বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্রষ্টার বৈচিত্র্যময় অপরূপ সৃষ্টি

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র থেকে মুসলমানগণ সৌদী আরবে হজ্জ করার জন্য সমবেত হয়। এ বছর (২০১৯) মক্কার পার্শ্ববর্তী মিনা, মুজদালিফা, আরাফাত ময়দান, কাবা মোবারক, মস্জিদে নববীতে (মদিনা) লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ দেখলাম, দেখলাম ভিন্ন ভাষা, রং, আকার এবং চেহারা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমাবেশ সেখানে হয়। এর চেয়ে বড় কোনো সমাবেশ কোনো ধর্মাবলম্বীদের হয় না। মক্কা-মদীনায় হজ্জ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বক্তব্য মতে, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৪৫ লক্ষ মুসলমান নর-নারী এ বছর হজ্জ পালন করেছেন। তাদের মতে, সৌদী আরবের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে অনেকেই হজ্জ করতে আসেন যাদের কোনো হজ্জ পারমিট বা অনুমতি থাকে না। মিনার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে হাজার হাজার নর-নারীর রাত কাটাতে দেখেছি। হজ্জ পারমিট নাই বলে মিনার তাবুতে তাদের স্থান হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বললেন, যেহেতু বৈধ পথে তারা হজ্জ করতে আসে নাই সেহেতু মিনার তাবুতে তাদের স্থান হয় নাই। মুজদালিফায় তিল ধারণের স্থান ছিল না। একজনের উপরে আর একজনের মাথা রেখে নামাজ আদায় করতে হয়েছে। ইতোপূর্বে কয়েকবার হজ্জে যাওয়ার সুযোগ আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে হয়েছিল বটে। কিন্তু সম্প্রতি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের ব্যবস্থাপনার সাথে মুজদাফিলা বা মিনা থেকে ট্রেনে যাতায়াতের সংযোগ অনেক সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ফলে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করার সম্ভবনা নাই। বাংলাদেশ থেকে এ বছর ১ লক্ষ ২৭ হাজারের অধিক নর-নারী হজ্জ পারমিটে হজ্জ পালনে যোগ দেন। বিশ্বের ৫৬টি মুসলিম দেশ ছাড়াও পৃথিবীর এমন কোনো রাষ্ট্র নাই যেখান থেকে হজ্জ পালন করতে মুসলমান আসে নাই। ইহুদি-খ্রিস্টান রাষ্ট্র আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকে অনেক মুসলমান লাব্বায়েক ধ্বনিতে শরিক হয়েছেন। যে সকল রাষ্ট্রে মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন হচ্ছে যেমন- ভারত, জম্মু কাশ্মীর, নেপাল, চীন প্রভৃতি এলাকা থেকেও মুসলিম নর-নারীরা হজ্জ পালনে এসেছেন। শিশু, কিশোর, যুবক, পৌঢ়, বৃদ্ধ, অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না এমন অতিশয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও দেখলাম, যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) রওজা মোবারকে সালাম পেশ করার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। পরিচিত, অপরিচিত কেউ কাউকে রেখে কেউ কিছু খাচ্ছে না। জানা নাই, পরিচয় নাই, ভাষা জানা নাই তবুও ভ্রাতৃত্ব বোধের কারণে যার যার ক্ষমতানুযায়ী বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী বিশেষ করে খেজুর, ফল ফলাদী, জুস প্রভৃতি একে অপরকে বিতরণ করছেন, যা না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে সব চেয়ে আশ্চর্য বিষয় এই যে, কারো সাথে কারো চেহারা, কণ্ঠস্বরের কোনো মিল দেখা গেল না। একই দেশ, একই পরিবার থেকে এসেছে কিন্তু চেহারা বা কণ্ঠের সাথে কারো কোনো মিল নাই। পাঞ্জাবি, বাঙালি, কোরিয়ান, নেপালি, সুদানি, মিশরি, চীনা, ইরানিদের শরীরের গঠন দেখে বুঝা যায় যে, তারা কোন দেশের, তদুপরি নিজেদের মধ্যে কারো চেহারার সাথে কারো চেহারা বা কণ্ঠের সাথে কারো সংগতি নাই। এ অসংগতি থেকে বুঝা যায় যে, সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির মধ্যে কত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারেন।


অপরাধ বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, গবেষকরা গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন যে, জমজ দুই ভাইয়ের আঙ্গুলের ছাপে কোনো মিল নাই। ব্রিটিশ ভারতের কুচবিহারের সিভিল সার্জেন্ট Sir William Herschel মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করে আবিষ্কার করেন যে, বয়স বৃদ্ধি পেলেও আঙ্গুলের রেখার কোনো পরিবর্তন হয় না। আগে নরম মাটিতে আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণের নিয়মনীতি চালু ছিল। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে Dr. Nehemiah মানুষের হাতকে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে আঙ্গুলের রেখা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতেন। ১৭৮৮ সাল Johann Mayer আবিষ্কার করলেন যে, দুই জনের হস্তরেখা এক নয় এবং এক জনের হস্তরেখার সাথে অন্য জনের হস্থরেখা কোনো দিনই মিলবে না। এমন কি আপন জমজ ভাইয়ের হাতের বা আঙ্গুলের রেখার সাথেও মিল নাই। এ কারণেই চীন দলিল বা মূল্যবান প্রমাণাদিতে আঙ্গুলের ছাপ তিন হাজার বছর পূর্বে ব্যবহার শুরু করে।

বার বার যারা অপরাধ করে তাদের সনাক্ত করার জন্য ১৮৮৩ সালে Alphonse Bertillon আঙ্গুলের রেখার উপর গুরুত্ব দেয়ার নিয়ম চালু করেন। Sir Francis Galton Ges Sir Edmund Richard Henry আঙ্গুলের রেখাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন। ১৮৯১ সাল থেকে Ivan (Juan) Vucetich ১০টি আঙ্গুলের রেখার ছাপ ব্যবহার করার প্রচলন শুরু করেন।

এফ.বি.আই (আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন), আমেরিকার ক্রিমিনাল জাস্টিস ডিপার্টমেন্টসহ অপরাধ জগৎ নিয়ে গবেষণা করে ঐক্যমত পোষণ করে আঙ্গুল রেখার তিনটি চৎরহপরঢ়ষব নির্ধারণ করেন। যথা:
(১) First Principle : A fingerprint is an individual characteristic, no two fingers have yet been found to posses identical ridge characteristics. (2) Second Principle : A fingerprint will remain unchanged during an individual’s lifetime. (3) Third Principle : Fingerprints have general ridge patterns that permit them to be systematically classified.
(২)
অর্থাৎ প্রথমত: প্রত্যেকটি আঙ্গুল রেখার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। দুইটি আঙ্গুল রেখা এক হবে না। দ্বিতীয়ত: জীবিত অবস্থায় একজন মানুষের আঙ্গুল রেখা পরিবর্তন হবে না। তৃতীয়ত: আঙ্গুল রেখা পদ্ধতিগতভাবে একের সাথে অন্যের আলাদা করা যায়।

বিজ্ঞানীরা আঙ্গুল রেখাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন যথা- (১) ARCH, যা ৫% মানুষের আঙ্গুলে রয়েছে, (২) WITORL, যা ৩০% মানুষের আঙ্গুলে রয়েছে ও (৩) LOOP, যা ৬০% মানুষের আঙ্গুলে রয়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, মা’র গর্ভে ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকাবস্থায় থেকেই আঙ্গুল রেখা শিশুর দেহে অংকিত হতে শুরু করে। আরো গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের চোখ, ঠোঁট, চোখের দৃষ্টিপাত, এমন কি চোখের ভিতরে চোখের মনির আশে পাশে যে রগ আছে তাতেও কারো সাথে কারো মিল নাই। চিকিৎসা বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান এমনিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে যে, মানুষের অঙ্গের প্রতিস্তরের ভিন্নতা রয়েছে, যা থেকে একজনকে আর একজনের সাথে আলাদা করা যায়।

অপরাধ বিজ্ঞান বা অপরাধী সনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা এখন ডি.এন.এ’র উপর নির্ভরশীল। ডি.এন.এ পরীক্ষায় দেখা যায় যে, একজন মানুষের সাথে অন্য একজনের ৯৯% পারসেন্ট মিল থাকলেও এক পারসেন্ট গড়মিল থেকেই যায় (তথ্যগুলি এফ.বি.আই থেকে প্রকাশিত জার্নাল থেকে গৃহীত)।

একই ফল যেমন আম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আছে, যা আবার জায়গা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ রয়েছে। বাংলাদেশে যে মাটিতে আমের ফলন ভালো হয় সেখানে লিচু জন্মায় না। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম রাষ্ট্র থাইল্যান্ড ফল-ফলাদির জন্য শ্রেষ্ঠ, কিন্তু থাইল্যান্ড থেকে আম গাছ আমদানি করে বাংলাদেশে রোপণ করলে একই স্বাদ বহন করে না। সৃষ্টির ক্ষেত্রে একই প্রকারভেদ প্রাণি জগত, উদ্ভিদ জগত, জলজ প্রাণি প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন সৃষ্টি রহস্য লুকায়িত। বায়ু মন্ডলের প্রকারভেদ ও কার্যক্রম আরো রহস্যজনক। সৃষ্টির কর্তার সে কথারই বাস্তবায়ন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তিনি বলেছেন, আমি যা চিন্তা করি তাই সৃষ্টি। নোনা পানি ও মিষ্টি পানি পাশাপাশি প্রবাহিত হলেও কেউ কাউকে অতিক্রম করে না। পদ¥া ও মেঘনার মিলন স্থলে দেখা যায় যে, একটি নদীর পানির রং ও স্বাদের সাথে অন্য নদীর পানির রং ও স্বাদের তারতম্য রয়েছে। এ মর্মে সৃষ্টিকর্তা পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ‘তিনিই দুটি সাগরকে প্রবাহিত করেছেন, একটির পানি মিষ্ট, সুপেয়, অপরটির পানি লোনা, উভয়ের মধ্যে তিনি রেখে দিয়েছেন এক সীমারেখা, এ অতিক্রম ব্যবধান।’

পৃথিবীর অনেক সৃষ্টি রহস্য এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে, যা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা ছুটে চলছে গ্রহ থেকে গ্রহে, চষে বেড়াচ্ছে সমস্ত বায়ুমন্ডল। পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে ঘোরে না সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এ নিয়েও বিজ্ঞান যখন তল্লাশী চালাচ্ছিল তখন ১৫০০ বছর পূর্বেই আল-কোরান বলেছে যে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এবং সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষ পথে চলে কেহ কাউকে অতিক্রম করে না। পৃথিবীর অনেক অজানা রহস্য আবিষ্কার করতে বিজ্ঞান সফল হতে পারে নাই। যেমন ব্ল্যাক হোল স্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে, অনেক জীবন গিয়েছে কিন্তু এখনো তার রহস্য আবিষ্কার হয় নাই। সৃষ্টিকর্তা পরিষ্কার ভাষায় আরো বলেছেন যে, ‘কত মহান তিনি যিনি নভোমন্ডল, রাশি চক্র সৃষ্টি করেছেন এবং ওতে স্থাপন করেছেন সূর্য, জ্যোতির্ময় চন্দ্র। যারা অনুসন্ধিৎসু ও কৃতজ্ঞচিত্ত তাদের জন্য রাত এবং দিনকে সৃষ্টি করেছেন পরষ্পরে অনুগামী রূপে।’ ‘সূর্য চন্দ্রের নাগাল পায় না, রজনী দিবসকে অতিক্রম করে না এবং মহাশূন্যে প্রত্যেক নিজ নিজ কক্ষপথ সন্তরন করে।’ ফেরাউনের দেহ মাটি ও পানিতে নষ্ট বা পচন ধরে নাই, কেন এ ব্যতিক্রম সে সম্পর্কে বিজ্ঞান এখনো বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রদান করে নাই, তবে এটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছারই প্রতিফলন মাত্র।

মানুষ কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, পারে শুধু রূপান্তর করতে বা পরিবর্তন করতে। যেমন, মানুষ গাছ সৃষ্টি করতে পারে না, গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে আসবাবপত্র বা জ্বালানি বা অন্য কোনো প্রসেসের মাধ্যমে এর অত্যাধুনিক ব্যবহার মানুষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু কিছু সৃষ্টিতে মানুষের হাত নাই। প্রায় ২০০ বছর যাবৎ বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন যে, গাছের প্রাণ আছে। কিন্তু প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে আল-কোরান ফয়সালা দিয়েছে, তরুলতা অর্থাৎ গাছ সৃষ্টিকর্তাকে সেজদা করে।

পৃথিবীতে নানাবিধ প্রজাতির পাখি রয়েছে। অন্যদিকে একই প্রজাতির পাখির রং, আকার, গঠন প্রভৃতি ও সুর একই ধরনের নয়। আল কোরানের মতে, পাখিরাও ভিন্ন ভিন্ন সুরের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, যেদিন স্মরণ করবে না সেদিন তার কণ্ঠ রোধ হয়ে যাবে। সৃষ্টিকর্তা বলেছেন যে, মানুষের দেহ পচে গলে শেষ হয়ে গেলেও তাকে আমি পুনারায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ মর্মে তিনি হযরত মুসা (আ.)-কে পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, একটি পাখিকে জবাই পূর্বক চার টুকরা করে চারটি পাহাড়ে রেখে এসে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে ডাকো এবং পাখিটি জীবন্ত হয়ে উঠে আসার কথা আল-কোরান সাক্ষ্য দেয়।

মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, নভোমন্ডলে এমন সব দূরবর্তী গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে যেখানে আলোর গতিতে ছুটলেও পৌঁছতে লাগবে আমাদের সময়ের বহু সহ¯্র কোটি আলোক বর্ষ। মহাশূন্যের অজানা তথ্য আরো কত গভীরে, কত বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিলে মহাকাশের সীমানা পাওয়া যাবে তা বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারে নাই। এ মর্মে সৃষ্টিকর্তা ঘোষণা আরো স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘হে জ্বিন ও মানবকুল। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, তবে অতিক্রম কর, কিন্তু ছাড়পত্র ছাড়া তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।’
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন