শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিএনপি এমপিদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যু

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রাজপথের আন্দোলনে পাওয়া ‘আপোষহীন’ নেত্রীর খেতাব তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রেখেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, দেশবিরোধী কোন প্রস্তাবে ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেন না বলেই নেতাকর্মীরা তাকে এই উপাধিতে সম্বোধন করতে গর্ববোধ করেন। কিন্তু হঠাৎ করে তার সেই অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং বিতর্কিত করতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত বিএনপির এমপিরা মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন বলে মন্তব্য করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দল ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত না করে তাদের এই তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দলের মধ্যেও। অনৈতিক কোন প্রস্তাবে কখনো রাজী না হওয়া বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব দেয়ায় দলটির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে অঙ্গসংগঠন, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের কাছে সমালোচিত এসব এমপি। আন্দোলন-সংগ্রাম, দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করে এতোদিন পর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যে সূরে কথা বলতেন, প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক প্রস্তাব দিচ্ছিলেন তাদের সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে সরকারের পক্ষে বিএনপির এমপিরা কাজ করছেন বলেও অভিযোগ তাদের।

ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাওয়া এমপিদের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেত্রী উপাধি খারিজ করতে গিয়ে বিএনপির এমপিরা নিজেরাই ধরা খেয়েছেন। আমাদের দলের কিছু কিছু নেতৃবৃন্দ হঠাৎ করেই ম্যাডামের মুক্তির বিষয়ে খুব আন্তরিক হয়ে গেছেন। তারা হাসপাতালে বেগম জিয়ার সাথে দেখা করেছেন। আমাদের সামনে ও জনগণকে আশ্বস্ত করার জন্য। কিন্তু তারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটিতেই তারা ধরা খেয়েছেন।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নিতান্তই একজন গৃহবধূ ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তার মৃত্যুর পর দলে যখন কোন্দল ও অনেক নেতা এরশাদ সরকারের মন্ত্রী সভায় যোগদানের কারণে ছত্রভঙ্গ ও বিপর্যস্ত অবস্থা তখন ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে রাজনীতি আসেন বেগম খালেদা জিয়া। তার হাত ধরেই শুরু হয় গণতান্ত্রিক ও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। দৃঢ় মনোবল ও কঠোর সিদ্ধান্তে এগিয়েছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে। হয়েছেন সফলও। আন্দোলনের পুরোটা সময় জুড়েই তিনি ছিলেন রাজপথে সক্রিয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিন দলীয় (বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জামায়াত) জোটের বৈঠকে এরশাদের অধীনে হওয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ঘোষণাও দেয়া হয় যারা এরশাদের সাথে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তারা হবে ‘জাতীয় বেঈমান’। এরপরও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এরশাদের সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত অটল ছিলেন খালেদা জিয়া। কোন কিছুর সাথে আপোষ না করে, নিজের কথা না ভেবে চালিয়ে গেছেন আন্দোলন। সেই আন্দোলনে পরবর্তীতে যোগ দেয় আওয়ামী লীগও। কিন্তু খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দিয়ে ভূষিত হয়েছিলেন আপোষহীন নেত্রী হিসেবে। পরবর্তীতে তিন যুগের বেশি সময় ধরে সেই চরিত্র ধরে রেখেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের এই নেত্রী।

বিএনপি নেতারা জানান, দেশবিরোধী ভিনদেশের কোন প্রস্তাবে রাজী না হওয়া, ১/১১’র সরকারের ক্ষমতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কারাবরণ করাসহ পরবর্তী সময়েও গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও দেশ ও জনগণের পক্ষে নিজের অবস্থানে অনঢ় থাকার কারণে অর্জন করেছেন তুমুল জনপ্রিয়তা।

তবে দুর্নীতি মামলায় গতবছরের ৮ ফেব্রæয়ারি থেকে তিনি কারাবন্দি রয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ১৯ মাস ধরে কারাবন্দি চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে দলের আইনজীবীরা আইনি লড়াই করে ব্যর্থ হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। রাজপথেও আন্দোলন করছে দলটি। এই সময়ের মধ্যেও নানা সময় নানা আলোচনা ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপিরা খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চাইলে বিবেচনার কথা বলেন। কিন্তু এসব প্রস্তাব সরাসরিই নাকচ করে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। না করে দিয়েছেন বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রস্তাবও।

তবে হঠাৎ করেই পুরনো সেই প্রস্তাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেন বিএনপির এমপিরা। মাত্র ৭ জন এমপিই নিজেদের মধ্যে বিভক্তির কারণে তার সাথে দেখা করেন দুই ভাগে।

গত ১ অক্টোবর বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে উকিল আবদুস সাত্তার ও আমিনুল ইসলাম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করে এসে জানান, খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন। আজ উনি জামিন পেলে, কাল বিদেশ যাবেন এবং আজই যদি উনি জামিন পান, ওনার প্রথম প্রায়োরিটি হবে চিকিৎসা এবং দেখা যাবে উনি কালই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন। এসময় তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, বাস্তবিকই উনার জামিন পাওয়ার যে নৈতিক অধিকার, এই জামিনের অধিকার থেকে তাকে যেন বঞ্চিত করা না হয়।

পরের দিন আবার খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন জিএম সিরাজের নেতৃত্বে মোশাররফ হোসেন, জাহিদুর রহমান ও রুমিন ফারহানা। জিএম সিরাজ বলেন, আমি সংসদ নেতার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কাছে আহবান জানাবো আপনি একবার এসে দেখে যান, তিন বারের প্রধানমন্ত্রী কি অবস্থায় আছেন। আমি নিশ্চিত যে আপনার ভেতরে মানবতাবোধ জাগ্রত হবে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমলাতান্ত্রিকভাবে না দেখে আপনি বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে যদি যাওয়া লাগে যাবেন। সেটা ওনার নিজের সিদ্ধান্ত-পরিবারের সিদ্ধান্ত। একইদিন সচিবালয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে সাক্ষাত করে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন হারুনুর রশীদ। জানা যায়, তাদের সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার বিষয়ে কথা তুললেই তিনি ‘নো কম্প্রোমাইজ’ বলে জানিয়ে দেন।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দল এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে কোন পরামর্শ না করেই বিএনপির এমপিরা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাত করেন এবং গণমাধ্যমে খালেদা জিয়ার নীতিবিরোধী বক্তব্য প্রদান করেন। যেটি সম্পর্কে দলের বেশিরভাগ নেতাই অবহিত ছিলেন না। একটি অঙ্গসংগঠনের নেতা ইনকিলাবকে জানান, হারুনুর রশীদ বেগম জিয়ার সাথে সাক্ষাতের পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে ফোন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কোন ধরণের পরামর্শ না করে কার সিদ্ধান্তে তারা এটি করছেন সে বিষয়েও জানতে চান। মহিলা দলের এক নেত্রী অভিযোগ করে বলেন, সংসদে যোগ দেয়া থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করছে। এবার তারা যেটি করেছে সেটিও সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ। এমপিদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে চলা আন্দোলন-সংগ্রামে এমপিরা কখনোই অংশগ্রহণ করেন না। এমনকি যার যার এলাকায় বিভাগীয় সমাবেশগুলোতেও কাউকে দেখা যায়নি। তারা হঠাৎ করে কি এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছেন সেটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতারা অভিযোগ করে বলেন, বেগম জিয়া যে আপোষহীন নেতা হিসেবে পরিচিত সেটিকে বিতর্কিত করতেই এমপিরা কাজ করছেন।

দলের জুনিয়র নেতারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমালোচনা করলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেত্রীর খেতাব খারিজ করতেই কাজ করছে বিএনপির এমপিরা। তবে শারীরিকভাবে দুর্বল থাকলেও বেগম জিয়া মানসিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। আর তিনি মাথা নত করার ব্যক্তি নন।

তিনি বলেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। আমরা আমাদের চেষ্টা করবো। আর গণতন্ত্রের প্রতি যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে তাহলে গণতন্ত্রের মুক্তির আন্দোলন আমরা করবো। আন্দোলন যতটুকু করছি, আরো যতটুকু যৌক্তিক করার তা আমরা করবো। আর সেই আন্দোনের মধ্যে দিয়ে খালেদা জিয়া মুক্তি লাভ করবেন।

বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, বলেছেন খালেদা জিয়া অন্য কোন উপায়ে মুক্তি পাবেন না। হয় আইনিভাবে জামিন পাবেন, কেননা এটি তার অধিকার এবং যে মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে সেটি পাওয়ার যোগ্য। আর নাহলে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করবে। #

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Md Abdullah Khan ৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:২৮ এএম says : 0
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য মুক্তি দেওয়া হোক
Total Reply(0)
Md Jahid ৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৩২ এএম says : 0
বেগম খালেদা জিয়া আপোষ করার মতন নেত্রী না উনি মৃত্যুকে ভয় করে না উনার কপালে যদি জেলখানায় মৃত্যু থাকে সেটা হবে কিন্তু তিনি আপোষ করবেন না সেটা বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ জানে।
Total Reply(0)
Abdul Momin ৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৩৪ এএম says : 0
বি এন পির কর্মীদের উচিত দেশনেত্রী বেগম জিয়ার মুক্তির আন্দোলন না করে..দালাল মুক্ত বি এন পি এই আন্দোলন করা উচিত..,
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন