শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি বিএনপির

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৯, ৩:০৪ পিএম

সম্প্রতি ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে জানিয়ে বিএনপি বলেছে, আমরা প্রতিবেশী ভারতের সাথে সমতাভিত্তিক সুসস্পর্ক চাই। কিন্তু এই সরকার যা করছে- তাতে দেয়া নেয়ার বিষয় নেই- আছে শুধু দেয়ার। এমনকি ভারতকে গ্যাস-পানি দেয়ার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন ‘ঠাকুর‘ পুরস্কার। দেশের স্বার্থবিরোধী এমন অসম চুক্তির অধিকার জনগণ সরকারকে দেয়নি। কাজেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের সময় স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই এবং দেশের স্বার্থ হানিকর সকল চুক্তি বাতিল চাই।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

তিনি লিখিত বক্তব্যে বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ার কারণে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়- এমন একটি শক্তি যখন কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তখন তার পরিণতি দেশ ও দেশের জনগণের জন্য কতটা ভয়াবহ ও ক্ষতিকারক হয় তার সাম্প্রতিক প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ফলাফল। সফরকালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের জনগণের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর নির্বিঘ্নে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে যৌথ পর্যবেক্ষণের জন্য রাডার বসানোর অনুমতি দিয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশ থেকে এলপিজি গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অথচ বহু বছর ধরে তিস্তা এবং ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে শুধুই আলোচনা করে চলেছে। এবারো শুধু আশ্বাসই পেয়েছে- কোনো স্পষ্ট নিশ্চয়তা পায়নি। আসামের নাগরিক পঞ্জির প্রেক্ষিতে কয়েক লক্ষ আসামবাসীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আসাম রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্পষ্ট হুমকির মুখে দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতির উল্লেখ নেই।

তিনি বলেন, ভারতে পাটজাত দ্রব্যসহ অন্যান্যে পণ্য রফতানির উপর আরোপিত অন্যায় বাধা অপসারণে নিশ্চয়তা আদায় করতেও বাংলাদেশ সরকার নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রীয় সফরের আগে সরকার যথাযথ প্রস্তুতি নেয়নি, দেশের জনগণকে কিছু জানতেও দেয়নি। এসব নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে শক্তিমান প্রতিবেশীকে খুশি করে ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার সাময়িক ও ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। ইতোমধ্যেই দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী এসব চুক্তির প্রতিবাদে দেশবাসী ফুঁসে উঠেছে। সচেতন ছাত্র সমাজ আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে।

সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, সমালোচনায় ভীত সরকার তার দলীয় লাঠিয়ালদের দিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদী পোস্ট দেওয়ার জন্য বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে খুন করেছে। কিন্তু এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে মাত্র- কাউকে ভীত করতে পারেনি। আজ গোটা দেশের জনগণ এই সরকারকে দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জনকারী এক ক্ষমতালিপ্সু শাসক বলে মনে করে। জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের সোনালী ফসল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এই দূরাচারী শাসকের পতন চায়।

তিনি বলেন, ফেনী নদী আগে বাংলাদেশেরই নদী ছিলো- যৌথ নদী ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকার আরো ৬টি যৌথ নদীর সাথে ফেনী নদীর নাম সংযুক্ত করে একসাথে এসব নদীর পানি বন্টন দিয়ে আলোচনায় রাজি হয়। এবার ফেনী নদীকে আলাদাভাবে বিবেচনা করে তার পানি ভারতীয় একটি শহরের প্রয়োজনে দেয়ার চুক্তি হলো। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই পানি না দিলে সাব্রুম শহর কারবালা হয়ে যেতো বলে মন্তব্য করেছেন। কারবালা কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের তো প্রথমে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ দেখার কথা। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশ বিস্তীর্ণ অঞ্চল খরাক্রান্ত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আহাজারি তাকে স্পর্শ করেনি। তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের মরুকরণ ও লাখো মানুষের আর্তনাদ তার কানে পৌঁছে না। ফেনী নদীতে শুকনা মওসুমে পানির অভাবে চাষাবাদের ক্ষতি, মুহুরী প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখেও তিনি ও তার সরকার সাব্রুমকে কারবালা হতে না দিতে যতটা উদ্যোগী-নিজের দেশের জনগণের আহাজারী, আর্তনাদ ও সর্বনাশ তাদের কাছে ততই মূল্যহীন। এটা কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কিংবা সরকারের অবস্থান হতে পারে না। দেশের স্বার্থে যা কিছু দরকার তার সবকিছুই অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে রেখে অন্যের স্বার্থ পূরণ করা সরকারের নতজানুর নীতির প্রমাণ।

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এলপিজি আমদানিকারক দেশ হয়ে প্রতিবেশীর প্রয়োজনে তা রফতানির জন্য ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ওমেরা পেট্টোলিয়াম লি: এবং বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১’কে লাভবান করার উদ্যোগ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষকে লাভবান করবে-দেশকে নয়। দেড় হাজার কিলোমিটার পথের স্থলে এখন মাত্র ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এলপিজি গ্যাস ভারত পৌছবে। তাদের এই সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে ‘ঠাকুর শান্তি পুরস্কার’ ছাড়া আমরা কি পেলাম? এর আগেরবার ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, আমরা যা দিয়েছি তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। তাহলে এবার আরো এতো কিছু দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো? তিনি বলেছিলেন, দেশের স্বার্থে বিদেশীদের গ্যাস দিতে রাজি হননি বলে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। এবার আমদানি করা ডিউটি ফ্রি এলপিজি দেওয়ার উদ্দেশ্য তাহলে কি?

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে নির্বিঘ্নে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় আমাদের দেশের অবকাঠামো, নাগরিক পরিবহণ, চলাচল এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতির নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্র উপকূলে যৌথ নজরদারীর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেশবাসীর কাছে গোপন করা হয়েছে- যা জানার অধিকার তাদের রয়েছে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ভারত সফরের মাধ্যমে দেশের বিপুল লাভ ও উন্নয়নের বর্ণনা দিতে গিয়ে নানা অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করেছেন। অসত্য তথ্য ও ইতিহাস বর্ণনা করে তিনি ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টা করেছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। অনেক বিষয়ের মধ্যে আমরা আজ শুধু গঙ্গা চুক্তি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফর নিয়ে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন সে সম্পর্কে সত্য তথ্য জানাতে চাই। প্রকৃতপক্ষে ’৭৫-এর আগে গঙ্গার পানি নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি-সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। চুক্তি হয়েছে ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে। এই চুক্তিতে যে গ্যারান্টি ক্লজ ছিলো তা ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়। যার ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরকালে গঙ্গার পানির কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাও অসত্য। ওই সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, “সমতা ভিত্তিক দীর্ঘ মেয়ার্দী সমন্বিত প্রক্রিয়ায় দুই দেশের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থে পানি বন্টনের বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হন”। কোনো আলোচনা না হলে যৌথ ইশতেহারে এই বক্তব্য থাকলো কি করে?

তিনি বলেন, দেশের স্বার্থবিরোধী ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তির প্রতিবাদ করায় গত ৬ অক্টোবর জীবন দিতে হয়েছে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারকে। আবরার দেশের জন্য, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে। আবরারের পুরো বক্তব্যটি বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে তাই আবরার বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। তার এই নির্মম মৃত্যু বৃথা যেতে পারে না। বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। দেশের স্বার্থের পক্ষে তার এই শহীদি মৃত্যু বাংলাদেশের জনগণ বৃথা যেতে দেবে না। দেশের পক্ষে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গত একদশকে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছে। আবরারসহ এই সব দেশপ্রেমিক মানুষের রক্তের ঋণ পরিশোধ করার এখনই সময়। আবরার যে কারণে শহীদ হয়েছে, সে কারণ আজো বিদ্যমান অর্থাৎ দেশ বিরোধী, সার্বভৌমত্ব বিরোধী চুক্তি আজো বাতিল হয়নি। যদি দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিক আজ এক পতাকা তলে এসে দাঁড়াতে পারে তাহলেই শুধু এই চুক্তি বাতিল সম্ভব। আবরারসহ শত শত শহীদের আত্মা সেদিনই শান্তি পাবে যে দিন এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে দেশের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার। আবরারের বিদেহী আত্মা সেদিনই তৃপ্ত হবে, যেদিন জনগণের নির্বাচিত সরকার দেশের স্বার্থ-বিরোধী সকল চুক্তি বাতিল করবে।

কর্মসূচি: দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল ও এই চুক্তির বিরোধীতার কারণে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে আগামী শনিবার ঢাকাসহ দেশের সকল মহানগর সদরে জনসমাবেশ এবং আগামী রোববার দেশের সকল জেলা সদরে জনসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, বরকত উল্লাহ বুলু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সহ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন