মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘বাবলু শেখ’ আরেক ‘জাহালম’ গল্প

দুদকের পর পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা

নাটোর জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৮ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:২৪ এএম


এ যেন আরেক জাহালত কা-। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের ১১ কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতায় নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমকে বছরের পর বছর অন্ধকারে থাকতে হয়েছে। টাঙ্গাইলের সেই জাহালমের মতোই দূর্বিসহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে নাটোরের দিনমজুর বাবলু শেখকে। দুদক কর্মকর্তার কারণে জাহালম এবং পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতায় নিরীহ বাবলু শেখের কারাভোগ ও আদালতের বারান্দায় দেড় যুগ দৌঁড়ঝাপ করতে হয়েছে। যে কাহিনী এখন সিনেমা নাটকের গল্পকেও হার মানায়।
বাবুল শেখ মুসলমান; আর মামলার মূল আসামী শ্রী বাবু হিন্দু। তারপরও পুলিশ কর্মকর্তার নজিরবিহীন দায়িত্বহীনতায় নামের বিভ্রান্তিত অন্যের সাজা ভোগ করেছেন নাটোরের বাবলু শেখ। পুলিশের ভুলে তিনি মাসের পর মাস হাজত বাস করেন। ১৭ বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরেছেন। শ্রী বাবু নামের এক আসামির পরিবর্তে তাঁকে এই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। নাটোরের সিংড়া উপজেলার আচলকোট গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী বাবলু শেখের যৌবনের বড় সময় আদালতে দৌঁড়াতেই কেটে গেছে। গতকাল নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন।

একই সঙ্গে আদালত দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রায় কার্যকর করে তা আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বাবলু শেখের ঘটনাকে বহুল আলোচিত ‘জজ মিয়া’ ও ‘জাহালম’ কান্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

আদালতের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামের কাজী আবদুল মালেকের সঙ্গে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মালেক বাদী হয়ে শ্রী বাবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নাটোর থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামি শ্রী বাবুকে গ্রেপ্তার না করে একই গ্রামের বাবলু শেখকে ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে নাটোর সদর আমলি আদালতে পাঠান। ভুলের বিষয়টি আদালতকে অবহিত না করে ছয় দিন পর ১৩ নভেম্বর আসামির আইনজীবী শ্রী বাবু পরিচয়েই বাবলু শেখের জামিন করান। পরে ওই পরিচয়েই বাবলু শেখের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন মুখ্য বিচারিক হাকিম মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী আসামি শ্রী বাবুকে দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেন। ওই দিন কাঠগড়া থেকে বাবলু শেখকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে বাবলু শেখ আপিল করেন। আদালত তাঁকে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত জামিন দেন। মামলাটি শুনানির জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এলে আদালত শুনানি শেষে এই রায় ঘোষণা করেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বিচারক প্রকাশ্য আদালতে রায় পড়ে শোনান। এ সময় আদালতে ভুক্তভোগী বাবলু শেখ, তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা ছাড়াও উৎসুক এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

বিচারক তাঁর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, বাবলু শেখ বহুল আলোচিত ‘জজ মিয়া’ ও ‘জাহালম’–এর প্রতিচ্ছবি। তিনি বংশ পরম্পরায় একজন মুসলমান হলেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা শ্রী বাবু হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করে দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন। গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে গেলে সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসামিকে পরীক্ষা না করেই চালান বইয়ে স্বাক্ষর করে অন্যায় করেছেন। যদিও আদালতের নথিতে রহস্যজনকভাবে ওই চালানের কপি সংযুক্ত নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আদালতও কোনো পদক্ষেপ নেননি।

বিচারক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সিদ্দিক বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোমিনুল ইসলাম ও এসআই হেলেনা পারভিন ভুল আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করেননি। পরবর্তী সময়ে নিযুক্ত আইনজীবীরা বিষয়টি জানলেও সে ব্যাপারে আদালতে প্রতিকার চেয়ে তথ্য-প্রমাণসহ দরখান্ত করেননি। তাঁরা ভুল নামেই বাবলু শেখের জামিন করেছেন। শুনানির সময় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কথা বলা হলেও সে মর্মে কাগজপত্র নথিতে পাওয়া যায়নি। আদালত একটি আদেশে ভুল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এসআই হেলেনা পারভিন তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আদালতে জমা দেননি। আদালতও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এই বিচারক বিচার চলাকালে আসামিকে পরীক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়ার সমালোচনা করেন।

পর্যালোচনা শেষে আদালত বাবলু শেখকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একই সঙ্গে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, থানার ওসি ও গ্রেপ্তারে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ক্ষতিগ্রস্থ বাবলু শেখ ইচ্ছা করলে এই রায়ের কপি নিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য উচ্চ আদালতেও যেতে পারেন বলে আদালত মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রায়ের কপি নাটোরের পুলিশ সুপার (এসপি), ডিআইজি রাজশাহী রেঞ্জ ও আইজিপি বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিচারক এ ঘটনায় আইনজীবী ও আদালতকে আরও সতর্ক হওয়ার কথা বলেন। তবে মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় বহাল রাখা হয়। একই সঙ্গে ওই রায় মোতাবেক আদালত মূল আসামি শ্রী বাবুর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারি করার নির্দেশ দেন।
রায় ঘোষণার পর বাবলু শেখ বলেন, তিনি একজন দিনমজুর। অথচ তাঁকে ভুলের খেসারত টানতে হয়েছে ১৭ বছর। কয়েক মাস এ মামলায় সাজাও খেটেছেন তিনি। এ ধরনের ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না হয়, তিনি সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে বলেন।

নাটোরের এসপি লিটন কুমার সাহা বলেন, রায়ের কপি তিনি হাতে পাননি। রায়ের কপি হাতে পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।
বাবলু শেখের বর্তমান আইনজীবী এ্যাড. শামীম উদ্দীন বলেন, এই আদেশে বাবলু শেখের ভোগান্তির অবসান ঘটলো। আদালতে দেয়া রায়ে ১৮ বছর পর মামলা থেকে অব্যাহতি পান বাবুল শেখ। এ ঘটনায় দায়ী তদন্তকারী দুই পুলিশ ও তৎকালিন ওসির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার জন্য আইজিপিকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বাবলু শেখকে ক্ষতিপুরণ দেবারও নির্দেশ দেয়া হয়। ##

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন