মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আবরারের চরিত্র হননের চেষ্টা

মূর্তিমান আতঙ্কের নাম অমিত সাহা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আবরার ফাহাদ। একটি নাম একটি ইতিহাস। দেশমাতৃকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের পক্ষে মতামত দেয়ার জন্য অকালে প্রাণ দিতে হলো তাকে। ’৭১ এ রুমি, ’৫২ সালাম, রফিক, জব্বারদের প্রাণদানের চেয়ে বুয়েট ছাত্র আবরারের প্রাণদান কোনো অংশে কম নয়। বন্ধুত্বের নামে প্রতিবেশি দেশ ভারত যখন তিস্তার চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রেখে ফেনী নদীর পানি চুক্তি করে; তখন দেশের কোটি কোটি মানুষের মতোই হুহু করে কেঁদে উঠেছে তরুণ শিক্ষার্থী আবরারের হৃদয়।

আবরার ভারত ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক চিত্র এবং পানি-বন্দর ইত্যাদির প্রসঙ্গ তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছে। আর তাকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে দিল্লির পদলেহি অমিত সাহাদের পৈশাচিকতায় তাকে প্রাণ দিতে হয়। শুধু কি প্রাণ! দেশপ্রেমী আবরারের চরিত্র হরণের চেষ্টা হয়। আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য আবরারকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরচক্র হিসেবে পরিচিত করে তোলার অপকৌশল নেয়া হয়। অবশ্য অকপর্মের হোতাদের আবরারকে শিবির বানানোর চক্রান্ত সফল হয়নি। দেশপ্রেমী এক আবরার ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের কথা বলে প্রাণ দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আবরারকে পৈশাচিকভাবে হত্যাকান্ডে নিয়ে সর্বত্রই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নমত প্রকাশ করলেই তাকে হত্যা করতে হবে? আর ভিন্নমতাবলম্বী হলেই তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে হবে। আবরারকে যার নেতৃত্বে হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে সে মেধাবী ছাত্র অমিত সাহা। প্রভাবশালী বাপের সন্তান অমিত সাহাদের এই পৈশাচিকতার পথ বেঁছে নিতে হচ্ছে কেন? এর পেছনের রহস্য কি?


গতকাল ঢাকায় এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল আয়োজিত ‘শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ: প্রতিবন্ধকতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক বৈঠকটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন প্রফেসর সাদেকা হালিম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে র‌্যাগিং করা হচ্ছে। যাকে আমরা বলছি, ‘পলিটিক্যাল র‌্যাগিং’। এই পলিটিক্যাল র‌্যাগিং করা হচ্ছে একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত হয়ে পড়ছেন, সেখানে যে আমরা সাধারণীকরণ করে কথা বলবো সেটাও ঠিক না। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িতদের একটি অংশ মনে করছে, সহিংসতা সন্ত্রাস দিয়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, কোনও মূল ধারার রাজনৈতিক দল ‘পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে’ শেখাচ্ছে। মেধাবী ছাত্রদের যে আমরা খুনি বানাচ্ছি সেখানে একটা রাজনৈতিক প্রভাব আছে। এ অবস্থায় একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আমাদের বাচ্চারা বড় হচ্ছে।

ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেয়ার প্রতিবাদ করে আবরার ফাহাদ তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ১.৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের (বাংলাদেশ) পশ্চিমাংশে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিচ্ছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।

হয়তো এসুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন- ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও/ তার মত সুখ কোথাও কি আছে/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও’। জানতে চাইলে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? কোনো ছাত্র যদি অন্যায় অপরাধ করে থাকে, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রয়েছে। তাদের হাতে তুলে দেন। তারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ছাত্রলীগকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার অধিকারটা কে দিল? ছাত্রলীগ ছাত্রদের প্রতিনিধি হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে জোর করে মিছিল-মিটিং করাচ্ছে। তাদের কথা না শুনলে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মাথা ফাটিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পৈশাচিক কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকান্ড নিয়ে তোলপাড় চলছে। ইতোমধ্যেই অভিযুক্তদের গ্রেফতার এবং বুয়েটের ছাত্রদের সব দফা মেনে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ৬ অক্টোবর গভীর রাতে শেরে বাংলা হলের ১০১১ রুম থেকে আবরার আহাদকে ধরে নিয়ে ২০১১ হলে যখন ছাত্রলীগ নেতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেটায়; তখন আবরারের আত্মচিৎকারে ভারি হয়ে উঠে আকাশ-বাতাস। হলের অন্যান্য ছাত্ররা এগিয়ে এসে দেখেন আবরারকে বেদম পেটানো হচ্ছে। হন্তারকরা জানান, ‘শিবির পেটানো হচ্ছে। তোমরা যার যার ঘরে ফিরে যাও’। নির্যাতনের শিকার আবরারের গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে সাধারণ ছাত্ররা পুলিশকে ফোন করেন। লালবাগ থানার পুলিশ এসে এক ঘণ্টা বসে থেকে চলে যায়। থানার ওসি বলছেন, ‘খবর পেয়ে রাত সোয়া দুইটার দিকে পুলিশের একটা দল যায় হলে। কিন্তু তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এসে বলে এখন ঢুকতে পারবেন না, কারণ আমরা শিবির পেটাচ্ছি। পুলিশের এই দলটি ৩টা পর্যন্ত সেখানে ছিল তারপর ‘শিবির পেটানোয়’য় সেখান থেকে চলে যায়।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই বক্তব্য নিয়ে নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন শিবির হলেই কি তাকে পেটাতে হবে? পুলিশ তাকে রক্ষা করবে না?
জানতে চাইলে বিকল্পধারার সভাপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, সংবিধানে নাগরিকের অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানে শিবির হলেই তাকে পিটিয়ে মারতে হবে এমন কথা নেই। আবরারকে পেটানোর সময় পুলিশ গিয়ে এক ঘণ্টা বসে থেকে ‘শিবির পেটানোর’ তথ্য পেয়ে থেকে ফিরে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা-বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও সংবাদ সম্মেলন করে বেশ গর্বের সঙ্গেই বললেন আবরারকে শিবির মনে করে পিটিয়েছে। অবাক কান্ড! শিবির কি নিধিদ্ধ কোনো দল? মেধাবী ছাত্রকে শিবির বানানোর চেষ্টা কেন? কোনো ছাত্র অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। আসলে পুলিশ কার্যত; ছাত্রলীগের আজ্ঞাবহ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দুটি জাতীয় নির্বাচনের পর দেশ পুলিশের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। আর পুলিশ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের তাঁবেদারি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো অঘটন ঘটলেই সেটাকে জামায়াত-শিবির হিসেবে প্রচার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়েছে। সেটাকে এগিয়ে নিচ্ছে পুলিশ বাহিনী। যার পরিণতি আবরারের মতো মেধাবী ছাত্রদের পৈশাচিকভাবে খুন করা হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আবরার হত্যাকান্ড সরকার ও দলের জন্য বিব্রতকর। কারণ ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে এটি ঘটেছে। তবে সেজন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে দায়ী করা ঠিক নয়। যারা অপরাধী তাদের সেভাবেই বিচার হবে। গুটি কয়েকের দায়ভার গোটা পার্টি নেবে না। সরকার ক্ষমতায় আছে, তাই দায় নিতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয়েছে। নৃশংস এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার ফতার করা হয়েছে। বিবেকের তারনায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছি। আবরারের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত আমার মতে তাদের মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত, আদালত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সেখানে তো কয়েকজন মেধাবি ঝড়ে গেল। অপরাধীদের মধ্যে ভ্যান চালকের সন্তানও আছে। এটা তো দেশের জন্য ক্ষতিকর।
আবরার হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। তিনি লিখেছেন, আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্মী। কেন খুন করা হলো আবরারকে? ভারত-বাংলাদেশে অসম সম্পর্ক নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলার কারণে? শিবির করার কারণে? এসব কারণে কাউকে হত্যা করার সুযোগ কি আছে বাংলাদেশের কোন আইনে? ছাত্রলীগকে কাউকে পেটানোর বা হত্যা করার অধিকার কি দেয়া হয়েছে কোন কেতাবে?

এসবের উত্তর হচ্ছে, না। কেউ ভারতের সমালোচনা করলে, সরকারের ভারতনীতির সমালোচনা করলে, ভিন্নমত পোষণ করলে এমনকি কেউ শিবির করলেও একারণে তাকে হত্যা, অত্যাচার, আটক বা পুলিশের কাছে সোপর্দ করার অধিকার নেই ছাত্রলীগের (বা অন্য কারো)। অথচ এরকম কাজ বহুবার করেছে তারা গত দশ-বারো বছরে।
আবরার হত্যার বিচার অবশ্যই করতে হবে। হত্যাকারীদের বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। আর না হলে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে বা দেশের পক্ষে কিছু বললে ছাত্রলীগ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারবে- এমন একটা আইন করতে হবে এদেশে! যে পোস্ট দেয়ার কারণে হত্যা করা হয়েছে আবরারকে তা হাজার হাজার শেয়ার করুন। প্রশ্ন তুলুন নিজের দেশের পক্ষে কথা বলার ‘অপরাধে’ মেরে ফেলার সিস্টেমটা কে বা কারা চালু করেছে এদেশে? কারা ছাত্রলীগকে দিয়ে করাচ্ছে এসব? কাদের নির্দেশে চলে এখন ছাত্রলীগ?
আতঙ্কের নাম অমিত সাহা

বুয়েটে যারা ভর্তি হন তারা সবাই মেধাবী। মেধাবী নতুন ছাত্রদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা। ইসকন পরিবারের সদস্য অমিত হলের সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশ এবং ছাত্রলীগের বিভিন্ন মিছিলে যেতে বাধ্য করতো। বুয়েটের ছাত্রদের মিটিং মিছিলে হাজির করে সিনিয়র নেতাদের কাছে নিজের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ দিত। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্রলীগের এক সমাবেশে বুয়েটের ছাত্রদের যেতে বাধ্য করে। ওই সমাবেশে ১৭ ব্যাচের ছাত্র সাখাওয়াত অভিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়ার পরও সে অসুস্থতার কারণে যেতে দেরি করেন। সে অপরাধে(!) অমিত সাহা অভিকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়। ছাত্রদের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও কেউ অমিতের ভয়ে মুখি খুলতে পারেনি। উল্টো অভিকে বলতে বাধ্য করা হয়- সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। ওই ঘটনার পর থেকে হলে বসবাসরত জুনিয়র ছাত্রদের কাছে অমিত সাহা হয়ে উঠেন মূর্তমান আতঙ্ক। অমিত সাহার হাতে শেরে বাংলা হলের অনেক ছাত্রকে এরকম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মেধাবী ছাত্র হয়েও বুয়েটের শিক্ষার্থীরা কেউ ‘অমিত আতঙ্কে’ প্রতিবাদ করেনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এই হলের ছাত্র হওয়ায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ ছিল রাশেল আর অমিতের হাতে।

কে এই অমিত!
বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহার সম্পর্কে উঠে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অমিত সাহা বুয়েটের জুনিয়রদের ওপর বেশি আগ্রাসী ছিলেন। ইসকনে বিশ্বাসী অমিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের খুশি করতে সব সময় ছিল তৎপর। অমিতের মারধরের স্বীকার হয়েছেন বুয়েটের বেশ কয়েকজন সাধারণ ছাত্র। এ কারণে অমিত সাহাকে আতঙ্ক হিসেবেই ভয় করতো জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। অমিত বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে বুয়েটে ভর্তি হয়েই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে পদ পেতে নিজেকে আগ্রাসী হিসেবে পরিচিত করে তোলেন ক্যাম্পাসে। ফলও পান দ্রুত। স্বল্প সময়ে বনে যান বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক।

১৭ ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের ব্যাচের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অমিত সাহাকে ভয় করতেন। গোপনে সবলেই সিনিয়র অমিতকে গালমন্দ করতেন। অমিত সাহাকে চলাফেরা এবং আচরণে সব সময় আগ্রাসী ও মারমুখী দেখা যেত। তাকে কেউ পছন্দ না করলেও সামনাসামনি কেউ কিছু বলার সাহস পাননি। আবরার হত্যাকান্ডের সঙ্গে অমিতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অমিত সাহার নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশ পায়। তাকে অমিতের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার কাহিনী উঠে আসে।
বুয়েট ছাত্রলীগের ফেসবুক গ্রুপে কাকে কবে ‘র‌্যাগ’ দেয়া হবে সে বিষয়ে আলোচনা হতো। সেরকম একটি ঘটনায় এক সিনিয়রকে পেটানোর জন্য আহ্বান জানানো একটি পোস্টে অমিত কমেন্ট করেন, বুয়েট ছাত্রলীগ সুশীল হবে, মারবেও না, বাট কোনো সুশীল নন-পলিটিক্যাল একটা কথা বলার সাহসও রাখবে না। ইদানিং সুশীলদের কথা অনেক বেশি বাড়ছে।
আবরার হত্যাকান্ডে অমিত সাহা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এমন অভিযোগ বুয়েটের শিক্ষার্থীদের। আবরার ফাহাদকে হত্যার আগে সে হলে আছেন কিনা সে বিষয়ে প্রথম খোঁজ নেন ছাত্রলীগ নেতা সম্পাদক অমিত সাহা। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় অমিত সাহা আবরারের এক বন্ধুকে ইংরেজি অক্ষরে ‘আবরার ফাহাদ হলে আছে কিনা’ মেসেজ দিয়ে জানতে চান। মেসেজের এক ঘণ্টার মধ্যেই শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতারা আবরারকে ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে লাঠি, চাপাতি ও স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন।
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার হওয়া আসামি ইসকনের সদস্য অমিত সাহার বাড়ি নেত্রকোনায়। গ্রেফতার হওয়ার পর অমিতকে নিয়ে নেত্রকোনায় শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। অমিত সাহা নেত্রকোনার সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনার স্থায়ী বাসিন্দা। তার বাবার নাম রঞ্জিত সাহা। তিনি একজন ধানের বড় ব্যবসায়ী। সাহা ট্রেডার্স নামে অমিতের বাবার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অনেকেই এই লাইসেন্স ও ধার নেয়া সুদের টাকা দিয়ে ব্যবসা করেন। অর্থবিত্ত থাকায় এলাকায় অমিতের বাবার রয়েছে প্রভাব প্রতিপত্তি। বাবার অর্থ, প্রভাব ও ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এলাকায় অবৈধভাবে জায়গা, জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অমিতরা নেত্রকোনা পৌর এলাকার নাগড়ায় সাহা পাড়ায় বসবাস করতেন। তবে রঞ্জিত সাহা সেটা বিক্রি করে তেরী বাজার ঝুমা রানী তালুকদারের কাছ থেকে দুই দশমিক ৫০ শতক জায়গা ক্রয় করেন। কিন্তু জোরপূর্বক সীমানা অতিক্রম করে জায়গা দখল করে নেন। প্রতিবেশী হোমিও চিকিৎসক ডাঃ বিশ্বনাথ সরকার জানান, পাঁচ শতক জায়গার মধ্যে পৌনে তিন শতক অর্থাৎ দু দশমিক ৭৫ শতক জায়গার মালিক আমি নিজে। তারমধ্যে বাকি থাকে সোয়া দুই শতাংশ অর্থাৎ দুই দশমিক ২৫ শতক। সেখানে রঞ্জিত সাহা শূন্য দশমিক ২৫ শতক জায়গা দখল করে সীমানা দেয়াল দেন। এ নিয়ে অনেক ঝুট, ঝামেলা হলেও এখনো জায়গা ফেরত দেননি।
অমিতের বাবা রঞ্জিত সাহার ব্যাবসায়ী পার্টনারের নাম অনিল কান্তি সাহা রায়। তিনি জানান, রঞ্জিত সাহা ঘন ঘন ভারত যান। গত ২৩ সেপ্টম্বর রঞ্জিত সাহা স্ত্রীসহ ভারতে গিয়ে এখন বৃন্দাবনে অবস্থান করছেন। অমিত সাহার পরিবারের সকলেই মূলত ইসকনের সদস্য। অমিতরা এক ভাই ও এক বোন। অমিত বুয়েটে ও তার একমাত্র বোন ঐশ্বিরিয়া সাহা নরসিংদী কাদের মোল্লা সিটি কলেজে পড়াশোনা করছেন।
আররার ফাহাদের হত্যাকান্ডে প্রধান পরিকল্পনাকারী অমিতের গ্রেফতার হবার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে নেত্রকোনায় সাধারণ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা অমিতসহ আবরার হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানিয়েছেন।
অমিতের মা-বাবা ভারতে
অমিত সাহা এবং তার বাবা-মা সকলেই ইসকন সদস্য। বর্তমানে অমিতের বাবা রঞ্জিত সাহা ও মা দেবী রানী সাহা ভারতে অবস্থান করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শৈশব থেকেই মেধাবী। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছেন। এলাকার মানুষ খুব শান্ত ও ভদ্র হিসেবেই জানতো। অমিতের বাবা একজন ধানের আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ব্যবসা করলেও প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। বর্তামানে অমিতদের বাসা নেত্রকোনা শহরের আখড়া মোড় এলাকায়। অমিত জেলা শহরের আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা সদরের ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের ঠাকুরাকোনা বাজারের স্বাস্থ্য ক্লিনিকের পাশে।
অমিতের মা দেবী রানী সাহা ও বাবা রঞ্জিত সাহা গত ১৯ সেপ্টেম্বর ভারত গেছেন। এখনও তারা সেখানেই অবস্থান করছেন। নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনা বাজারের ব্যবসায়ী মো. কামাল মিয়া জানান, অমিতের বাবা খুব প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ঠাকুরাকোনা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক জানান, অমিতের বাবা রঞ্জিত সাহা একজন ধানের আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ধানের ব্যবসা করেন। অমিতের বাবার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ঘরানার পরিবার। ছেলে অমিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা শুনেছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (16)
Mir Irfan Hossain ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুনী ছাত্রলীগের টর্চার সেল বন্ধ করা হোক। জাতিসংঘের সহায়তায় তদন্ত কমিটি গঠন হোক। নির্যাতন/পুলিশের হাতে তুলে মামলা দিয়ে ছাত্র জীবন ধংসের অপরাধে, ছাত্রদের ৫০ লক্ষ টাকা ও ছাত্রীদের ১ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতিপুরন দেওয়া হোক। খুন হওয়া ছাত্রদের অভিভাবকদের ৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপুরন দেওয়া হোক।
Total Reply(0)
Shamim Chowdhury ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০১ এএম says : 0
এই সরকারই হিন্দুদের সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে।
Total Reply(0)
Mehedi Hasan Babu ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০২ এএম says : 0
সঠিক পরিচয় দিয়ে শিরোনাম করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি ইনকিলাব কে... সেই সাথে ন্যায় বিচার পাওয়া পর্যন্ত আবরারের পরিবারের পাশে থাকার আহবান জানাচ্ছি
Total Reply(0)
hossain ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
অমিতদের বিষয়ে আপনাদের আরও সজাগ দৃষ্টি রেখে দেশের স্বার্থে তাদের আসল শক্তির উৎস বাহির করে জনগণের কাছে প্রকাশিত করতে হবে।
Total Reply(0)
তুষার আহমেদ ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৩ এএম says : 0
আবরার ফাহাদের খুনের সাথে সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে
Total Reply(0)
Safwan Bin Shahid ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
সঠিক এবং সত্য নির্ভোল শিরোনাম তুলে দেওয়ার জন্য মনের কৌটা থেকে অফুরন্ত টাটকা গোলাপের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
Total Reply(0)
Nazmul Hossain Faisal ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
আবরার ফাহাদের সকল খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানাই।কে কোন দল করে,কে কোন ধর্মের সেটা দেখার বিষয় নয়।অপরাধীর কোনো দল নেই,ধর্ম নেই,সংগঠন নেই।
Total Reply(0)
Minhaz Fuad ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ- ক্ষুদিরাম। ভারত বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবরার ফাহাদ।
Total Reply(0)
বাবুল ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
হে আল্লাহ এই জালিম / জানোয়ারদের নিষ্ঠুরতা থেকে আমাদের সন্তানদের হেফাজত করুন। এই জালিম দেরকে আপনি ধ্বংস করে দিন। আমীন।
Total Reply(0)
Md Iqbal Hossain ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
ইসকন একটি সন্ত্রাসি সংগঠন অতি দ্রুত ইসকনের কার্যক্রম বন্ধ করুন,না হলে আরো অনেক মেধাবী ঝড়ে পড়বে৷
Total Reply(0)
Mortuza Ahmed ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১:০৬ এএম says : 0
ধন্যবাদ সঠিক খবর পৌঁছানোর জন্য
Total Reply(0)
মেহেরুল হক আবীর ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ৯:০২ এএম says : 0
দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি
Total Reply(0)
mostafa ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১০:০৫ এএম says : 0
Minhaz Fuad বলেছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ- ক্ষুদিরাম। এই কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। ক্ষুদিরামের সহিংসরুপে আবিভাব হয়েছিলো বঙ্গভঙ্গর পর। বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলমানরা নিজস্ব একটা অঞ্চল পেলো। বঙ্গভঙ্গের ফলে মোসলমানদের প্রানের সঞ্চার হলো। কলকাতার বাবুরা এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা যুগান্ত্রর নামে একটি সংগঠন গড়ে তুললো । সেই সংগঠনের সদস্য ছিলো ক্ষুদি রাম। উদ্দেশ্য ছিলো বঙ্গভঙ্গ রদ করা। তাদের কিছু সদস্যদের ফ্রান্সে পাঠিয়ে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষন নেয়। এরা কলকাতার প্রথর মুসলমান সরকারী অফিসার (সম্ভবত পুলিশ অফিসার/অথবা ডিসি) কে হত্যা করলো। এদের আলোলনের ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো।
Total Reply(0)
MD. RAMJAN ALI ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১০:২৫ এএম says : 0
inqilab er ei reporter ke hajaro salam
Total Reply(0)
MD. RAMJAN ALI ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১০:২৮ এএম says : 0
Nijeke prokrito Islami sattro sibir vabte amar boro valo lage
Total Reply(0)
HABIB ১৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১০:৫৮ এএম says : 0
Bangladesh is not secure within ............. hand. killing Abrar Fahad is the proved. deep conspiracy going on in the country...
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন