এর মহাপরিচালক। আমার তৎকালীন মেধা ও মননের সাথে এই দায়িত্ব ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই অবসরের পর এলপিআরের ১২ মাস শেষ হওয়ার পরই ‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলাম। বেসামরিক জগতে তথা সুশীলসমাজে অর্থাৎ ঢাকা মহানগরের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে চলাচল শেখার আগ্রহ নিয়ে হয়েছিলাম ওই প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক। আর নির্বাহী পরিচালক হয়েছিলেন কুমিল্লা জেলার পয়ালগাছার জমিদার বাড়ির সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমার ক্লাসফ্রেন্ড এবং বিআইডিএস নামক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুপরিচিত জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. ওসমান হায়দার চৌধুরী। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি টেকেনি। ১৯৯৯ সালের শুরু থেকেই গড়ে তুলেছিলাম ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ’ (সিএসপিএস) নামক প্রতিষ্ঠান। এটা ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইআইএসএস-এর আদলে গড়া। এটার লক্ষ্য ছিল বেসামরিক জগতে তথা প্রাইভেট সেক্টরে বিআইএসএস-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। চার বছর দুই মাস সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছি, কিন্তু বিবিধ কারণে প্রতিষ্ঠানটি বনসাইকৃত গাছের মতো ক্ষুদ্র অবয়বেই থেকে গিয়েছিল; এখন আছে জীবন্মৃত অবস্থায়। একই সাথে ২০০০ থেকে ২০০৩ সালে ‘সোসাইটি ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার’ (সংক্ষেপে সোহাক) নামক একটি এনজিওর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ওই সোহাক-এর প্রধান কর্মসূচি ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা আবিষ্কার এবং আর্সেনিক আক্রান্ত জনমানুষের কষ্ট লাঘব তথা আর্সেনিক-মিটিগেশন এবং মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা ও সীমিতভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ। ২০০৩ সালের এপ্রিল-মে মাস থেকে পরবর্তী আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করেছি আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে। এর নাম দীর্ঘ: ‘ইসলামিক ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড প্রোপাগেশন অব দি টিচিংস অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)’; এটার পরিচিতি ছিল ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিসেবে; প্রতিষ্ঠানটি এখনো সগৌরবে কর্মব্যস্ত আছে। এটি সংগঠিত করা বা প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ ছিলেন (মরহুম) আহমদ শফি মাকসুদ নামক একজন সুফিবাদী ব্যক্তিত্ব; আমি ছিলাম সহায়ক। ১৯৯৯ সাল থেকে নিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ১৯ বা ২০ বার বিভিন্ন ধরনের সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে যাতায়াত করেছি এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিভিন্ন আঙ্গিকের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হয়েছি। এরূপ সফরের মধ্যে কাঠমান্ডু, নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ, জাকার্তা, কুয়ালালামপুর, কলম্বো, ইরাক, জার্মানি ইত্যাদি শহর বা দেশ উল্লেখযোগ্য। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি। ইতোমধ্যে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাস থেকেই পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছি এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন আলোচনা সভা বা সেমিনার ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা শুরু করি, যে কাজগুলো আজো চলছে। ২০০৩ সালের মার্চে যখন আমেরিকা কুয়েত বা ইরাক আক্রমণ করে, তখন থেকেই টেলিভিশনে টকশোতে অংশগ্রহণ করা শুরু করি যা আজ অবধি চলছে। এসব বুদ্ধিবৃত্তিক বা দেশ গঠনমূলক কাজের পাশাপাশি, হালকাভাবে বিবিধ প্রকৃতির ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা কর্মের সাথেও জড়িত থেকেছি। যেটা এখনো বলা হয়নি সেটা হলো, এলপিআর শেষ হওয়ার সাত দিন পর থেকেই বাংলাদেশের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশের সাথে ওতপ্রোতভাবে মেলামেশার সুযোগ পাওয়া মাত্রই গ্রহণ করেছিলাম এবং তা অব্যাহত রেখেছি। বলাই বাহুল্য, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষমতাসীন সরকারপন্থী এবং বিরোধীদলপন্থী এভাবে বিভক্ত হলেও তারা পরস্পরের আত্মার বন্ধু।

সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় সামরিক বাহিনীগুলোকে বুঝেছি ও চিনেছি। জাতীয় নিরাপত্তার অনেকগুলো আঙ্গিকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকটি চর্চা করেছি। এক বছর ইংল্যান্ডে এবং এক বছর আমেরিকায় উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের সুবাদে আন্তর্জাতিক সামরিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক চিন্তাচেতনার সাথে সুপরিচিত হয়েছি। পেশাগত জীবনের একদম শুরুর বছরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে বেসামরিক জগতের সাথে তথা দেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতি ও আত্মার সাথে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, সে সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছিলাম সামরিক বাহিনীর চাকরিতে থাকার সুবাদে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত কর্মকা-ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মন ও আত্মাকে গভীরভাবে চেনা অথবা সমাজের উচ্চস্তরের বুদ্ধির জগতের মানুষের মান ও আত্মাকে গভীরভাবে চেনার জন্য যথেষ্ট সুযোগ সামরিক জীবনে ছিল না। অতএব, অবসর জীবনে আমার অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের মানুষের অনুভূতি ও আত্মার সাথে পরিচিত হওয়া। সে সুযোগটি অবসর জীবনের প্রথম দশকে পেয়েছি।

কথা বলা মানে, শুধু রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ভাষণ দেয়া নয়। কথা বলা মানে, টেলিভিশনে বলা, সভা-সমিতিতে বলা, মঞ্চে বলা এবং পত্রিকায় কলাম লেখা। কথা বললে কেউ না কেউ আপনাকে পছন্দ করবেন, আবার কেউ না কেউ আপনাকে অপছন্দ করবেন। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বলেন, তাহলে ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপের মানুষ আপনাকে দারুণভাবে অপছন্দ করবেন। আপনি যদি দেশের স্বার্থের কথা বলেন, সাধারণ মানুষ আপনাকে পছন্দ করবেন, কিন্তু ক্ষমতার বারান্দায় যারা পদচারণা করেন, তারা আপনাকে পছন্দ করবেন না। চরম সত্য হলো, আপনি যদি মহান আল্লাহকে ভয় করেন তাহলে আপনাকে সত্য কথাই বলতে হবে, তথা বাস্তবতাকে তুলে ধরতে হবে, চাটুকারিতা থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহকে ভয় করলে সত্য কথা বলতে না পারলেও অন্তত অসত্য কথাটি বলা যাবে না। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো, তৃতীয় বিশ্বের তথা দক্ষিণ এশিয়ার তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে চাটুকারিতা একটি ‘উজ্জ্বল’ বৈশিষ্ট্য এবং রাজনীতিতে অগ্রগতির জন্য এ অপকর্মটিতে দক্ষতা থাকা প্রয়োজন! তৃতীয় বিশ্বের তথা দক্ষিণ এশিয়ার তথা বাংলাদেশের রাজনীতির উচ্চ পদস্থরা নগ্ন-সত্য পছন্দ করেন না। অথচ আপনি কথা বললে, নগ্ন-সত্য না বললেও পরিশীলিত সত্য কথা তো বলতেই হবে; তা না হলে মানুষই আপনাকে গালি দেবে। অতএব উপসংহার হলো, আপনাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে; যথা: আপনি কি কথা বলবেন, নাকি কথা বলবেন না? আপনি কথা না বললে কেউ আপনার সমালোচনা করবে না; একটি প্রবাদ আছে, ‘বোবার কোনো শত্রু নেই।’ কথা না বললে, ‘আপনি ভরা কলসি না খালি কলসি’ এটা কেউ টের পাবে না; আপনি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে ভরা কলসির মেকি ভাব প্রদর্শন করতে পারবেন। রাজনীতি করতে গেলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চাটুকারিতার সাথে যে বৈশিষ্ট্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং যার অভ্যাস করা হয় সেটির নাম ‘কপটতা’। কিন্তু আমি কথা বলতাম। কথা বলা যদি দোষের হয়েই থাকে, তাহলে সেই দোষ অনেক দিন ধরেই করে যাচ্ছি; ১৯৯৭ সালের জুলাই মাস থেকেই করে আসছি। সাধারণত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের সাথে বেসামরিক জগতের ব্যক্তিদের ইন্টারঅ্যাকশন খুবই সীমিত হতো। ‘বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ’ বলতেই বেসামরিক জগতের বুদ্ধিজীবীদের কাজ বলে মনে করা হতো। এ রকম পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তির নিজের জন্য একটু জায়গা করে নিতে নিশ্চয়ই পরিশ্রম করতে হয়েছে। ওই পরিশ্রম শুরু করেছিলাম ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে, যেটার এক দশক পূর্তি হয়েছিল ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্মের সময়; দ্বিতীয় দশক পূর্তি হয়েছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের সময়। এখন তৃতীয় দশকের প্রারম্ভে আছি। গভীর চিন্তার সময়, কোন পথে হেঁটে এসেছি, কোন পথে আগামীতে হাঁটব?

কল্যাণ পার্টি একটি মহৎ লক্ষ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছিল, তা হলো- একটি কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে অবদান রাখা। এটা করতে গেলেই আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তন আনতে হতো এবং হবে। তাই কল্যাণ পার্টির নীতিবাক্য বা মটো নির্ধারিত হয়েছিল: ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে অংশগ্রহণ করেছি। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন প্রাপ্তির মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মাথায় সে নির্বাচন হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন ধানের শীষ এবং নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। নির্বাচনী উদ্দেশ্যে টাকা-পয়সার প্রাপ্তি ও ব্যবহার, প্রার্থীর পরিচিতি ইত্যাদি সব দিকে আমরা দুর্বল ছিলাম। ফলে স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে আমরা সবগুলো আসনে পরাজিত হয়েছিলাম; কিন্তু পেয়েছি নির্বাচনী অভিজ্ঞতা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন-পরবর্তী পৌনে তিন বছর কল্যাণ পার্টি স্বতন্ত্র পথে অগ্রসরমান ছিল। কিন্তু কঠিন পথ; বড় বড় দলগুলোর ছায়ার বাইরে ক্ষুদ্র দলের বেড়ে ওঠা কষ্টকর বৈকি! ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারিত করার এবং ওই প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৮ এপ্রিল ২০১২ সালে। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে কেন এ জোট অংশগ্রহণ করেনি, সেই দীর্ঘ অপ্রিয় আলোচনার জায়গা এ কলামে নেই।

জোটের অংশীদার হিসেবে, জোটের সব কর্মকা-ে, পদযাত্রা, রোডমার্চ, অনশন ও অবস্থান ধর্মঘট, মিছিল, হরতাল, জোটের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা ইত্যাদিতে কল্যাণ পার্টি অংশ নিয়েছিল। পার্টির চেয়ারম্যান মিডিয়াবান্ধব হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জোটের পক্ষে, বিএনপির পক্ষে, শহীদ জিয়ার পক্ষে, রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, দেশনেত্রী বেগম জিয়ার পক্ষে সব সময়ই সোচ্চার থেকেছে। এ সব কিছুর মাধ্যমে জোট যেমন উপকৃত হয়েছে, কল্যাণ পার্টিও উপকৃত হয়েছে। ১৪ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগে, রাজনৈতিক আনুগত্য পরিবর্তন করে, সুবিধাজনক জোটে বা সুবিধাজনক অবস্থানে যাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব কল্যাণ পার্টি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর পরের চার বছরের ইতিহাস এখনো পুরনো হয়ে যায়নি। বিশেষ করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের ছয় মাসের কর্মকা- মানুষের স্মৃতিতে অতি উজ্জ্বল। এক দিকে, পুনরায় লোভনীয় প্রস্তাব; রাজনৈতিক আনুগত্য বদলানোর জন্য। অপর দিকে, সাত বছরের পুরনো সঙ্গী ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামক রাজনৈতিক জোট সৃষ্টির প্রয়াস। ওই প্রয়াসের যাত্রাপথ মানুষের চোখের সামনে ভাসছে। ২০ দলীয় জোটের সাথে নির্বাচনী আসন বণ্টন নিয়ে কোনোরূপ আলোচনা হয়নি; কল্যাণ পার্টি একটির বেশি আসন প্রাপ্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রধান শরিকের আন্তরিক মনোযোগ পায়নি; এ রকম দল ছিল আরো। ফলে শুধু কল্যাণ পার্টি নয়, বিবিধ কারণে ২০ দলীয় জোটের আরো অনেক দল, নিজেদেরকে অবহেলিত ও বঞ্চিত মনে করে। অবহেলা ও বঞ্চনা শুধু নির্বাচনের আসন প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে নয়; আরো বহু বিষয় আছে, যেগুলো আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে আলোচনা করা প্রয়োজন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়ন পাওয়া এবং সফলভাবে পার্লামেন্টে পৌঁছা, দু’টিই কঠিন প্রক্রিয়া। এর সাথে দলীয় লক্ষ্য অর্জনের সম্পর্ক আছে। অতএব, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন-পরবর্তী মাসগুলোতে, জোটের শরিক দলগুলোর সামনে একটি অনিবার্য প্রশ্ন আসে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সামনেও ওইরূপ প্রশ্ন আসে। দেশের স্বার্থ, জোটের স্বার্থ, দলের স্বার্থ, দলীয় লক্ষ্য অর্জন- সব কিছুর সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হচ্ছে বাস্তবতা। সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। সিদ্ধান্তহীনতা রাজনীতিতে ক্ষতিকর। দোদুল্যমান থাকা ইতিবাচক নয়। তবে গৃহীত সিদ্ধান্ত কোন সময় প্রকাশ করা হবে বা আদৌ প্রকাশ করা হবে কি না, এটা নির্ভর করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতার ওপর।

পার্লামেন্টে যেতে হবে। একা গেলে চলবে না, সমমনা দু’চার-দশ-বিশজন না থাকলে কণ্ঠটি অত্যন্ত ¤্রয়িমাণ থাকবে। পরিবর্তন আনতে হলে লাগবে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। পরিবর্তন আনতে হলে ব্যতিক্রমী চিন্তাগুলোর জন্য সাহসী প্রকাশ দরকার এবং পরিবর্তনের জন্য চিন্তা করার মোক্ষম সময় কোনটি; আজ না আগামীকাল নাকি পরশু, এটা নির্ধারণ করার জন্য বিচক্ষণতা প্রয়োজন। গত ১০-১১ বছর ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বর্ণালী দেশটির পরিচালনায় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অনেক সন্তুষ্টি আছে, অনেক প্রশ্ন আছে, অনেক বিতর্ক আছে। শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যক্তি ও সামাজিক নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামষ্টিক মূল্যবোধ ইত্যাদিকে বলিদান করা হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাহানায় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির বাহানায়। এক দশক ধরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বড় অঙ্গনটি হচ্ছে ভৌত কাঠামোর জগৎ। সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধির চেষ্টাও দৃশ্যমান। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে দুর্নীতি। সমগ্র বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাশ-বাতাস, দুর্নীতির বিষাক্ত হাওয়ায় কলুষিত। যেহেতু দুর্নীতি উচ্চপর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, তাই শাসকগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ এখন ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনের মতোই ‘নিষ্ঠার সাথে’ দুর্নীতি করায় লিপ্ত। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দযুগলের অতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দটির দ্যোতনা করা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পূর্ণভাবে ভূলুণ্ঠিত। বাংলাদেশ এখন নির্বাচনী একনায়কত্ব বা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার পথে ধাবমান। দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের বিনিময়ে, শাসক রাজনৈতিক দল, অকাতরে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে গত এক দশকে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নেতৃত্বের গুণগত পরিবর্তন এবং সমষ্টিগত পরিবর্তন জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মতোই প্রয়োজন। এই পরিবর্তনের সংগ্রামে আমাদের শরিক থাকা প্রয়োজন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন